আসিফ আরসালান

ভারত গায়ের জোরে পাকিস্তানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এটি যে কোনো নিরপেক্ষ লোক বলবেন। কোনো মানুষ ভারত বা পাকিস্তানের নাগরিক না হয়ে যদি কোনো তৃতীয় দেশের নাগরিক হন তিনিও একথা বলবেন। কেনো এমন জোর দিয়ে একথা বলছি? কারণ গত ২২ এপ্রিল ভারতের দখলীকৃত কাশ্মীরের পহেলগামে ২৬ জন পর্যটককে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। কারা এসব সন্ত্রাসী? পাকিস্তানসহ সারা দুনিয়াজুড়ে কেউ বলতে পারলো না যে এরা কারা। কিন্তু ২৬ জন পর্যটক হত্যার এমন বিয়োগান্তক ঘটনার ২৪ ঘন্টাও পার হলো না। ভারত থেকে সরাসরি বলে দেওয়া হলো যে হয় পাকিস্তানীরা কাশ্মীরে ঢুকে এ কাজ করেছে; নাহয় পাক সমর্থিত জঙ্গীরা আজাদ কাশ্মীর বা পাকিস্তান থেকে এসে এ কাজ করেছে। পাকিস্তান দৃঢ়ভাবে ভারতের এ অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। পাকিস্তান ভারতকে বলে যে তারা প্রমাণ দেখাক যে ঐ বিয়োগান্তক ঘটনার পেছনে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ রয়েছে। যদি দেখাতে পারে তাহলে পাকিস্তান নিজেই সন্ত্রাসীদেরকে কঠোর শাস্তি দেবে। পাকিস্তান আরও বলে, প্রকৃত সন্ত্রাসীদেরকে চিহ্নিত করার জন্য একটি নিরপক্ষে তদন্ত অনুষ্ঠিত হোক। সে তদন্তে পাকিস্তান সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। কিন্তু ভারত তদন্ত, প্রমাণ অর্থাৎ যুক্তির পাশ দিয়েও গেলো না। একথা পাকিস্তান ২২ এপ্রিলের পর থেকে বলে আসছে। আর ঐ দিকে কোনোরকম যুক্তি-তর্ক, সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই ভারত অনবরত প্রচার করতে শুরু করে যে, পাকিস্তান এ সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ মর্মে হুমকি দেন যে, সন্ত্রাসীরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক তাদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে।

তখনই বিবেকবান মানুষ বুঝতে পেরেছিলেন যে, এ হত্যাকাণ্ড ভারতই তার গোয়েন্দা সংস্থা র’এর মাধ্যমে ঘটিয়েছে। এর সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য হলো দ্বিবিধ। প্রথমত, দেশে তার ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তা ফিরে পাওয়া। এটি তার দরকার। কারণ এবছরের শেষে বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হবে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, দিল্লীসহ আগামী বছর ১৫টি প্রদেশে (রাজ্য) বিধান সভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এসব নির্বাচন থেকে বোঝা যাবে আসলে জনগণ কোন দিকে হেলেছেন। যদি এগুলোর মধ্যে বড় বড় রাজ্য তথা উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যে বিজেপির পরাজয় ঘটে তাহলে সে পরাজয় ভারতের পরবর্তী লোকসভার নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে।

লোকসভার গত নির্বাচনে বিজেপি বড় আশা করেছিল যে তারা ৩০০ এর বেশি আসন পেয়ে অর্থাৎ দু’ তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে জয়লাভ করে ইচ্ছেমতো তাদের সংবিধান সংশোধন করবে। এখানে আরেকটি ফ্যাক্টর আছে। সেটি হলো, আগামী বছর বিজেপি এবং তার অঙ্গ সংগঠন সমূহের প্যারেন্ট সংগঠন আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ১০০ শত বছর পূর্তি হবে। এর আগেই তারা সারা ভারতকে আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী আদর্শের মোড়কে ঢেকে দিতে চায়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে নিজেক জাহির করা। নিজেকে এভাবে জাহির করতে পারলে দেশের অভ্যন্তরেও হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা প্রভাবিত হবে।

