ড. আবদুল আলীম তালুকদার

ইসলামি বর্ষপঞ্জি অনুসারে হিজরী বর্ষের প্রথম মাস মুর্হারম। এটি একটি অত্যন্ত বরকতময় ও ফযিলতপূর্ণ মাস। ‘মুর্হারম’ আরবি শব্দ যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ ইত্যাদি। প্রাচীনকাল থেকেই মুর্হারম মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। পবিত্র কুরআনুল কারিমে এ মাসকে ‘শাহ্রুল হারাম’ (সম্মানিত মাস) এবং ‘আরবাআতুন হুরুম’ অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর হাদিস শরিফে ‘শাহ্রুল্লাহ্ বা আল্লাহ্র মাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ মাসে ইবাদত-বন্দেগি, তাওবা-ইস্তিগফার, নফল রোযা পালনে বিশেষ ফযিলত রয়েছে।

মুর্হারম মাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ‘ইয়াওমে আশুরা’ তথা মুর্হারমের দশ তারিখ। ইসলামি পঞ্জিকা অনুযায়ী মুর্হারম এর দশম দিনকে আশুরা বলা হয়। হাদিসে আশুরার দিনের অনেক ফযিলত বিবৃত হয়েছে। এমনকি ইসলামপূর্ব আরব জাহেলি সমাজে এবং আহলে কিতাবÑ ইহুদি-নাসারাদের মাঝেও ছিল এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা।

ইসলামি ভাষ্য মতে, রমযান মাসের রোযা ফরয হওয়ার আগে এ মাসের ১০ তারিখে তথা পবিত্র আশুরার দিনে রোযা ফরয ছিল। পরে তা রহিত করে মাহে রমযানের রোযা ফরয করা হয়। ইমাম আবু জাফর তাবারি (রহ.) বলেন, ‘ইসলাম আগমনের আগেও জাহিলি যুগে এ ৪টি মাস (জি¦লকদ, জি¦লহজ, মুর্হারম ও রজব) নিষিদ্ধ ছিল। এ মাসগুলোকে তারা পবিত্র মনে করে সম্মান করত, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং ঝগড়া-ফ্যাসাদ থেকে নিজেদের বিরত রাখত।’ নবি করিম (স.) মুর্হারম মাসব্যাপী নফল ইবাদত, রোযা ও তাওবা-ইস্তিগফার করার প্রতি বিশেষ তাগিদ প্রদান করেছেন।

হযরত আবু বাকরাহ্ (রা.) নবি করিম (স.) থেকে বর্ণনা করেন, নবি করিম (স.) বলেছেন, ‘বছর হলো বারোটি মাসের সমষ্টি, তার মধ্যে ৪টি অতি সম্মানিত। ৩টি পর পর লাগোয়া জ্বিলকদ, জ্বিলহজ ও মুর্হারম আর (চতুর্থটি হলো) জমাদিউস সানি ও শা’বানের মধ্যবর্তী রজব।’ (সহিহ বুখারি: ২৯৫৮) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (স.) ইরশাদ করেন, ‘রমযানের পর সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে আল্লাহ্র মাস মুর্হারম (মাসের রোযা)। (সহিহ্ বুখারি: ১৯৮২, জামে তিরমিযি: ৭৩৮) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে, নবি (স.) ইরশাদ করেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে মুর্হারমের ৯ ও ১০ তারিখের অবশ্যই রোযা রাখব।’ (সহিহ্ মুসলিম ১/৩৫৯)

মুসলিম উম্মাহ্র জন্য এটি একটি তাৎপর্যময় ও গুরুত্ববহ দিন। মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিবছর পবিত্র আশুরা পালিত হয়। ৬৮০ খ্রি. মোতাবেক ৬১ হিজরির এ দিনে অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইসলামের শেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাতবরণ করেন। বিশ্বের মুসলমানদের কাছে দিনটি একদিকে যেমন শোকের, তেমনি হত্যা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার চেতনায় উজ্জ্বল।

ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁর আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ত্যাগের মহিমা মুসলিম উম্মাহ্র এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। যুলুম-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং অসত্য ও অন্যায় প্রতিরোধে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর এ ভূমিকায় মানবজীবনের জন্য বিরাট একটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে কারবালার এ শোকাবহ ঘটনার আগেও এ দিনে নানা তাৎপর্যময় ঘটনা ঘটেছে। পাষণ্ড ইয়াজিদ বাহিনীর সৈন্যদের হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার-পরিজন, সঙ্গি-সাথিসহ হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতবরণের এ মর্মান্তিক ঘটনা ছাড়াও এই দিনে পৃথিবীতে অনেক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে বলে হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে।

বর্ণিত আছেÑ ১. আল্লাহ্ তা‘আলা এ দিনে আকাশ-জমিন, পাহাড়-পর্বতসহ সমস্ত পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং সর্বপ্রথম বৃষ্টি ও আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হয়। ২. আদি মানব হযরত আদম (আ.)-কে এই দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ দিনেই তিনি পৃথিবীতে আগমন করেন, এ দিনই তাঁর তওবা কবুল করা হয় এবং এ দিনে তিনি স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর সাথে আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ লাভ করেন। ৩. হযরত ইউনুছ (আ.) এ দিনে ৪০ দিন পর মাছের পেট থেকে আল্লাহ্র রহমতে মুক্তি লাভ করেন। ৪. এ দিনই হযরত নূহ্ (আ.) এর নৌকা মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পেয়ে তুরস্কের জুদি নামক পর্বতে নোঙ্গর করে। ৫. হযরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর সেখান থেকে ১০ মুর্হারম মুক্তি লাভ করেন। ৬. দীর্ঘ ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগের পর হযরত আইয়ূব (আ.) দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করেন। ৭. হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হন এবং পরবর্তীতে দীর্ঘ ৪০ বছর পর ১০ মুর্হারম তারিখে পিতার সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন। ৮. হযরত ইদ্রিস (আ.) এ দিনে সশরীরে জান্নাতে প্রবেশ করেন। হযরত মূসা (আ.) এই দিনে তাওরাত কিতাব লাভ করেন, ফিরআউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং এই দিনে অভিশপ্ত ফিরআউনকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। ৯. হযরত দাউদ (আ.) আল্লাহ্র কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করেছিলেন এবং বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন এই দিনে। ১০. হযরত সুলায়মান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছিলেন এই দিনে। ১১. পবিত্র আশুরার দিনে ফিরআউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া শিশু মুসা (আ.)-কে গ্রহণ করেন। ১২. এই দিনে হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর জাতির লোকেরা তাঁকে হত্যা চেষ্টা করলে আল্লাহ্ পাক তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেন। ১৩. কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা.) পরিবার-পরিজনসহ শাহাদাত বরণ। এছাড়াও হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, মুর্হারম মাসের ১০ তারিখ আশুরার দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।

ইসলামের ইতিহাসে ১০ মুর্হারম তারিখটির নানা গুরুত্ব ও তাৎপর্য থাকলেও কারবালায় ঘটে যাওয়া সর্বশেষ মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণেই বর্তমান দুনিয়ার মুসলমানেরা দিনটি পালন করে থাকেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, হযরত আমিরে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াজিদ অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেন এবং এ জন্য ষড়যন্ত্র ও শক্তি ব্যবহারের পথ বেছে নেন। চক্রান্তের অংশ হিসেবে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) এর আরেক দৌহিত্র হযরত ইমাম হাসান (রা.) কে বিষপান করিয়ে হত্যা করা হয়। একই চক্রান্ত ও নিষ্ঠুরতার ধারাবাহিকতায় ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার-পরিজন ও ৭২ জন সঙ্গিসহ শাহাদাতবরণ করেন হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)। তাঁদের হত্যার ক্ষেত্রে যে নির্মম-নিষ্ঠুর পথ বেছে নেওয়া হয়েছে, ইতিহাসে এর নযির বিরল। অসহায় নারী ও শিশুদের পানি পর্যন্ত পান করতে দেয়নি ইয়াজিদ বাহিনী। বিষাক্ত তীরের আঘাতে নিজের কোলে থাকা শিশুপুত্র আলী আসগরের মৃত্যুর পর আহতবস্থায় অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে শহিদ হন হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)। আশুরার এ ঐতিহাসিক ঘটনার মূল চেতনা হচ্ছে ক্ষমতার লোভ, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য চক্রান্ত ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর উদ্দেশ্য ও আদর্শ বাস্তব জীবনে অনুসরণ করাই হবে এ ঘটনার সঠিক মর্ম অনুধাবনের বহিঃপ্রকাশ। অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপোষহীন অবস্থান ও ত্যাগের যে শিক্ষা কারবালা মানবজাতিকে দিয়েছে, তা আজকের দুনিয়ার অন্যায় ও অবিচার দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

