এইচ এম জোবায়ের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্যানেলের ভূমিধস বিজয় শিক্ষাঙ্গনের ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্ররাজনীতি নানা অনিয়ম, সহিংসতা ও দলীয় আধিপত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। লেজুড়বৃত্তি এবং লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহারই যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এমন বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের আকাঙ্খা, স্বপ্ন এবং কল্যাণকে সামনে রেখে কাজ করা একটি সংগঠনের জয় শুধু রাজনৈতিক সাফল্য নয়- এটি ছাত্রসমাজের আস্থা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন। এ বিষয়ে আমরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সুনির্ধারিত কিছু বক্তব্য উপস্থাপনের চেষ্টা করবো।

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে ডাকসু এবং জাকসুর রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলন- সব জায়গাতেই ডাকসু ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী মঞ্চ। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, এমনকি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও ডাকসু নেতৃত্ব দিয়েছে। ডাকসুর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৩ সালে। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচন স্থগিত থেকেছে। সর্বশেষ ১৯৯০-এর পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়। অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ (জাকসু) প্রথম গঠিত হয় ১৯৭২ সালে। ৭২ সালেই জাকসু’র প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে-৭৩, ৭৪, ৮০, ৮১, ৮৯, ৯০, ৯১, ৯২ এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালে জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। ডাকসু’র মতো জাকসুর নির্বাচনও বারবার বন্ধ হয়ে গেছে সহিংসতা, প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে। দীর্ঘদিন পর এবার কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের সরব অংশগ্রহণ শিক্ষাঙ্গনে নতুন প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতি এক অনন্য গৌরবময় অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯), মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন (১৯৯০)- প্রতিটি পর্যায়ে ছাত্রসমাজ ছিল জনগণের অগ্রভাগে। তাদের আত্মত্যাগ, দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক শক্তি দেশের রাজনৈতিক গতিপথকে নির্ধারণ করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্বাপর কয়েক দশক যে ছাত্র রাজনীতি এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রাণ ছিল, সেটি আজ নানাবিধ কারণে তার গৌরব হারিয়ে বসেছে। ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ধারা যেসব কারণে বাঁধাগ্রস্থ হয় তা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি।

স্বাধীনতার পরপরই ছাত্র সংগঠনগুলো ক্রমে বড় রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৩ সালের পর থেকেই ছাত্র রাজনীতি মূলত জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নটি গৌণ হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনগুলো আর স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক থাকে না, বরং মূল রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যবহৃত হয়।

ষাট ও সত্তরের দশকে ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন মেধাবী, পড়াশোনায় অগ্রগামী ও নৈতিকভাবে শক্তিশালী শিক্ষার্থীরা। আজ সে জায়গা নিয়েছে অনিয়মিত, মেধাহীন ও সুযোগসন্ধানী শিক্ষার্থীরা। ফলে নেতৃত্বের মান কমে যায়, ছাত্র রাজনীতি হারায় তার প্রজ্ঞা ও ভবিষ্যৎদর্শিতা।

আশির দশক থেকে ছাত্র সংগঠনের একটি অংশ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। অনেক ছাত্র নেতাই মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়সহ নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। শিক্ষাঙ্গন শান্তির নীড় ও জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ হওয়ার বদলে সহিংসতার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়া, সশস্ত্র সংঘর্ষে শিক্ষার্থীর প্রাণহানি ও অস্ত্র প্রদর্শন ছাত্র রাজনীতির পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। এতে- শিক্ষিত ও ভদ্র পরিবারের সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা রাজনীতি থেকে বিমুখ হয়ে যায়।

একসময় ছাত্র রাজনীতি ছিল ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। কিন্তু আজ অনেক ক্ষেত্রে এটি ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মাধ্যম হয়ে পড়েছে। আদর্শিক রাজনীতির পরিবর্তে ব্যক্তি সংকীর্ণতা ও অর্থকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে। এর ফলে ছাত্র রাজনীতির মূল উদ্দেশ্যই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ছাত্র রাজনীতি নিজেকে গঠন করে দেশকে কনট্রিবিউট করার পরিবর্তে ‘পেশা’ হিসেবে বেছে নেন অধিকাংশ।

