ভারতের সাম্প্রতিক আচরণে পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, দিল্লী হয়তো পাকিস্তানে হামলার একটি বয়ান তৈরির চেষ্টা করছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক ডজনেরও বেশি বিশ্বনেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভারতের রাজধানীতে অবস্থিত ১০০টি মিশনের কূটনীতিকরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে অংশ নেন। কিন্তু এ প্রচেষ্টা যে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিপজ্জনক সংঘর্ষের উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করার বিষয়ে নয়, এটি স্পষ্ট। আলোচনা সম্পর্কে অবগত চারজন কূটনৈতিক কর্মকর্তার মতে, নয়াদিল্লী তার প্রতিবেশী এবং প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের জন্য একটি বয়ান তৈরি করছে বলে মনে হচ্ছে। এক ভাষণে গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে নরেন্দ্র মোদি সন্ত্রাসীদের কঠোর শাস্তি এবং নিরাপদ আশ্রয়স্থল ধ্বংস করার হুঙ্কার দিয়েছেন। ভারতীয় কর্মকর্তারা রোববার জানিয়েছেন, দুপক্ষের নিরাপত্তা বাহিনী সীমান্তজুড়ে মাঝেমধ্যেই গুলিবিনিময় করছে, এ চিত্র পরিস্থিতি কতটা অস্থির তার ইঙ্গিত দেয়। নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে তুলছে। ২৪ এপ্রিল বিহারে এক সমাবেশে তিনি বলেন, যারা এ হামলা চালিয়েছে এবং যারা এ নীলনকশা সাজিয়েছেন, তাদের কল্পনাতীত পরিণতি ভোগ করতে হবে। অবশ্য এর বিপরীত বয়ানও রয়েছে।
ভারত যখন পাকিস্তানকে হুমকি দিচ্ছে, তখন ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভি প্রকাশ করেছে ভিন্নরকম খবর। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলার নেপথ্যে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির একজন বিধায়ক। এ কারণে বিধায়ক আমিনুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর (সিআরপিএফ) গাড়িবহরে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ও গত মঙ্গলবার পেহেলগামে হামলার ঘটনাটিকে ‘সরকারের ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করেন বিধায়ক আমিনুল ইসলাম। তিনি আসামের বিরোধী দল অল ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এআইইউডিএফ) একজন বিধায়ক। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে আসাম পুলিশ বলেছে, রাজ্যের বিধায়ক আমিনুল ইসলামের বিভ্রান্তিকর ও উসকানিমূলক মন্তব্যের ভিত্তিতে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার এ মন্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় বিরূপ পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কা রয়েছে। যে কারণে তাকে আইন অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয়েছে।
পেহেলগামে হামলার ঘটনায় ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা জড়িত বলে উল্লেখ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ভারতীয় নাগরিক সায়ক ঘোষ চৌধুরী। বুধবার কাশ্মীরে নিজের আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানকে প্রত্যাঘাত করা হবে কি হবে না, সেটা আমার কাছে তুচ্ছ বিষয়। আমি সাধারণভাবে বিশ্বাস করি না যে, অমিত শাহ-অজিত দোভালদের সাহায্য ছাড়া কোনো অস্ত্র কিংবা অস্ত্র চালানোর লোক কাশ্মীরে ঢুকতে পারে। আগে তবুও অনেক জায়গা ছিল, যেখান দিয়ে জঙ্গি ঢোকার সুযোগ ছিল। এখন প্রযুক্তির উন্নতির পরে সেসব জায়গা অতিসহজেই নজরদারি করা যায়। আর আমি কার্গিল যুদ্ধের পর কাশ্মীরে গেছি। আমি কোনোদিন শুনিনি যে, জঙ্গিরা পর্যটকদের হত্যা করে? এমন ধারার বক্তব্য আরও অনেকে দিয়েছেন, যারা ভারত সরকারের বক্তব্য বিশ্বাস করছেন না। আমরা জানি, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দোষারোপ তথা ব্লেম গেমের চর্চা একটি পুরানো বিষয়। অনেক সময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, আবার অনেক সময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বিষয়টি ভালোভাবেই জানেন। নানা পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে অনেক কিছুই করতে হয়। তাই পেহেলগাম ঘটনার প্রকৃত রহস্য জানতে আমাদের হয়তো আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
আমরা জানি, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অব্যাহত বিরোধের মূল কারণ কাশ্মীর। এ বিরোধ সুরাহার কোনো লক্ষণ নেই। ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক হামলায় ২৬ পর্যটক নিহতের ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছে পাকিস্তান। শুক্রবার মার্কিন সংবাদ মাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ দাবি জানান পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান মনে করে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এ ঘটনার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন এবং এর সঙ্গে যে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে তিনি প্রস্তুত। খাজা আসিফ বলেন, ভারত সিন্ধু নদের পানিচুক্তি স্থগিত এবং দেশটির অভ্যন্তরে রাজনৈতিক প্রচারণার জন্য এ ঘটনাকে ব্যবহার করছে। কোনো ধরনের তদন্ত কিংবা প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে ভারত এ পদক্ষেপ নিয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের আগুন জ¦ালাতে চাই না। কারণ এতে পুরো অঞ্চলই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।’
