ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ কী সত্যিই শেষ হয়েছে কি না এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল বিশ্লেষকদের মধ্যে। সে যুদ্ধ শুরুর মাসখানেক পরে এসেও সে বিষয়টি তাদের মনে এখনো রয়ে গেছে। গত ২৫ জুন সংঘর্ষ থেমেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেটিকে ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ বলেছেন। যুদ্ধে এক পর্যায়ে আমেরিকাও যুক্ত হওয়ার ফলে কার্যত এটা ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধের রূপ নেয়। শেষে ট্রাম্পের আহবানেই ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধ করে। সে সময়ে ইরান পাল্টা হামলায় বেশ সাফল্য দেখাচ্ছিল। কার্যত যুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়ে ইসরাইল আরো ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ার আশায় যুদ্ধ বিরতির পথে পা বাড়ায়। কিন্তু কথা হচ্ছে যুদ্ধ কার্যত কোন দেশের জন্যই মঙ্গল ডেকে আনে না, ধ্বংস ছাড়া। ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল সম্ভবত সেটা উপলব্ধি করেছে। কারণ ইরানী হামলায় রাজধানী তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহর ও জনপদ তছনছ হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন বার্তা মাধ্যমের খবর। ইরানের সঙ্গে টানা ১১ দিন লড়াই চালিয়ে ১২তম দিনে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয় ইসরাইল। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধের সব লক্ষ্য অর্জনের দাবি করলেও বিভিন্ন স্বাধীন বিশ্লেষক এ দাবিকে খণ্ডন করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম ধ্বংস করা এবং সরকারের পতনের মতো মূল লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র থেকে ইসরাইলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফল হলেও এ সিস্টেম চালাতে বিপুল অর্থব্যয় হয়েছে। তেল আবিব হাইফাসহ বিভিন্ন শহরে একটার পর একটা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন। ইসরাইলী নাগরিকরা আতংকে বাংকারকে বসবাসের জন্য বেছে নিতে বাধ্য হয়।

আর্থিকভাবেও ইসরাইল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর প্রাক্তন আর্থিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিয়েম আমিনাচ জানিয়েছেন, যুদ্ধের প্রথম দিকে প্রতিদিন প্রায় ৭২৫ মিলিয়ন ডলার সামরিক খরচ করেছে ইসরাইল। এর মধ্যে ৫৯৩ মিলিয়ন ডলার ছিল ইরানের বিমান হামলার প্রতিরোধের জন্য, বাকি অর্থ খরচ হয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও রিজার্ভ সংগ্রহে। বার্তা সংস্থার অন্যান্য প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যেমন ‘ডেভিডস্লিং’ প্রতিটি ইরানী ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে প্রায় ৭ লাখ ডলার খরচ হয়েছে, আবার ‘এরো থ্রি’ ব্যবস্থায় একক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে খরচ হয়েছে ৪ মিলিয়ন ডলার। এভাবে ৪০০টিরও বেশি ইরানী ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবেলায় ব্যাপক অর্থ ব্যয় হয়েছে।

বিভিন্ন তথ্যসূত্র মতে, এ ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের সামরিক খরচ প্রায় ২.৪ বিলিয়ন থেকে ৮.৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে হয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠনে আরও ৪০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হতে পারে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও প্রভাব পড়েছে ইসরাইলের উপরে। গাজা, লেবানন ও ইরানের বিরুদ্ধে চলা এ সংঘাতের কারণে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪.৩ শতাংশ থেকে কমে ৩.৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

আর ইরানেরও বেশ ক্ষতি হয়েছে। নিহতের দিক থেকে এ সংখ্যা প্রায় এক হাজার। বলা হয়ে থাকে তাদের পরমাণূ কর্মসূচি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ইরান এটা মানতে নারাজ। তাদের মতে পরমাণু কর্মসূচির খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। ইরান যেহেতু আক্রান্ত ছিল তাই, তাই তার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য ছিল না ১২ দিনের সংঘাতে। তাকে করতে হয়েছে আত্মরক্ষা এবং তার পর পাল্টা আঘাত।

একটি বার্তা মাধ্যমের খবর, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু তারা হয়তো সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ খালি করে ফেলেছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএইএ এবং অনেক পর্যবেক্ষক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে দেশের পারমাণবিক কর্মসূচি মাত্র কয়েক মাস পিছিয়ে গেছে। যদিও অন্যান্য বিশ্লেষক এবং ইসরাইলী ও পশ্চিমা কর্মকর্তারা এতে দ্বিমত পোষণ করেছেন। ইরান আইএইএর সাথে সহযোগিতা স্থগিত করেছে।

এ যুদ্ধে ইসরাইল একা ইরানকে সামলাতে না পেরে যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্ত করে। ১৯ জুন দিবাগত রাতে ইসরাইলের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালায়। ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে’, ট্রাম্প এমনটাই দাবি করেন। জবাবে ২১ জুন ইরান মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি আল-উদেইদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এ পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, মধ্যপ্রাচ্য হয়তো দীর্ঘমেয়াদি এক যুদ্ধের মুখোমুখি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প তাঁর মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন, ‘ইসরাইল ও ইরান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’

দেখা যাচ্ছে ইসরাইল সীমিত পরিসরে মধ্যপ্রাচ্যে তার শুরু করা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়াতে সক্ষম হয়েছে। এর আগে ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে উপকরণ দিয়ে সহায়তা দিয়েছিল, কিন্তু সরাসরি অভিযান চালায়নি। এবার সেই ব্যবধানও ঘুচেছে। নেতানিয়াহু তাঁর দেশের পাশে আমেরিকাকে দাঁড় করাতে সক্ষম হন।