এ দ্বিবিধ উদ্দেশ্য সামনে নিয়েই ভারত এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায় এবং উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যেই বিনা তদন্তে পাকিস্তানকে দায়ী করে। কথায় বলে, এরাব Give the doga bad name and hang it অর্থাৎ কুকুরটার বদনাম করো এবং তাকে হত্যা করো। সুতরাং দেশি ও বিদেশি রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা পর্যবেক্ষকরা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন যে এবার সহসাই ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু করবে। ভারতের হম্বিতম্বি দেখে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন যে সর্বাত্মক যুদ্ধে না গেলেও ভারত এবার একটি বড় ধরনের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করবে। এ সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হবে ২০১৯ সালের কাশ্মীরের পুলওয়ামারের সাজিক্যাল স্ট্রাইকের চেয়েও বড়।

রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা শতকরা ১০০ শত ভাগ সত্যে পরিণত হয়। ৬ তারিখ দিবাগত রাত ১টা ৪০ মিনিটে ভারত পাকিস্তানে মিসাইল হামলা চালিয়ে বসে। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ বলেছেন যে, এ হামলায় ভারত ৮০টি জঙ্গী বিমান ব্যবহার করে। ৯টি লক্ষবস্তুকে টার্গেট করে ২৪টি মিসাইল ছোড়ে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো যে, এবার ভারতের মিসাইল হামলা আজাদ কাশ্মীরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা এবার পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানে। তারা পাঞ্জাবের বাহওয়ালপুর, শিয়ালকোট, সকরগড় এবং মুরিদে আঘাত হানে। এসবের মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত করে। এসব আঘাতের ফলে পাকিস্তান ও আজাদ কাশ্মীরের বেসামরিক নাগরিক, নারী ও শিশুসহ ৭০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। হামলার মাধ্যমে ভারত হানাদাররূপে চিহ্নিত হয়েছে। হানাদার বাহিনী বেছে বেছে ৩টি মসজিদে আঘাত হানে এবং মসজিদসমূহকে গুঁড়িয়ে দেয়। হামলার আগে তারা ১৯৬২ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে।

সিন্ধু নদের পানি চুক্তি স্থগিত করার মাধ্যমে ভারত বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘের গালে চপেটাঘাত করেছে। কারণ যে চুক্তি বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়েছে সে চুক্তি বিশ্বব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বাতিল বা স্থগিত করা যায় না। তারা ভারতের আকাশ সীমা দিয়ে পাকিস্তানের বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে তার আকাশ সীমায় ভারতীয় বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এছাড়া ১৯৭২ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত শিমলা চুক্তি বাতিল করে পাকিস্তান।

নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানকে অনেক দুর্বল ভেবে এ আক্রমণ করেছিলেন। ২০১৯ সালে পুলওয়ামার হামলায় ভারতের জঙ্গী বিমান মিগ-২৯ ভূপাতিত হয় এবং অভিনন্দন নামের বিমানের পাইলট পাকিস্তানের হাতে গ্রেফতার হন। এ বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে তিনি বলেন যে, মিগ-২৯ সেকেলে জঙ্গী বিমান। এমন ভেবে গত বছর তিনি ফ্রান্স থেকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন ৩৬ টি রাফাল বিমান ক্রয় করেন। তিনি বলেন যে, ২০১৯ সালে তার হাতে যদি রাফাল বিমান থাকতো তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো।

কিন্তু এবার কী হলো? ৩টি রাফাল বিমান, ১টি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন রুশ এসইউ-৩০, ১টি মিগ-২৯ এবং ১টি ড্রোন পাক বাহিনী ভূপাতিত করে। পাকিস্তানের ভূখণ্ডে আক্রমণ করার মাধ্যমে আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে ভারত বীরের বেশে আবির্ভূত হতে চেয়েছিলো। কিন্তু কেনো তার অস্ত্র ভাণ্ডারের প্রায় শ্রেষ্ঠ ৫টি অস্ত্র ধ্বংস হলো?

ভারত জানতো না যে, তারা যখন রাফাল কিনতে ব্যস্ত তখন পাকিস্তান নীরবে চীন থেকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন জঙ্গী বিমান জেএফ-১৭ থান্ডার জঙ্গী বিমান সংগ্রহ করেছে। পাকিস্তান চীন থেকে আরও সংগ্রহ করে জে-১০ জঙ্গী বিমান। বছর খানেক আগে থেকে চীন পাকিস্তান যৌথ প্রযোজনায় জেএফ-১৭ থান্ডার জঙ্গী বিমান পাকিস্তানেই নির্মিত হচ্ছে। রাফালে যুক্ত আছে মিটিওর নামের দূরপাল্লার এয়ার-টু- এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র। আর জে-১০ এর রয়েছে প্রায় সমান ক্ষমতা সম্পন্ন চীনা পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র।

২০১৯ সালে বিমান প্রতিরক্ষায় যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছিলো, তা মোকাবেলায় রুশ এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যুক্ত করেছে ভারত। অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে নিয়েছে এইচকিউ নাইন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটি রাশিয়ার এস-৩০০ প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি।

হানাদার ভারতীয় বাহিনী এ হামলায় সামরিক দিক দিয়ে যেমন কিছু অর্জন করতে পারেনি তেমনি কূটনৈতিক জগতেও সে পরাস্ত হয়েছে। তারা বড় বেশি ভরসা করেছিলো আমেরিকার ওপর। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সকলকে অবাক করে দিয়ে বলেছেন, যুদ্ধের বিস্তৃতি তার ভাষায় ‘লজ্জাজনক’। আমেরিকা, ইউরোপসহ সারা বিশ্ব ভারতের এ হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অবিলম্বে তারা উত্তেজনা প্রশমনের ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ড. শফিকুর রহমান পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের জন্য নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহবান জানিয়েছেন। এনসিপির প্রেসিডেন্ট নাহিদ ইসলাম বলেছেন, পাক ভারত উত্তেজনার মধ্যে ভারতে পলাতক হাজার হাজার আওয়ামী নেতা ও কর্মী এখন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়েছে। ৮ মে বৃহস্পতিবার ইংরেজি ডেইলি স্টারে তার এ বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। ঐ রিপোর্ট মোতাবেক সব পলাতক আওয়ামী লীগাররা নাশকতামূলক তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে এবং সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশকে অশান্ত করার চক্রান্ত করছে।

তুরস্ক চলমান সংকটে সরাসরি পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ সম্পর্কে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তুরস্ক বলেছে, আমরা বেসামরিক জনগণ ও অবকাঠামোর ওপর হামলাসহ এমন উসকানিমূলক পদক্ষেপের নিন্দা জানাই। একই সঙ্গে ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে তদন্তের আহবান জানানো পাকিস্তানের দাবির প্রতিও সমর্থন জানিয়েছে তুরস্ক।

গত ৮ এপ্রিল বাংলদেশের একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে যে রিপোর্ট করা হয়ছে তা নিম্নরূপ : সৈন্য ও বিমান সংখ্যা ছাড়া পাকিস্তানের জন্য একটি বড় ভরসার বিষয় হলো চীনসহ কয়েকটি মুসলিম দেশের তাৎক্ষণিক সমর্থন। ইতোমধ্যে তুরস্ক মিসাইল ড্রোনসহ বেশ কিছু বেসামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে পাঠিয়েছে। তাদের একটি অত্যাধুনিক যুদ্ধ জাহাজ করাচিতে অবস্থান নিয়েছে। চীন পাঠিয়েছে বিমানবিধ্বংসী পিএল-১৫ মিসাইল, যা ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া অন্যান্য সমরাস্ত্র ও লজিস্টিকস তো রয়েছেই। ভারত হামলা করার পর ইন্দোনেশিয়া ও আজারবাইজানও তাদের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। তারা প্রয়োজনে লজিস্টিকস দিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করবে।

জিও নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ভারত অব্যাহতভাবে উত্তেজনা বাড়াতে থাকলে এ সংঘাত পারমাণবিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে পুরো দায়ভার ভারতের ওপর বর্তাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এমতাবস্থায় পাকিস্তানে হামলা ভারতের জন্য দুঃস্বপ্ন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।

Email: [email protected]