গত ২ জুন আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২০২৬) জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রস্তাবিত বাজেট জনসম্মুখে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটা ছিল বাংলাদেশের ৫৪তম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় বাজেট। ১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরে প্রথম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছিল, যাতে আয় এবং ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছিল যথাক্রমে ২৮৫ দশমিক ৩৮ কোটি টাকা ও ২১৮ দশমিক ৪৩ কোটি টাকা। বর্তমান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এটাই প্রথম জাতীয় বাজেট। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিপর্যস্ত প্রায় অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে সঠিক পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। এর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং নিম্ন প্রবৃদ্ধি অন্যতম ইত্যাদি সমস্যা কিভাবে নিরসন করা হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল উদ্বিগ্ন। জনতুষ্টির বাজেটের পরিবর্তে কিভাবে জনকল্যাণমূলক বাজেট প্রণয়ন করা যায় সেটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বিগত সরকার নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ এনে তা লুটপাট করেছে। বিগত সরকার আমলে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশ থেকে মোট ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। অর্থ পাচারের এ পরিমাণ আসলে আরো অনেক বেশি। বিগত সরকার আমলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, জিডিপির আকার ইত্যাদি তথ্য অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে জাতির সঙ্গে কার্যত প্রতারণা করা হয়েছে। এমননি এক অবস্থায় ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে জাতীয় বাজেট প্রণীত হতে যাচ্ছে। তাই সংশ্লিষ্ট মহলে বাজেট নিয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাজেট প্রণয়ন করা সব সময়ই বিশেষ চ্যালেঞ্জিং। অর্থ ব্যয় এবং অর্থ সংগ্রহ এ দু’য়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা খুবই কঠিন কাজ। সাধারণত তিন ধরনের বাজেট প্রত্যক্ষ করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক বাজেট, ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের বাজেট এবং রাষ্ট্রীয় বাজেট। প্রতি ক্ষেত্রেই বাজেটের উদ্দেশ্য থাকে একটি নির্দিষ্ট বছরের আয়-ব্যয়ের সম্ভাব্য খতিয়ান প্রণয়ন করা। কিভাবে অর্থ উপার্জন করা হবে এবং কোন্ কোন্ খাতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হবে তা বাজেটের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের বাজেটের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাজেটের একটি ক্ষেত্রে বিশেষ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের বাজেট নির্ধারণ করা হয় আয়ের উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ কী পরিমাণ আয় করা সম্ভব হবে তার নিরিখে ব্যয়ের খাত এবং পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। কারণ ব্যক্তি চাইলেই তার আয় বাড়াতে পারে না। তাই তাকে আয় বুঝে ব্যয় করতে হয়। আর রাষ্ট্রীয় বাজেটে ব্যয়ের খাত বিবেচনায় আয়ের উৎস এবং পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। রাষ্ট্র চাইলেই তার আয় বাড়াতে পারে। যদিও এতে জনগণের উপর চাপ বাড়তে পারে। অথবা বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করেও রাষ্ট্র তার ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে পারে। তবে জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় রাষ্ট্র সব সময়ই চেষ্টা করে কিভাবে জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি না করেও তার আর্থিক চাহিদা পূরণ করতে পারে।

অন্তর্বর্তীকালীন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়। রাজনৈতিক সরকার দায়িত্বে থাকলে স্থানীয় নেতাদের চাহিদা মতো অনেক সময় তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পেও অর্থ বরাদ্দ করতে হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সে রকম কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না বলে তারা চেষ্টা করলে জাতির জন্য সর্বোত্তম কল্যাণকর খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটে আমরা কিছু বিষয় প্রত্যক্ষ করছি যা ইতিবাচক। অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ ব্যয় কমানোর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। আগের যে কোনো বছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেট অনেকটাই বাস্তবসম্মত। তবে বাজেটে যে সব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা কতটা অর্জিত হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য বাস্তবায়নাধীন বাজেটের আকার ছিল ৭ লাথ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে বাজেটের আকার আট হাজার কোটি টাকা হ্রাস পাবে। আগামী অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে চলতি অর্থ বছরের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নতুন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা হবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছরের বাজেটে মেগা প্রকল্পে নতুন করে কোনো ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয়নি। আগামী অর্থবছর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়। চলতি অর্থ বছরে কৃষি খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে তা ২০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হবে। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার প্রসঙ্গটি। অর্থবছর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব হবে? গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এ সময় প্রায়শই সাড়ে ৯ শতাংশের উপরে ছিল। চলতি অর্থবছরের পুরোটা জুড়েই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত বছর জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সে সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ৯ মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে এপ্রিল মাসে ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। মে মাসে মূল্যস্ফীতি আরো কিছুটা কমে ৯ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশে নিয়ে আসা কি সম্ভব হবে? ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের আশেপাশে থাকতে পারে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি। বাজেট বা মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। এর জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। পরিবহনকালে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পণ্য উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে শিল্পের বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হবে। এতে শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে অবস্থায় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বর্ধিতকরণ কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। জাপানের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও যেখানে ৩৪ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে সাড়ে ৭ শতাংশ। কয়েক বছর আগেও ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ১০ শতাংশের উপরে ছিল। চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মারাত্মক দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা ব্যয়ের ক্ষেত্রে কিভাবে অগ্রগতি সাধিত হবে তা বলা হয়নি।