যুদ্ধে ইসরাইল কী পেল এমন প্রশ্ন আসতে পারে। ইসরাইল বহু বছর ধরেই বলে আসছে, ইরান তাদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। কিন্তু তারা আগে কখনো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর সরাসরি হামলা চালায়নি। ১৩ জুন ইসরাইল সেই সীমারেখা অতিক্রম করে। নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। ইরানের ২০ জন সমর নায়ক ও পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় থমকে গেলেও জবাব দিতে দেরি করেনি ইরান। তারা ইসরাইলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। ইসরাইল অতীতে সিরিয়া ও ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এবার অনেক দূরে, জটিল অভিযান পরিচালনা করার সক্ষমতা দেখাল তারা। ইসরাইলের এ অভিযানকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকে অবৈধ বলে বিবেচনা করে ও নিন্দা জানায়। তবে আশপাশের মুসলিম দেশগুলোও নিন্দায় শামিল হয়। তবে তাদের প্রতিক্রিয়া তেমনটা জোরালো ছিল না।

তেল আবিব ইরানে এ ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ চালিয়েছে এমন এক সময়ে, যখন ইসরাইল এর আগেই ইরানের আঞ্চলিক মিত্র হুতি বিদ্রোহী (ইয়েমেনে), হামাস (ফিলিস্তিনের গাজায়) ও হিজবুল্লাহকে (লেবাননে) একাধিকবার আঘাত করেছে। গাজা যুদ্ধ তখনো চলমান ছিল। ইয়েমেনের হুতিরা কিছু আক্রমণ করলেও হিজবুল্লাহ ছিল নিরব।

অন্যদিকে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড়। যদিও ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেছেন, ইরানের এ কর্মসূচিকে তিনি আবার চালু হতে দেবেন না। বিশ্লেষকরা বলছেন এ মৌলিক দ্বন্দ্ব যদি রয়ে যায়, তাহলে সামনে আবারও পাল্টাপাল্টি হামলা, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

মাত্র ১২ দিনের ভয়াবহ এ সংঘাতে কার কী লাভ হলো? আর এর পর কী? ইসরাইলের ‘লাভ’ বলতে তাদের লক্ষ্য ‘সামান্য’ অর্জিত হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের লাভ হলো, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও তেহরানের দাবি, ওই হামলায় তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। এদিকে ইরানের ‘লাভ’ কী হলো তা নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন অনেক বিশ্লেষক। যুদ্ধে নিজেদের ‘অপরাজেয়’ শক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে সফল হয়েছে ইরান। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছে দেশটি। এটা তাদের বিরাট সাফল্য। যুদ্ধের সমীকরণ অনুযায়ী, পরাজিত শক্তিই মূলত ‘সাদা পতাকা প্রদর্শন’ করে আত্মসমর্পণ করে বা যুদ্ধবিরতি চায়। কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের অবস্থাও তেমনই হয়েছে। অনেকটা তড়িঘড়ি করেই যুদ্ধবিরতির দিকে ধাবিত হয়েছেন ট্রাম্প।

তেহরানে অবস্থিত সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের গবেষক আব্বাস আসলানি মনে করেন, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানে তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। আল-জাজিরাকে তিনি জানান, যৌথ শক্তির (ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র) উদ্দেশ্য ছিল ইসরাইলের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেওয়া এবং ‘সরকার পরিবর্তন’ করা। তবে তারা কোনোটাই করতে পারেনি। এখানে রাজনৈতিকভাবে ‘দক্ষ কুশলী’র প্রমাণ দিয়েছে ইরান। ‘অপরাজেয়’ এ ইরান ভবিষ্যতে ইসরাইলের জন্যও ‘হুমকিস্বরূপ’। ইসরাইলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগডর লাইবারম্যান বলেছেন, ইরানকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করানো ছাড়া যুদ্ধবিরতিতে যাওয়া একটি মারাত্মক ভুল হয়েছে ইসরাইলের জন্য। এক্স হ্যান্ডলে তিনি লিখেছেন, ‘আঘাতপ্রাপ্ত সিংহকে ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু নেই।’ তিনি মনে করেন, ইরান যদি সামরিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত না হয়, তবে ভবিষ্যতে আরও বিপজ্জনক সংঘাত অনিবার্য।

ইরানকে পরাভূত করা কঠিন এ যুদ্ধে ইসরাইল সেটা ভালভাবেই উপলব্ধি করেছে। অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান দু’দেশের আক্রমণ সত্ত্বেও সে মোকাবেলা করেছে। ভবিষ্যতের যে কোন সংঘাতে ইরান যে সে প্রমাণ দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ইরানের এ মনোবল ও ফায়ার পাওয়ার বিশ্লেষকদের দৃষ্টি কেড়েছে। ইরান রণাঙ্গণ বন্ধের পর গাজায় হামলা জোরদার করেছে ইসরাইল। হয়তো সেখানেও একটা যুদ্ধ বিরতি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে রণসজ্জা করবে কিনা সেটা বিশ্লেষকদের কাছে একটা প্রশ্ন বটে।

ইরানের বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র তৈরির অভিযোগ বারবার এনেছে ইসরাইল ও পশ্চিমা দেশগুলো। তবে ইরান বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা দাবি করছে, পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ-ও জানিয়েছে, ইরান তাদের ইউরেনিয়ামের মজুদকে অস্ত্র নির্মাণে ব্যবহার করছে বা করতে চায়, এমন কোনো প্রমাণ তারা পাননি।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।