আশুরার দিনে অনেক আম্বিয়ায়ে কিরাম আল্লাহ্ পাকের সাহায্য লাভ করেন এবং কঠিন বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি লাভ করেন। এই সাহায্যের শুকরিয়া হিসেবে নবি-রাসূলগণ এবং তাঁদের উম্মতগণ এ দিনে রোযা পালন করতেন। যেহেতু আশুরার দিনটি অত্যন্ত পবিত্র ও তাৎপর্যময় দিন। তাই এ দিনে উম্মতে মুহাম্মদী হিসেবে বিশেষ নেক আমল করা অত্যন্ত সাওয়াবের কাজ। মুর্হারম মাসে তথা মুর্হারমের ১০ তারিখে (পবিত্র আশুরার দিন) রোযা রাখা সম্পর্কে অনেক বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহ্র রাসূল (স.) মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে ইহুদিরা আশুরার দিনে রোযা রাখছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? তোমরা এ দিনে রোযা রাখো কেন? তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল্লাহ্ তায়ালা বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মুসা (আ.) শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোযা রাখতেন। আল্লাহ্র রাসূল বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মুসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে নিজেও রোযা রাখলেন এবং উম্মতদেরকে রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহিহ্ মুসলিম: ১১৩০, সহিহ্ বুখারি: ৩৯৪৩)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি (স.) ইরশাদ করেছেন, আশুরার দিনে পূর্বের নবী (আ.)গণ রোযা পালন করতেন, সুতরাং তোমরাও এদিনে রোযা পালন করো। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা)

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স.) আশুরা ও রমযানের রোযা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতেন, অন্য কোনো রোযা সম্পর্কে সেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন না। (সহিহ বুখারি: ২০০৬)

সাহাবায়ে কিরাম এ দিনে তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদেরকেও রোযা রাখতে অভ্যস্ত করতেন। বিখ্যাত সাহাবি হযরত রুবায়্যি বিনতে মুয়াবিয (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স.) আশুরার দিন সকালবেলা আনসারদের এলাকায় লোক মারফত এ সংবাদ পাঠালেনÑ যে আজ সকালে আহার করেছে সে যেন সারাদিন আর না খায়। আর যে সকালে খায়নি সে যেন রোযা পূর্ণ করে। ঐ নারী সাহাবি বলেন, এরপর থেকে আমরা নিজেরাও এ দিনে রোযা রাখতাম এবং আমাদের সন্তানদেরও রোযা রাখাতাম। তাদের জন্য আমরা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। তারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাদেরকে খেলনা দিয়ে শান্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত এ নিয়ে তাদের সময় কেটে যেত। (সহিহ্ মুসলিম: ১১৩৬, সহিহ্ বুখারি: ১৯৬০)

মাহে রমযানের রোযা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার রোযা ওয়াজিব ছিল। রমযানের রোযা ফরজ হওয়ার পর এ দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। হযরত আয়িশা (রা.) বলেন, (জাহেলি সমাজে) লোকেরা রমযানের রোযা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার দিন রোযা রাখত। এ দিন কাবায় গিলাফ জড়ানো হতো। এরপর যখন রমযানের রোযা ফরজ হলো তখন রাসূলুল্লাহ্ (স.) বললেন, যে এ দিন রোযা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক। (সহিহ্ বুখারি: ১৫৯০)

তবে নবি করিম (স.) ১০ মুহররমের সঙ্গে ৯ বা ১১ মুহররম আগেপিছে মিলিয়ে দু’টি রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) যখন আশুরার রোযা রাখছিলেন এবং অন্যদের রোযা রাখতে বলেছিলেন তখন সাহাবারা বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! এ দিনকে তো ইহুদি-নাসারারা সম্মান করে। তখন নবিজি এ কথা শুনে বললেন, ইনশাআল্লাহ্ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও রোযা রাখব। বর্ণনাকারী বললেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর ইন্তিকাল হয়ে যায়। (সহিহ্ মুসলিম: ১১৩৪)

পূর্বেকৃত গুনাহ্-অপরাধের জন্য কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহ্র নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা তথা তাওবা-ইস্তিগফার করা যে কোনো সময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। তবে মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য বিশেষ কিছু সময় ও মৌসুম দিয়েছেন যে সময় বান্দা অধিক ইবাদত ও ভালো কাজ করে সহজেই আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জন করতে পারে। বান্দার উচিত সে প্রত্যাশিত সময়গুলোর সঠিক মূল্যায়ণ করা। মুর্হারমের এ পুরো মাসটি, বিশেষ করে এ মাসের ১০ তারিখ এমনই এক বরকত ও পূণ্যময় দিন যেদিন তওবা কবুল হওয়া, নিরাপত্তা এবং অদৃশ্য সাহায্য লাভ করার কথাও রয়েছে। তাই এদিন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উচিত বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করে মহান আল্লাহ্র রহমত কামনা করা। এক সাহাবি নবিজি (স.) এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেনÑ ইয়া রাসূলাল্লাহ্! রমযানের পর আপনি কোন মাসে রোযা রাখতে বলেন? নবিজি বললেনÑ তুমি যদি রমযানের পর রোযা রাখতে চাও তাহলে মুর্হারমে রোযা রেখ। কেননা মুর্হারম হচ্ছে আল্লাহ্র মাস। এ মাসে এমন একদিন আছে, যেদিন আল্লাহ্ তা‘আলা (অতীতে) অনেকের তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তাওবা কবুল করবেন। (জামে তিরমিযি: ৭৪১)

ভারতীয় উপমহাদেশের সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুর্হারম মাস সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। যেমনÑ এ মাসে জমিতে হাল-চাষ না করা, মাটি না কাটা, বাঁশ-ঘাস-কাঠ ইত্যাদি না কাটা, বিয়েশাদি না করা, নতুন ও সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছেদ না পড়া, সাদা অথবা কালো কাপড় তথা শোকের পোশাক পরা, নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ না করা, গোশ্ত না খাওয়া ও নিরামিষ আহার করা, কোনো শুভ কাজ বা ভালো কাজের সূচনা না করা, সব ধরনের আনন্দ উৎসব পরিহার করা, কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে না যাওয়াÑ এগুলো সবই কুসংস্কার ও কুরআন-হাদিসের সাথে এসবের কিানো সংশ্লিষ্টতা নেই।

পরিশেষে বলা যায়, মুর্হারমের শিক্ষা হল অন্যায়-দূরাচারের বিরুদ্ধে আদর্শিক সংগ্রাম পরিচালনা করার শিক্ষা। যালিমের বিরুদ্ধে মায্লুমের অকুতোভয় লড়াইয়ের সাহস সঞ্চার করার শিক্ষা। তাই বিশ্ব মুসলিমের নিকট উদাত্ত আহ্বান আসুন এই পবিত্রতম দিনে ইবাদত-বন্দেগিতে মশ্গুল হয়ে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন করতে সচেষ্ট হই এবং ইমাম হুসাইন (রা.)-এর আদর্শকে বুকে ধারণ করে অন্যায়-যুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সহযোগী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর