॥ আসিফ আরসালান ॥
আজ তিনটি বিষয় নিয়ে লিখবো। প্রথমটি হলো লন্ডনে বেগম খালেদা জিয়া এবং জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের বৈঠক। দ্বিতীয়ত যে শিল্পী শেখ হাসিনার মুখাবয়ব ১লা বৈশাখের শোভাযাত্রায় বহন করার জন্য এঁকেছিল সে শিল্পীর বাসায় অগ্নিসংযোগ। তৃতীয়ত নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল এবং জামায়াতের আমীরের বক্তব্য। প্রথমে লন্ডনে বেগম জিয়ার সাথে ডা. শফিকুর রহমানের সাক্ষাৎ নিয়ে শুরু করছি।
গত রবিবার ১৩ এপ্রিল লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং বেগম জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের বাসায় জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় জামায়াতের আমীরের সাথে ছিলেন দলটির নায়েবে আমীর সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। যেহেতু বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় দুটি দলের নেতাদের মধ্যে সাক্ষাৎ তাই এ সাক্ষাৎ নিয়ে দেশে স্বাভাবিকভাবেই নানা কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। ডা. শফিকুর রহমান কয়েকদিন আগেই দেশে ফিরেছেন। প্রায় দুসপ্তাহ আগে জামায়াতের আমীর ইউরোপের দেশ বেলজিয়াম সফরে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে সরাসরি দেশে না ফিরে তিনি লন্ডনে যান। এ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন যে, বেগম জিয়ার সাথে দেখা করার জন্যই তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন। তার ভাষায়, এটি ছিল নেহায়েৎ সৌজন্য সাক্ষাৎ। তবে যেহেতু দু’জনেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাই তাদের মধ্যে রাজনৈতকি আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তারা রাজনৈতিক আলোচনা করেছেন ঠিকই, কিন্তু সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা ধরে নয়। অথবা কোনো রকম সিদ্ধান্তে আসার লক্ষ্য নিয়েও এ আলোচনা হয়নি। বেগম জিয়া কারারুদ্ধ ছিলেন। সেখানে তিনি অসুস্থ হন। চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডন আসেন। এর মধ্যে বেগম জিয়ার সাথে তার আর দেখা হয়নি। এজন্য এ অসুস্থ নেতাকে দেখা এবং তার সাথে সৌজন্য বিনিময়ের একটি তাগিদ তার মধ্যে ছিল।
দেশে ফেরার পর সাংবাদিকরা তাকে নির্বাচনের দিনক্ষণ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন যে, জুন মাসে যেহেতু বর্ষাকাল তাই ঐ সময়টা নির্বাচনের উপযুক্ত নয়। সেকারণে নির্বাচনটা আগামী রমযানের পূর্বে করলেই ভালো হয়। এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, আগামী জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা তিনি বলেছেন।
আগামী নির্বাচন সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন সেটি তার সম্পূর্ণ বক্তব্য নয়। গত ১৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার হোটেল ওয়েস্টিনে তার ইউরোপ সফর সম্পর্কে সাংবাদিকদেরকে অবগত করার জন্য অনুষ্ঠিত সংবাদ সন্মেলনে তিনি বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। শর্তগুলো হলো-সংস্কার, ফ্যাসিস্টদের বিচার এবং সঠিক নির্বাচন পদ্ধতি। জামায়াত ৪১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, বিএনপি ৩১ দফা, অন্যরা ৫৬-৫৭ দফা প্রস্তাব করেছে। তবে জামায়াত শুধুমাত্র ছয়টি মৌলিক সংস্কার চায়।
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্টদের বিচার এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। নির্বাচনকে এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে, যাতে কেউ সহজে প্রক্রিয়াটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। এ বক্তব্যের পর নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জামায়াতের অবস্থান সম্পর্কে আর কারো কিছু বলার কোনো অবকাশ থাকে না।
দ্বিতীয়টি হলো, ১ লা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রার শিল্পীর বাসভবনে হামলা ও অগ্নি সংযোগ। এ শিল্পীর নাম মানবেন্দ্র ঘোষ। শিল্পীর বাড়ি মানিকগঞ্জ। তার বাসায় হামলার অভিযোগে ৪ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের অভিযান চলতে থাকবে। যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলেন, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অর্থ সচিব আল আমিন তমাল, মঈন উদ্দিন আহম্মেদ পিয়াস, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক (২২), বাবুল হোসেন, মানিকগঞ্জ ৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি এবং মীর মারুফ (২১)।
॥ দুই ॥
মানবেন্দ্র বলেন, ১লা বৈশাখের আগের দিন ‘রাজ্যসভা’ নামক ফেসবুক পেজে একটি বিভ্রান্তিকর খবর প্রচার করা হয়। বলা হয় যে, আমি নাকি পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ছবি এঁকেছি। মানিকগঞ্জের গড়পাড়া বাজারে তার বাড়ি। অগ্নিসংযোগের সময় তিনি বাড়িতেই ছিলেন। রাত ২.৩০ মিনিটে তার বাড়ির একটি ঘরে আগুন দেওয়া হয়। ঐ ঘরে ৩০টি ভাস্কর্য ছিল। আমি শিল্পী হওয়ার পর যতগুলো ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলাম তার সবগুলি পুড়ে গেছে। এছাড়া ঐ ঘরে যতো আসবাবপত্র ছিল তার সবই পুড়ে গেছে। মানিকগঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত সুপার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন যে, ১৩ এপ্রিল এই মর্মে একটি প্রচারণা চলে যে শেখ হাসিনার দানবের আকৃতির মুখাবয়ব মানবেন্দ্র বানিয়েছেন। পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। মানবেন্দ্রের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয়েছে। সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী বলেন, আমি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাথে কথা বলেছি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তৎক্ষণাৎ পুলিশের আইজিকে ফোন করেছেন। ফারুকী বলেন, দুষ্কৃতকারীদের একজনকেও ছাড়া হবে না।
মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে বসে বাংলাদেশে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী ঘরানার লোকজনকে ক্রমাগত উষ্কানি দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি রাখঢাক না করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বলছেন পাল্টা আঘাত করতে। ভারতের মদদে হাসিনা শুধু হৃত গদিই ফিরে পেতে চান না, তিনি আরও চান, তার ইসলাম বিরোধী সংস্কৃতি নব জাগ্রত বাংলাদেশের ওপর আবার চাপিয়ে দিতে। তাই ১লা বৈশাখের একদিন আগে অর্থাৎ শুক্রবার ১২ এপ্রিল দিবাগত রাত ৪টার সময় চারুকলা ভবনের দেওয়াল টপকে এক মুখোশধারী ব্যক্তি ভবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। যেখানে দানব আকৃতির হাসিনার কাঠের নির্মিত মোটিভে সে আগুন ধরিয়ে দেয়। অপর দুজন দুষ্কৃতকারী পাহারায় ছিল। আগুন দেওয়া হলে তারা সকলেই আবার দেওয়াল টপকে পালিয়ে যায়।
এ অগ্নি সন্ত্রাস সর্বশ্রেণীর মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। ১লা বৈশাখের সংগঠকরা পণ করেন যে যত অসম্ভবই হোক, তারা শেখ হাসিনার দানব মূর্তি কাঠ দিয়ে না হলেও অন্য উপায়ে নির্মাণ করবেনই। তদনুযায়ী ১লা বৈশাখের বিশাল আনন্দ শোভাযাত্রায় শেখ হাসিনার দানবীয় মুখের ছবি বা এফিজি বহন করা হয়।
১লা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে সংঘটিত দুইটি অগ্নিসংযোগের ঘটনা থেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিসমূহের শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন গর্তে চলে গেছে বলে আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে চলবে না। ভারতীয় গণমাধ্যম এবং বিজেপির দিকে তাকালে দেখা যাবে, বাংলাদেশে ইন্টারিম সরকারকে হটানো এবং শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় বসানোটাই যেন তাদের এখনকার একমাত্র এজেন্ডা।
বলা হয় যে, জন্ডিসে আক্রান্ত রোগী নাকি সব কিছুই হলুদ দেখে। বিজেপি এবং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুত্ববাদী গণমাধ্যম পশ্চিমবঙ্গে সংঘটিত বড় বড় ঘটনার পেছনে বাংলাদেশের হাত আবিষ্কার করছে। কয়েকদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে গেল তার পেছনে নাকি প্রধানত কাজ করেছে বাংলাদেশীরা। এই দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ২০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছেন। বিজেপি বলছে যে, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশী রয়েছে। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী হিন্দুত্ববাদী বিজেপির এ উদ্ভট অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আগামীতেও যে ভারত সরকার বাংলাদেশে বড় ধরনের গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করবে সে ব্যাপারে রাজনৈতিক মহলের কোনো সন্দেহ নেই ।
॥ তিন ॥
গত ১৬ এপ্রিল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সাথে বিএনপির আনুষ্ঠানিক বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই উচ্চকন্ঠে বলছিলো যে তারা আগামী নির্বাচন ডিসেম্বরের পর যেতে দেবে না। এ দাবি নিয়েই তারা বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে মিলিত হন। ৭ সদস্যের বিএনপি টিমের নেতা ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দুই ঘন্টাব্যাপী আলাপ আলোচনার পরেও বরফ গলেনি। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নিয়ে কিছু বলেননি। তবে তিনি বলেছেন যে, ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদেরকে মির্জা ফখরুল বলেন যে, তারা এ বৈঠকের ফলাফল নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন। বরং তারা অনেক অসন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেন, ডিসেম্বর মাসের মধ্যে যদি নির্বাচন না হয় তাহলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে চলে যাবে।
পর্যবেক্ষক মহল মির্জা ফখরুলের এ উক্তিকে একটি প্রচ্ছন্ন হুমকি বলে মনে করছেন। ২ ঘন্টা ধরে কথাবার্তা বলেও ডিসেম্বরের ব্যাপারে তারা ড. ইউনূসের সম্মতি আদায় করতে পারেননি। তাহলে এখন বিএনপি কী করবে? জানা গেছে, বিএনপি তার জোট সঙ্গীদের সাথে এব্যাপারে আলোচনা করছে। তারা কী কর্মসূচি দেয় তার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের রাজনীতির গতিধারা।
॥ চার ॥
গত ১৭ এপ্রিল এ সরকার অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ করেছে। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে এমন কাজ হয়নি। কাজটি হলো, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়ানোর ভারতীয় চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং প্রতিবেশী দেশটিকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ‘পূর্ণ নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাসসের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এ অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশকে জড়ানোর যেকোনো চেষ্টাকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি’। শফিকুল আলম বলেন, বাংলাদেশ সরকার মুসলিমদের ওপর হামলা এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তা হানির ঘটনার নিন্দা জানায়। তিনি বলেন, ‘আমরা ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই’।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সপ্তাহে মুসলিম-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় নতুন ওয়াকফ আইন নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলাকালে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হুগলি জেলায় এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে আগুন লাগানো, ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং রাস্তা অবরোধের ঘটনা ঘটে।
Email: [email protected]