DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

পতিতদের ইতিবৃত্ত ও ভবিষ্যৎ

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও ঐহিত্যবাহী রাজনৈতিক দল হিসাবে মনে করা হলেও নানাবিধ উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে দলটি এখন রীতিমত অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে ভবিষ্যৎ নিয়েও। স্বাধীনতার পর দলটি নিয়মিত বিরতিতে ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৮ সালে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী পন্থায় ক্ষমতায় থেকেছে।

Printed Edition

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও ঐহিত্যবাহী রাজনৈতিক দল হিসাবে মনে করা হলেও নানাবিধ উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে দলটি এখন রীতিমত অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে ভবিষ্যৎ নিয়েও। স্বাধীনতার পর দলটি নিয়মিত বিরতিতে ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৮ সালে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী পন্থায় ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু গণবিরোধিতা ও দলীয় নেত্রীর লাগামহীন বেফাঁস মন্তব্যের কারণে দলটি প্রায় গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। বিশেষ করে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার যুগপৎ বিপ্লবের ক্ষমতা হারানো এবং দলনেত্রী ভারতে পলায়নের পর দলটি ভবিষ্যৎ নেতিবাচক বৃত্তেই পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

কারণ, শীর্ষনেতা পলায়নের পর সে দলের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু অতি উচ্চাভিলাষীরা পতিতদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে স্বপ্নবিলাসে মত্ত হয়ে উঠেছে। পলাতক অবস্থায় দলীয় সভানেত্রীর হম্বিতম্বি সে কথার প্রমাণ বহন করে। পতন পরবর্তী তার কিছু কথায় মনে হচ্ছে, তিনি এখনো বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন এবং তিনি এখন অবকাশ কাটাচ্ছেন। অবকাশ শেষে তিনি আবারো ক্ষমতাগ্রহণ করে দ-মু-ের কর্তা ও সংহারী ভূমিকায় আবির্ভূত হবেন। যা তার কল্পনাবিলাস বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধামহল।

বস্তুত, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ বা ‘আওয়ামী লীগ’ স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭১-৭৫, ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২৪ সাল পর্যন্ত দেশের ক্ষমতাসীন দল ছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল হিসাবে দাবি করা হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে দলটিকে একাধিকবার স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী ও কর্তৃত্ববাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এসব অপবিশেষণের ক্ষেত্রটা নিজেরাই তৈরি করেছে। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় পৃথিবীর কোন স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদী শাসক স্থায়িত্ব পায়নি। জার্মানির এডলফ হিটলার ও রোমানিয়ার নিলোলাই চসেস্কুসহ বিশে^র অনেক স্বৈরশাসকই এর বাস্তব প্রমাণ। কিন্তু নব্য স্বৈরাচাররা তা থেকে মোটেই শিক্ষা গ্রহণ করেনি।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুনে পূর্বপাকিস্তান ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন হয়। পরবর্তীকালে এর নাম ছিল ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের অধিকতর প্রতিফলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে এর নামকরণ করা হয় ‘আওয়ামী লীগ’। এটিই ছিলো আওয়ামী লীগের প্রথম রাজনৈতিক বিচ্যুতি।

মূলত, গত বছর আগস্ট বিপ্লবের পর দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানাবিধ সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ানোর নানা ফন্দি-ফিকির শুরু করলেও বিষয়টির পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই। দেশের বুদ্ধিজীবীমহল ও সুশীল সমাজ এ বিষয়ে নানাবিধ বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের গণবিরোধিতা ও নির্মম গণহত্যার কারণে দেশে দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ এবং তাদের বিচারের পক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে অন্য একটি পক্ষ আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু কেউ কেউ বিষয়টিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তারা বলছেন, যারা গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ^াসী তারাই শুধু সে সুবিধা পাওয়ার হক্বদার। তাদের যুক্তি হলো, আওয়ামী কখনো গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ^াসী ছিলো না; তাদের শিরায়-উপশিরায় স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের রক্ত প্রবাহিত। তারা তাদের শাসনামলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। রাষ্ট্রের সকল গণতান্ত্রিক কাঠামোকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। তাই যারা নিজেরাই গণতন্ত্রে বিশ^াস করে না বরং সুযোগ পেলেই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থাকা কোনভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। তারা এমনও দাবি করছেন যে, মূলত আওয়ামী লীগ কোন রাজনৈতিক দলই নয়। তাই তাদের রাজনৈতিক অধিকার কোনভাবেই থাকতে পারে না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তাদের শাসনামল পর্যালোচনা করলে এসব দাবির সত্যতা ও যৌক্তিকতা মেলে।

এ বিষয়ে তারা গত বছরের জুলাই-আগস্টের ব্যাপক গণহত্যার কথাও বিবেচনায় নিচ্ছেন। সে সময় ছাত্র-জনতার যৌক্তিক ও নায্য আন্দোলন দমনের জন্য দেশে প্রায় ২ হাজার মানুষ নির্মম গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন। তাদের বেশিভাগেরই মৃত্যু হয়েছিলো রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাদের নির্দেশেই বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল মহলের গণহত্যা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। জোরালো দাবি উঠছে বিচারের।

শুধু তাই নয় বরং জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) তদন্ত প্রতিবেদনেও এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। আরো হাজার হাজার মানুষ গুরুতর আহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে। এছাড়া পুলিশ ও র‍্যাবের তথ্য অনুযায়ী ১১ হাজার ৭০০ জনকে তখন আটক করা হয়েছিল। যারা নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ শিশু। পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা শিশুরা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছে ও পঙ্গু হয়েছে।’ এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তখন পদ্ধতিগত ও সংগঠিতভাবে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অংশ হয়ে উঠেছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর আরো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরামর্শ দিয়েছে ওএইচসিএইচআর। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কার্যালয়ে এক সংবাদে সম্প্রতি এ রিপোর্ট প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণে ও এইচসিএইচআর বাংলাদেশে এসে ওই তদন্ত করেছিল।

এদিকে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের এ রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। যারা আইন ভঙ্গ করেছেন এবং মানুষের মানবিক ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করেছেন, তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, এ রিপোর্টে ইউনূস সরকারের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে। কারণ ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের কোনো পরিবেশই নেই। ‘তখন সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবেলা করে দেশ ও জনগণের জানমাল ও সম্পদ রক্ষার জন্য আইনি পন্থা অবলম্বন করে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সিনিয়র কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে রিপোর্টে মনগড়া তথ্য দেয়া হয়েছে। কারণ এখন কোনো কর্মকর্তার পক্ষে সরকারের বাইরে গিয়ে সত্যি তথ্য দেয়ার সুযোগ নেই,’ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন তিনি। কিন্তু আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের এসব কথা দেশের মানুষ কোনভাবেই কানে তুলছে না। কারণ, জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারের কোন ফরমায়েসী সংগঠন নয়। তাই তদন্তে তাদের প্রভাবিত হওয়ার দাবি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

যাহোক, আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মপক্ষ সমর্থন করে যত কথা বলুক না কেন ইতোমধ্যেই সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, এটা বিশ্বাস করার ভিত্তি আছে যে, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সাবেক সরকার এবং এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাঠামো, আওয়ামী লীগের সহিংস গোষ্ঠীগুলোর সাথে একত্রিত হয়ে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে পদ্ধতিগতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। এরমধ্যে রয়েছে কয়েকশ’ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে মারাত্মক শারীরিক নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ, ব্যাপকহারে নির্বিচারে গ্রেফতার, আটক ও নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন। এসব কারণে বিক্ষোভের সময় এমন যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলছে জাতিসঙ্ঘ। ওএইচসিএইচআর মনে করে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র অংশ এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতে, সমন্বয়ে ও নির্দেশনায় এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেসব বিষয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তি নিরাপত্তা, নির্যাতন ও বাজে আচরণ থেকে মুক্ত থাকার অধিকার, ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদার অধিকার, ন্যায়বিচারের অধিকার, ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়ার অধিকারের মতো বিষয়গুলো। ‘বিজিবি, র‍্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সরাসরি অপারেশন বিষয়ে আদেশ ও অন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যা তাদের বিক্ষোভকারী ও অন্য বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত করেছিল। এরমধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও নির্বিচারে গ্রেফতারের মতো ঘটনা ছিল।’ এদিকে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপিদের অস্ত্র সরবরাহের তথ্য এসেছে রিপোর্টে।

রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের পুলিশের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের ৯৫ জন সদস্যের নাম এবং তাদের ভূমিকা কী ছিল তার বিস্তারিত বিবরণ ওএইচসিএইচআরকে সরবরাহ করা হয়েছে। ‘পুলিশের মতে, এসব ব্যক্তিরাই বিক্ষোভের সময় সহিংস হামলায় ব্যবহারের জন্য নাগরিকদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। যাদের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ১০ জন তখনকার সংসদ সদস্য, ১৪ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ে নেতা, ১৬ জন যুবলীগ ও ১৬ জন ছাত্রলীগ নেতা এবং সাতজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন।’ রিপোর্টে বলা হয়, পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর দ্বারা শিশুরা টার্গেট কিলিং-এর শিকার হয়েছে। এছাড়া অমানবিক পরিবেশে আটক, নির্যাতন ও বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর আচরণের শিকার হয়েছে। নারী ও মেয়ে শিশুরাও নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলার শিকার হয়েছে বলে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশেষত শুরুর দিকে বিক্ষোভের সম্মুখসারিতে থাকা নারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মারাত্মকভাবে আক্রমণ করেছে। নারীরা যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। কয়েকটি ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে।’ এতে আরো বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য এবং ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হয়েছে যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি সম্প্রসারিত দল পুলিশের সাথে যৌথভাবে বা ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। তারা বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে ব্যাপকভাবে বেআইনি সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল। অভিযান শুরুর আগেই সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকরা পুলিশের সাথে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল অথবা পুলিশ ফোর্সের পেছনে থেকে আক্রমণে অংশ নিয়েছিল।’ এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা সম্পর্কে বলা হয়েছে এই রিপোর্টে।

এছাড়া পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও বিভিন্ন জায়গায় লোকজনকে থামিয়ে তল্লাশি চালিয়েছিল, বিক্ষোভকারীদের আটক করেছিল এবং সংগঠিত ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল। রিপোর্টে বলা হয়, আন্দোলনের সময় ডিজিএফআই, এনএসআই, এনটিএমসি, ডিবি, এসবি, সিটিটিসির মতো গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আন্দোলনকারীর সহিংস দমনে সরাসরি জড়িত থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।

‘গোয়েন্দা বাহিনীগুলো শিশুসহ নির্বিচারে আটক, গুম, নির্যাতন, তথ্য বের করা, স্বীকারোক্তি আদায়ের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত ছিল। আহতদের চিকিৎসা পেতে বাধা, হাসপাতালে কর্মরত এবং ভর্তি থাকা আহতদের ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমেও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গণমাধ্যমকে পুরো সত্য প্রকাশে বাধা দিয়েছে।’

১৮ জুলাই তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি কোর কমিটির সভা হয়। ওই সভায় পুলিশ, র‍্যাব এবং বিজিবি প্রধান ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এসব তথ্য দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, ‘ওই বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে বিজিবি কমান্ডারকে আরো দ্রুত প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন।’ প্রতিবেদনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্যকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে ‘এর পরদিন অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তখনকার প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ দমনের জন্য বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে বলেছিলেন এবং বিশেষভাবে বিক্ষোভের মূল হোতা, সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের গ্রেফতার, হত্যা ও হত্যার পর লাশ লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।’

প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘শেখ হাসিনার শাসনামলে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার খাতে ‘কাঠামোগত ঘাটতি’ তৈরি হয়েছে। ‘আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই, যেখানে সকল মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারে, এজন্য এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত সকলকে আহ্বান জানাই, আপনারা ন্যায়বিচার, আইন এবং বাংলাদেশের জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখুন। যারা আইন ভঙ্গ করেছেন এবং মানুষের মানবিক ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করেছেন তাদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসুন’।

আওয়ামী লীগের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় তারা কখনোই দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলো না বরং তারা সব সময় ছিলো স্বৈর ও ফ্যাসিবাদী মানসিকতায় বিশ^াসী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারা কমরেড সিরাজ শিকদারসহ ভিন্নমতের ৩০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করে দেশকে গুম-খুনের অভয়ারণে পরিণত করেছিলো। আওয়ামী সাংসদরা প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার শাহেদ আলীকে হাউজেই পিটিয়ে হত্যা করে জাতি হিসাবে আমাদেরকে রীতিমত কলঙ্কিত করেছিলো। তাই দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশালী শাসন এবং আইন করে গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ করেছিলো। তাই তারা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুবিধা পাবেন না বলেই মনে করেন বোদ্ধামহল বরং তাদের গণহত্যাসহ সকল প্রকার গণবিরোধী অপরাধের বিচার হওয়ায় যুক্তিযুক্ত ও বাঞ্ছনীয়।

ষড়যন্ত্র ও নাশকতার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করে নতুন করে ক্ষমতায় ফেরার দিবাস্বপ্নে বিভোর পতিত শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত, পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের নতুন করে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হওয়ার কোন রেকর্ড ইতিহাসে নেই বরং তাদের সব সময় ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। এডলফ হিটলার, নিকোলাই চসেস্কু, চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, ব্লাদ-৩, জার চতুর্থ, লিওপোল্ড দ্বিতীয় ও তালাত পাশার ইতিহাস ও পরিণতি সে কথায় স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই রাজনৈতিক বোদ্ধামহল মনে করে, আওয়ামী লীগ যত ষড়যন্ত্রই করুক না কেন তাদের ইতিবাচক কোন ভবিষ্যৎ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বরং ইতিহাসের পাতায় নিকৃষ্টতম ফ্যাসিবাদের চিহ্নিত থাকতে হবে। তাই পতিতদের ইতিবাচক কোন ভবিষ্যৎ নেই।