মুহাম্মদ ওয়াছিয়ার রহমান
গত ২ নবেম্বর সাংবাদিক ও রাজনীতিক আলহাজ্ব শামসুর রহমানের মৃত্যু বার্ষিকী। তিনি ২১ বৈশাখ ১৩২২ মঙ্গলবার ৪ঠা মে ১৯১৫ খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের মটবাটি গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯২২-২৩ সালে পাইকগাছা নিজ এলাকার তোকিয়া গোলাবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে শিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৪-২৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভোলানাথ মাইনর স্কুল বর্তমান সেটি ভোলানাথ সুখদা সুন্দরী মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে পরিচিত। যেখানে তিনি তৃতীয় শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। পরে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরে ১৯২৮ সালে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল থেকে এন্ট্রান্স প্রথম বিভাগে লেটারসহ কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ১৯৩২ সালে বাগেরহাট সরকারি পি.সি কলেজে ভর্তি হয়ে অসুস্থতার জন্য এক বছর পিছিয়ে ১৯৩৫ সালে প্রথম বিভাগে ডিসটিংশানসহ ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন।
১৯৩৪ সালে কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স ভর্তি হলেও অর্থের অভাবে তিনি অনার্স সম্পন্ন করতে পারেননি। পরে ১৯৩৯ সালে কোলতাকা ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্কুল জীবনে সমস্ত ক্লাসে তিনি সবসময় প্রথম স্থানে থাকতেন। কিন্তু অষ্টম শ্রেণীর সময় তার পিতা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকেন। সেজন্য পড়াশুনার বেশ ঘাটতি হল। তাই তিনি মাত্র ৩ নম্বর কম পেয়ে তাকে ২য় হতে হলেন। পরের বছর ৭৯ নম্বর বেশি পেয়ে তিনি আবার প্রথম হলেন।
মরহুম শামসুর রহমান ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা থানার এক পল্লী এলাকায় নতুন প্রতিষ্ঠিত হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে চাকরি শুরু করে দু’বছরের কম সময় সেখানে কাজ করেন। ১৯৪১ সালেই তিনি খুলনা শহরের সরকারি করোনেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে অবৈতনিক ইংরেজী শিক্ষক হিসাবে অল্প কয়েক দিন কাজ করেন। ১৯৪১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীন কৃষি পরিদপ্তরের অধীন সরকারি চাকরি করেন। তিনি ১৯৫০ সালেই খুলনা শহরে থানার মোড়ে মুসলিম আর্ট প্রেসের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন। এ অফিসে বসে তিনিই এই শহরে প্রথম ইসলামী সাহিত্য বিক্রয় করতেন।
সরকারি চাকরির ফাঁকে তিনি ১৯৫০ সালের ৮ জুন তিনি নিজ উদ্যোগে খুলনা থেকে ‘সাপ্তাহিক তাওহীদ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৫৯-৬৪ পর্যন্ত ডৈইলী আবজারভার ও পাকিস্তান এ্যাসোসিয়েটড প্রেসের সাথে কাজ করেন। তখনও খুলনা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা হয়নি। ১৯৫৯ সালে তিনি খুলনা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। শামসুর রহমান ওই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং জহুরুল হক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন।
আলহাজ¦ শামসুর রহমান চল্লিশের দশকের শেষ দিকে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫২ সালে তিনি জামায়াতের সহযোগী সদস্য (মুত্তাফিক) হন। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ সালে তিনি জামায়াতের রুকন হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন আমৃত্যু এ শপথের উপর অবিচল ছিলেন। তখন থেকে খুলনা জেলা শাখায় এমারত কায়েম হয় এবং তিনি প্রতিষ্ঠাতা জেলা আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। জামায়াতে যোগদান করায় তাকে বহু জুলুম নির্যাতন ভোগ ও কারাবরণ করতে হয়েছে। কিন্তু কোন বাঁধাই এই মহান পুরুষকে বিচ্যুৎ করতে পারেননি।
১৯৫৫-৬৮ পর্যন্ত শামসুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের খুলনা জেলা আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তিনি কিছু দিন খুলনা (বরিশাল বিভাগসহ) বিভাগীয় সেক্রেটারি এবং ১৯৬৮-৭১ পর্যন্ত তিনি খুলনা বিভাগীয় (বর্তমান খুলনা ও বরিশাল বিভাগ) আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সম্মেলনের জন্য গঠিত গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সাব-কমিটির শামসুর রহমান আহবায়ক ছিলেন। তিন বছর তিনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারী জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। ১৯৮৩-২০০৩ পর্যন্ত তিনি জামায়াতের নায়েবে আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