এসব নেতিবাচক বাস্তবতার কারণে ছাত্র সুস্থ রাজনীতিতে এক ধরণের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর ছাত্র আন্দোলন বড় ধরণের গণআন্দোলন আর সৃষ্টি করতে পারেনি। শিক্ষার্থীরা আজ রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। ফলে গৌরবময় অতীত আর বর্তমানের বাস্তবতার মধ্যে এক গভীর ব্যবধান তৈরি হয়েছে। যে ছাত্র সমাজ ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য জীবন দিল, যে ছাত্ররা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিল, যে ছাত্ররা ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনল- আজ তারা বিভক্ত, দুর্বল এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থাহীন। আর এ ভেক্যুয়াম পূরণে এগিয়ে এসেছে ইসলামী ছাত্র শিবির। টাইমলি প্ল্যানিং কন্সট্রাক্টিভ এজেন্ডা এবং প্রোপার ইম্পিমেন্টেশন স্ট্র্যাটিজি তাদেরকে শিক্ষার্থীদের কাছে আস্থাশীল হতে সহায়তা করেছে। ফলশ্রুতিতে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের পূনরুত্থান শুরু হয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বরের ডাকসু এবং এর ঠিক ২ দিন পরের জাকসু নির্বাচনে তারা ভূমিধস বিজয় পেয়েছে। এ বিশাল বিচয়ের কিছু নিরপেক্ষ পর্যালোচনা তুলে ধরছি।

ইসলামী ছাত্র শিবিরের নির্বাচনী সাফল্যের মূল কারণ তাদের শিক্ষার্থী-বন্ধব কর্মসূচি। ন্যায্য টিউশন ফি, মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণা সুবিধা, নিরাপদ আবাসন, মাদকমুক্ত ক্যাম্পাস, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা এবং সবার জন্য সমান সুযোগের প্রতিশ্রুতি শিক্ষার্থীদের মনে আস্থা জাগিয়েছে। শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, অতীতে নানা উদ্যোগের মাধ্যমে তারা ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচিকে বাস্তবসম্মত বলে গ্রহণ করেছেন। শিবির দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছে। সুখে-দুঃখে সহযোগিতা, নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক সহায়তা, মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা নিজেদের আলাদা পরিচিতি তৈরি করেছে। তাদের পরিশ্রম, সংগঠিত প্রচেষ্টা এবং শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষার্থীদের চোখে বিশ্বাসযোগ্যতা এনে দিয়েছে। বিশেষকরে ৩৬ জুলাই পরবর্তী তারা গ্রহণযোগ্যতায় নিকে নিজে ছাড়িয়ে যায়।

এবারের নির্বাচনে দেখা গেছে, শিবিরের প্রার্থীরা সময়কে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করেছে। প্রার্থীদের মাঠপর্যায়ের যোগাযোগ, নিয়মিত সংলাপ, সামাজিক মাধ্যমের কার্যকর ব্যবহার এবং শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পনা উপস্থাপন তাদের প্রচারণাকে সফল করেছে। সাফল্য পেতে তারা ‘পিডিসিএ মেথট’ (Plan, Do, Check, Act) অনুসরণ করেছে।

বর্তমান প্রজন্ম নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন, স্বচ্ছ নির্বাচন, সহিংসতামুক্ত পরিবেশ ও মেধাভিত্তিক সুস্থ রাজনীতি চর্চার অগ্রগতি চায়। শিবির তাদের কর্মসূচি ও নির্বাচনী আচরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এই আকাঙ্খাকে ধারণ করেছে। ফলে ভোটাররা অন্যদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে শিবিরকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

ডাকসু ও জাকসুতে ইসলামী ছাত্র শিবিরের জয় শুধু একটি সংগঠনের নয়; এটি ছাত্ররাজনীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত। শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছেন, তারা সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব ও অপসংস্কৃতির রাজনীতি আর চায় না। তারা এমন নেতৃত্ব চায়, যারা তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে সৎ, যোগ্য ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে।

ছাত্র রাজনীতিতে সুস্থ ধারার যে ভেক্যায়াম তা পূরণে প্রয়োজন হবে- একটি স্বাধীন, আদর্শিক ও শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন। মেধাবী ও সৎ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যদি নতুনভাবে ছাত্র রাজনীতি পুনর্গঠিত হয়, তবে হয়তো আবারও শিক্ষাঙ্গন ফিরে পাবে তার গৌরবময় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ভূমিধস বিজয় ছাত্রসমাজের সে আস্থার প্রতিফলন। তাদের শিক্ষার্থী-বন্ধব কর্মসূচি, সংগঠিত পরিশ্রম, সময় ব্যবহারের দক্ষতা ও শিক্ষার্থীদের আকাঙ্খা ধারণের ফলেই এ জয় সম্ভব হয়েছে। আর এ সাফল্য ছাত্ররাজনীতিতে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে- এমনটাই প্রত্যাশা দেশবাসীর।

লেখক : প্রাবন্ধিক।