প্রিন্সিপাল সাব্বির উদ্দিন আহমেদ
গত ৫৪ বছর ধরে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু আছে তা কোনো মানদণ্ডেই সঠিক ব্যবস্থা বলা যায় না। কেননা প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সৎ, নির্মোহ, দক্ষ, যোগ্য ও নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন লোকদের রাজনীতিতে আসার কোনো সুযোগ নেই। আর আসতে চাইলেও তাদেরকে নোংরা রাজনীতির (Foul politics) শিকার হয়ে চরম অপমানিত হয়ে বিদায় নিতে হবে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটাই বাস্তবতা।
আমাদের দেশে যে অপরাজনীতি (malign politics) স্বাধীনতার শুরু থেকে বিদ্যমান তা সত্যিকারার্থে জনকল্যাণ ও জাতিগঠনের জন্যে মোটেই উপযোগী নয়। কারণ, বিরাজমান রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা ব্যবস্থা সবচেয়ে অযোগ্য, অসৎ, দুর্নীতিবাজ, চাটুকার, কালো টাকার অধিকারী ও মাসলম্যান তৈরি করে। ফলে জাতি গত ৫৪ বছর ধরে সত্যিকারভাবে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি এবং কোনো কল্যাণ ও উন্নতি দেখতে পায়নি। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বেশকিছু লোক রাতারাতি বহু অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছে।
বর্তমানে রাজনীতি মানে টাকা ও অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ার আলাদিনের চেরাগ বা মেশিন পাওয়া। প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোনো নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। এতে সততার কোনো দাম নেই।
দেশপ্রেম, সততা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ইত্যাদি গুণগুলো মানতে গেলে বর্তমান চলে আসা রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাকে পশ্চাদপদ বলে সম্বোধন করবে এবং তাকে দূরে ঠেলে দিবে যেখান থেকে আর সে কোনো দিন ফিরতে পারবে না।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে মেধা ও যোগ্যতাকে কোনভাবেই মূল্যায়ন করা হয় না। এখানে চাটুকারিতা ও মোসাহেবিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। হক কিংবা ন্যায়নিষ্ঠ কথা বলা লোকদেরকে রাষ্ট্র দ্বারা তিরস্কার করা হয় এবং বিভিন্ন পদ-পদবি থেকে বঞ্চিত করে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কখনো কখনো তার উপর রাষ্ট্রের খড়গ ও হুলিয়া নেমে আসে এবং রাষ্ট্র ও দল দ্বারা চরমভাবে অপমানিত, নির্যাতিত ও অত্যাচারিত হতে হয়।
এ ধরনের অপরাজনীতি আমাদের দেশে বহু বছর যাবৎ চলে আসছে। ফলে নির্বাচনব্যবস্থা বলতে আমাদের দেশে কিছুই নেই। প্রকৃতঅর্থে গত তিনটি নির্বাচন কোন নির্বাচনই ছিল না।
তাছাড়া একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নির্বাচন মানে কালো টাকা ও পেশিশক্তির আস্ফালন। যে যত টাকা ও শক্তি প্রদর্শন করে কেন্দ্র দখল, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে কুক্ষিগত করতে পারবে সে নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারবে। যেহেতু সৎ, যোগ্য, আদর্শবান ও নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন লোকদের কোনো টাকাও নেই, আবার শক্তি প্রদর্শন করার সুযোগও নেই কিংবা সুযোগ থাকলেও তা সে করবেও না; কারণ এটা তার এথিক্সের পরিপন্থি। তাদের এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনীতি করা বা নির্বাচনে জেতার কোনো সুযোগও নেই। সুতরাং আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুর্বৃত্তায়নে নিমজ্জিত হয়ে আছে।
তাই ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে আমরা আজ একটি নতুন ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছি। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করাটা খুবই জরুরি। দলীয় সরকার আসলে এটা মোটেই সম্ভব নয়। কেননা যারা ক্ষমতায় বসবে তাদের চেহারা জাতি চিনে। তাদের দ্বারা সংস্কার সুসম্পন্ন করা মোটেই সম্ভবপর নয়। এমনটা আশা করাও বাতুলতা বৈ কিছু নয়।
আমরা আমাদের রাজনীতিবিদদের দীর্ঘ দিন থেকে দেখে আসছি তাদের স্বভাব-প্রকৃতি সবকিছুই আমাদের জানা আছে। তারা ক্ষমতা গিয়ে কী করবে বা তাদের দ্বারা জাতি আগামীতে নতুন বাংলাদেশ পাবে কিনা তা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ধরনের রাজনীতিবিদরা গত ৫৪ বছর ধরে লুটপাট, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের রাজনীতি জাতিকে উপহার দিয়েছে। সুতরাং তাদের থেকে জাতি কী-বা আশা করতে পারে?