এদিকে শনিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ খাইবার-পাখতুন খাওয়া প্রদেশের কাকুলে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, যে কোনো প্রকার ‘স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ’ তদন্তের সহযোগিতার জন্য ইসলামাবাদ প্রস্তুত রয়েছে। তিনি বলেন, ‘পেহেলগামের সাম্প্রতিক করুণ ঘটনা আরেকটি উদ্দেশ্যমূলক দোষারোপের রাজনীতির উদাহরণ হয়ে থাকবে, যা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত।’ এদিকে ভারতের পানিচুক্তি স্থগিতের বিষয়ে শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘পানি পাকিস্তানের একটি মৌলিক জাতীয় স্বার্থ। যে কোনো পরিস্থিতিতে, যে কোনো মূল্যে এ সরবরাহ নিরাপদ রাখা হবে। সুতরাং সিন্ধু পানি চুক্তির অধীন পাকিস্তানের প্রাপ্য পানির প্রবাহ বন্ধ, কমানো বা পরিবর্তন করার চেষ্টাকে পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিহত করা হবে। এ বিষয়ে কোনো মিথ্যা ধারণা বা সন্দেহের অবকাশ নেই।’ উল্লেখ্য যে, কাশ্মীরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যবর্তী ‘নিয়ন্ত্রণ রেখায়’ (এলওসি) গোলাগুলি অব্যাহত রয়েছে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীদের মধ্যে।
এদিকে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানের দিক থেকে প্রথম গুলি ছোড়া হয়। জবাবে ভারতীয় বাহিনীও গুলি ছোড়ে। অবশ্য এতে কেউ হতাহত হয়নি। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। গত মঙ্গলবার ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। এ ঘটনার জন্য ইসলামাবাদকে দায়ী করেছে নয়াদিল্লী। হামলাকারীদের গ্রেফতারে কাশ্মীরজুড়ে অভিযান চালাচ্ছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। স্থানীয় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থান থেকে ইতিমধ্যে ১৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে শুক্রবার পাঁচ কাশ্মীরির বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়, কাশ্মীরের শোপিয়ান, কুলগাম ও পুলওয়ামা জেলায় ওই বাড়িগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীরে হামলার জেরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে ইরান। শুক্রবার এক্সে এক পোস্টে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাকচি দু’দেশকে ভ্রাতৃসুলভ প্রতিবেশী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতায় ইরান প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া উভয়পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল-সউদ পাকিস্তান ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে পৃথকভাবে ফোনালাপ করেছেন। এদিকে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, দু’দেশ নিজেরাই তাদের সমস্যার সমাধান করবে। ট্রাম্প আরও জানান, তিনি পাকিস্তান ও ভারত উভয়েরই ঘনিষ্ঠজন। ট্রাম্প ঠিকই বলেছেন, সমস্যার সমাধান দেশ দুটিকেই করতে হবে। অন্য কারো কথা তারা মানবেন বলে মনে হয় না। ভারত তো জাতিসংঘের কথাই শোনেনি। ফলে গণভোটের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হযনি। এবার পেহেলগামের ঘটনায় ভারতরে অভিযোগের জবাবে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে। এখন ভারতের জবাবটা কেমন হয় সেটাই দেখার বিষয়।
বৃটিশরা ভারত ছাড়লেও সমস্যা ভারতকে ছাড়েনি। ১৯৪৭ সালের আগস্টে বৃটিশদের কাছ থেকে পাকিস্তান (১৪ আগস্ট) ও ভারত (১৫ আগস্ট) স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই কাশ্মীর নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ‘ইণ্ডিয়ান ইনডিপেণ্ডেন্স অ্যাক্ট’ নামে ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল তাতে বলা হয়েছে, কাশ্মীর তার ইচ্ছা অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান-যে কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দিতে পারবে। কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা ছিলেন হরি সিং।
মূলত তিনি ছিলেন বিরোধের আসল কারণ। এ হিন্দু রাজা বলেছিলেন, কাশ্মীর হয় স্বাধীন থাকবে, নইলে ভারতের সঙ্গে যোগ দেবে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন কাশ্মীর যেন পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে রাজা হরি সিং সিদ্ধান্ত নেন, কাশ্মীর ভারতে যোগ দেবে। তিনি ভারতের সামরিক সহায়তাও পান। এ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধ চলে প্রায় দু’বছর। ১৯৪৮ সালে ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। ফলে ১৯৪৮ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ৪৭ নম্বর প্রস্তাব পাস হয়। এ প্রস্তাবে কাশীরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়। এতে কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি।
তবে ভারতের সামরিক উপস্থিতি বজায় থাকায় পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানায়। তখন থেকেই কার্যত কাশ্মীর পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দু’অংশে ভাগ হয়ে যায়। কাশ্মীরের ভারত অংশ হচ্ছে কাশ্মীর উপত্যকা, জম্মু ও লাদাখ। আর পাকিস্তানের অংশটি হলো আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট-বালতিস্তান। ভারত শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি মুসলিম। এটাই হচ্ছে ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাশ্মীরের ভারত অংশের নাগরিকদের অধিকাংশই চায় না ভারতের শাসনে থাকতে। তারা চায় কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তি। বাস্তবতা হলো, কাশ্মীরের উভয় অংশেই মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ কারণেই জাতিসংঘের প্রস্তাব সত্ত্বেও ভারত কাশ্মীরে গণভোটের রোডম্যাপে যায়নি। অথচ সেটাই ছিল গণতন্ত্রসম্মত এবং শান্তির একমাত্র পথ। এমন সোজা ও শান্তির পথে না গিয়ে যুদ্ধের পথে ভারত আসলে কী লাভ করতে চায়?