শিল্পখাতে ভর্তুকি এবং প্রণোদনা কমানো হয়েছে। এতে বিকাশমান শিল্প খাতের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। চলতি অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপি’র ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু এটা যে অর্জনযোগ্য নয় তা কি নীতি নির্ধারকগণ বুঝতে পারছেন না? বাংলাদেশের অর্থনীতির যে গতি-প্রকৃতি তাতে উন্নয়ন কার্যক্রমকে টেকসই ও বাস্তবসম্মত করতে হলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ জিডিপি’র অন্তত ৪০ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। কিন্তু দেশে যে বিনিয়োগ পরিবেশ বিরাজমান তাতে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। বর্তমানে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচক প্রকাশ বন্ধ রয়েছে। তার পরিবর্তে স্টার্ট বিজনেস নমে একটি নতুন সূচক প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে চতুর্থ সারিতে। এ রকম বিনিয়োগ পরিবেশে কোনোভাবেই প্রত্যাশিত মাত্রায় বিনিয়োগ আশা করা যায় না।

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বন্যা এবং শুস্ক মৌসুমের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন ছিল। কারণ আগামীতে উজান থেকে হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে বন্যায় ভাসিয়ে দেবার চেষ্টা করা হতে পারে। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে আমাদের পানির সঙ্কটে ফেলা হতে পারে।

দেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তিকরণের জন্য কর হার পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর হারের ব্যবধান বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে লিস্টেড এবং নন-লিস্টেড কোম্পানির কর হারের ব্যবধান হচ্ছে ৫ শতাংশ। আগামী বছর তা সাড়ে ৭ শতাংশ হবে। বর্তমানে বিদ্যমান কর হার মোতাবেক পুঁজি বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ২০ শতাংশ হারে করপোরেট ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। তবে এ কর ছাড় সুবিধা পাবার জন্য বেশ কিছু কঠিন শর্ত পালন করতে হয়,যা অধিকাংশ কোম্পানির পক্ষেই সম্ভব হয় না। ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে করপোরেট ট্যাক্স প্রদান করতে হচ্ছে। নন-লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স ২৫ শতাংশ হলেও শর্ত পালনে ব্যর্থতার জন্য অধিকাংশ কোম্পানিকে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে করপোরেট ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রণীত বাজেটে নন-লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স হার ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। আর লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স ২০ শতাংশই রাখা হয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির মালিকগণকে যাতে ২০ শতাংশের বেশি করপোরেট ট্যাক্স প্রদান করতে না হয় সে জন্য আরোপিত শর্তে কিছু ছাড় দেয়া হয়েছে। এতদিন তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ২০ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স সুবিধা পাবার জন্য তাদের সমুদয় আয়-ব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে করতে হতো। এ শর্ত পরিপালন করা অনেক কোম্পানির পক্ষেই সম্ভব হচ্ছিল না। প্রস্তাবিত বাজেটে শুধু কোম্পানির আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে করার শর্ত থাকবে। অন্য আর্থিক লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে করার শর্ত পরিহার করা হয়েছে। এই উদ্যোগ স্বল্প মেয়াদে পুঁজিবাজার উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। যেসব কোম্পানি এখনো পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত হয়নি তারা তালিকাভুক্তির জন্য আগ্রহী হতে পারে। তবে পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য শুধু এই একটি মাত্র পদক্ষেপ কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয় না। সমস্যাগ্রস্থ পুঁজি বাজারের উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। একটি চিহ্নিত মহল পুঁজিবাজারে নানা ধরনের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে অনেক দিন ধরেই। তাদের পুঁজি বাজার থেকে বের করে দিতে না পারলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। ১৯৯৬ এবং ২০২০ সালে যারা পুঁজি বাজার ধ্বসের জন্য দায়ি বলে মনে করা হয় তাদের কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। এখনো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা পুঁজি বাজারে বিনিয়োগের প্রসঙ্গ উঠলেই আতকে উঠেন। মনে পড়ে যায় কিভাবে গুজব সৃষ্টি করে লাখ লাখ মানুষের পুঁজি কেড়ে নেয়া হয়েছিল। পুঁজি বাজার কেলেঙ্কারির জন্য যার নাম সবার আগে উচ্চারিত হয় সেই ব্যক্তিটি সরকারের উপদেষ্টা পর্যন্ত হয়েছিলেন।

বাজেটে প্রসঙ্গ এলেই দেশের অর্থনৈতিক চিত্র সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বিগত সাড়ে ১৫ বছরের স্বেচ্ছাচারি শাসনামলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যার জের এখনো আমরা বয়ে চলেছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা যে পদ্ধতির সরকারই দায়িত্ব পালন করুক না কেনো রাতারাতি অর্থনীতিকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। দেশে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পােেচ্ছ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ দশমিক ৫০ লাখ। গত ডিসেম্বরে তা ২৭ লাখে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বেকারের হার বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অবশ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে পদ্ধতিতে বেকারের সংখ্যা নির্ধারণ করে তার যৌক্তিকতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। জুলাই-এপ্রিল,২০২৩-২০২৪ এ রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬৬১ কোটি মার্কিন ডলার,যা জুলাই-এপ্রিল,২০২৪-২০২৫ এর এসে ৪ হাজার ২১ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৯ দশমিক৮৪ শতাংশ। একই সময়ে প্রবাসী আয় ১ হাজার ৯১২ কোটি মার্কিন ডলার থেকে ২হাজার ৪৫৪ কোটি মার্কিন ডলারের উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ২৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকার স্থলে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৮৯ কোটি টাকা। প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট-জিডিপি রেশিও ছিল ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ১৮ শতাংশ, যা বর্তমানে ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা বিগত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ।

অর্থনীতির অধিকাংশ সূচকই নিম্নমুখী রয়েছে। এই অবস্থায় যে বাজেট প্রস্তাবনা করা হয়েছে তা উদ্দেশ্য সাধনে কতটা সক্ষম হবে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বাজেটে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্ববিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

লেখক : ব্যাংকার।