আমরা মনে করি গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল-পরিবর্তন করা অবশ্যই এ মুহূর্তে জরুরি। নির্বাচনের আগেই মৌলিক সংস্কারকাজগুলো করে যেতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। কারোর দিকে না তাকিয়ে আপনারা দেশ ও জাতির দিকে তাকিয়ে, জুলাই বিপ্লবের শহীদদের আত্মদানের দিকে তাকিয়ে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারগুলো করে নির্বাচনের দিকে ধাবিত হন। আপনারা সব পক্ষ থেকে মতামত নেন। কারণ এটা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু যা করার আপনাদেরকে করতে হবে।
রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে অবশ্যই মেধা, যোগ্যতা, সততা, নীতি-নৈতিকতাকে নিয়ে আসতে হবে। তা নাহলে রাজনীতি কোনো দিনই পরিচ্ছন্ন হবে না। আর এ ধরনের লোকজন রাজনীতিতে না আসলে দেশ ও জাতির দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়ন করা যাবে না।
আমরা অন্তর্বর্তী সরকার থেকে মৌলিক সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেখতে চাই। যদি প্রয়োজন হলে আপনারা দেশের জনগণের ম্যান্ডেট নেয়ার জন্য গণভোট দিতে পারেন। আশা করি দেশের অধিকাংশ লোক সংস্কারের পক্ষে ম্যান্ডেট দিবে ইনশাআল্লাহ।
আমরা নতুন মানবিক বাংলাদেশ চাই। বিশ্বনন্দিত নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এই নতুন বাংলাদেশ উপহার দেয়ার কথা বারংবার বলছেন। জাতি তার কথার বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
আমি এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের ব্যাপারে এতো অস্থিরতা হওয়া মোটেই ঠিক হবে না। এতো বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তখন তারা কিভাবে সহ্য করতে পেরেছিল? এখন কেন তারা সহ্য করতে পারছে না? আর এ সরকার একটি বিশেষ অবস্থায় ক্ষমতা এসেছে। জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত দুঃখ-দুর্দশা মোচনের লক্ষ্যে শত শত শহীদের আত্মদানকে সার্থক করার জন্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে কাজ করতে হবে। সেজন্যে সরকারকে মৌলিক সংস্কারগুলো সমাপ্ত করে যেতে হবে।
তারপর নির্বাচনে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে। তা হচ্ছে প্রধান প্রধান সংস্কারকাজ শেষ না করা পর্যন্ত নির্বাচন নয়। এটি আগামী দিনে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য খুবই জরুরি। সবাইকে সম্মিলিতভাবে সরকারকে এই মুহূর্তে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়ে যাওয়া উচিত। তা নাহলে আমরা যে পরিবর্তনের কথা বলছি তা আদৌ সম্ভব হবে না। দেশ যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যাবে। এতো রক্ত এতো ত্যাগ-তিতিক্ষা সবই আগের মতো বিফলে যাবে।
পতিত স্বৈরাচার একটি বিদেশী শক্তির মদদে রাজনৈতিক দলগুলোতে তাদের চর ঢুকিয়ে সেই দলগুলোর শীর্ষ নেতাদেরকে বিভ্রান্ত করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে সরকারকে বাধ্য করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে। এই গভীর ষড়যন্ত্র আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝে তা মোকাবেলা করে নিজেদের মধ্যে ঐক্যমত তৈরি করতে হবে। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন কোনভাবেই সফল ও ফলপ্রসূ হবে না। লেখক : শিক্ষাবিদ।