২৮ মার্চ ১৯৬২ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। এ আসন ছিল পাইকগাছা (বর্তমান কয়রাসহ)-দেবহাটা-কালীগঞ্জ-আশাশুনী-শ্যামনগর নিয়ে পাঁচ থানার (বর্তমান ছয় থানা) বিশাল এলাকা। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য হয়ে পরিষদে বক্তব্য রাখতে গিয়ে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক তৈরী করার প্রস্তাব দেন। যা এখন খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক নামে পরিচিত। স্থানীয় লোকদের দাবী সড়কটি শামসুর রহমান সড়ক নাম করণ করা হোক।
শামসুর রহমান ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাইকগাছা-কয়রা আসেনে জামায়াতের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ অনুষ্ঠিত পঞ্চম বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-২ আসন থেকে জামায়াতের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করে বিপুল পরিমান ভোট পান।
১৯৪০ সালে অবিভক্ত বাংলায় রিলিফ কমিটির তিনি সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি খুলনা টাউন মসজিদ, খুলনা আলিয়া মাদ্রাসা, নিজ এলাকায় বোয়ালিয়া সরকারী বীজ উৎপাদন খামার, পাইকগাছা সরকারী স্কুল, কলেজ, তোকিয়া গোলাবাটী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মঠবাটী দাখিল মাদ্রাসা, আল হেরা জামে মসজিদ, সিরাতুল হুদা ইয়াতিম খানা ও চিকিৎসা কেন্দ্রসহ সারা দেশে অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তিনি নিজ উদ্যোগে পাইকগাছায় সিরাতুল হুদা নামক সমাজ সেবা মূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন এবং তার চেয়ারম্যান হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১-২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা মুসলিম এইড বাংলাদেশ শাখার দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান ও পরে উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। মানুষের কল্যাণে তিনি সিরাতুল হুদা ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। আলহাজ¦ শামসুর রহমান ১৯৭৪ সালে প্রথম এবং ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় বার রাজকিয় মেহমান হিসেবে পবিত্র হজ¦ পালন করেন। ১৯৯৫ ও ১৯৯৭ সালে রাজকীয় মেহমান হিসেবে ওমরা পালন করেন। এ ছাড়া তিনি পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্য সফর করেন।
তার লেখা প্রকাশিত বই ‘মানবজীবনের মূলমন্ত্র’। তার লেখা অন্য বই ‘জীবন ও কর্ম’ এখনও প্রকাশিত হয়নি তবে প্রকাশনার পথে। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ পাবলিকেসন্স লিঃ-এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। যে সংস্থার মাধ্যমে বহুল প্রচারিত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা প্রকাশ হয়। আর প্রকাশনীসংস্থা আধুনিক প্রকাশনীর মূল মালিক বাংলাদেশ ইসলামিক ইনস্টিটিউটের তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন।
জননেতা শামসুর রহমানকে ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ মুজিব সরকার কারাবদ্ধ করে এবং ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ তিনি কারামুক্তি লাভ করেন। আবার ২৩ এপ্রিল ১৯৮৫ সালে বায়তুল মোকাররমে এরশাদ বিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দেন এবং সেখান থেকে গ্রেফতার হন এবং ৮ অক্টোবর ১৯৮৫ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। তিনি মোট ২ বছর ২ মাস ১৩ দিন কারাবরণ করেন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ায় সরকার বিরোধী রাজেৈনতিক নেতাদের নামে দায়ের করা দালাল আইনের মামলায় ১৯৭৩ সালে বেকসুর খালাশ পান শামসুর রহমান। বাংলাদেশে জামায়াত নেতাদের মধ্যে যারা বেকসুর খালাশ পান তিনি তার মধ্যে অন্যতম। ২ নবেম্বর ২০০৮ সালে প্রকৃত বয়স অনুসারে তিনি ৯৩ বছর ৫ মাস ২৯ দিনের এই দুনিয়া সফর শেষ করে মহান আল্লাহর কাছে ফিরে যান। তার গ্রামের বাড়ি পাইকগাছার গদাইপুর ইউনিয়নের মটবাটিতে তাকে সমাহিত করা হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক।