প্রজ্ঞা দাস
বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চ যেন আজ এক উত্তপ্ত রণাঙ্গন। দেশে দেশে রক্তক্ষয়ী সংঘাত নৈরাজ্য, জাতিগত বিদ্বেষের ভয়াল আগুন, জাতিসংঘের বিবৃতির অসহায় শব্দমালা, এবং মানবতার চিরচেনা অসহায়ত্ব। বিশ্ব ট্রেন নীরবে প্রস্তুতি নিচ্ছে এক অনিবার্য বিপর্যয়ের জন্য, যার নাম তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, গাজা ও ইসরাইলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, তাইওয়ান প্রণালীর সামরিক উত্তেজনা, এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে ক্রমবর্ধমান সংঘাত বিশ্বকে এক অচিন্তনীয় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনও অব্যাহত আছে। পশ্চিমা শক্তি ও ন্যাটো জোটের সরাসরি অস্ত্র সমর্থন পরিস্থিতিকে ক্রমশ আরও জটিল করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর রুশবিরোধী পদক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে চীন ও ইরানের আরও কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে, যা বৈশ্বিক মেরুকরণকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এখন পর্যন্ত এ যুদ্ধে লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। এ যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনের শহরগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেনি; বরং বিশ্ব অর্থনীতিতেও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
তবে ইউক্রেনই একমাত্র রক্তক্ষয়ী মঞ্চ নয়। মধ্যপ্রাচ্যের ইসরাইলল-গাজা যুদ্ধ আবারও নতুনভাবে ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছে। এ সংঘাত মানবতার মর্মান্তিক পরাজয়ের প্রতীক। ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ গাজাকে একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। হাজার হাজার নিরীহ মানুষ, যাদের অধিকাংশই নারী এবং শিশু এ সংঘাতে নিহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের সাথে আমেরিকা ও তার মিত্রদের সংঘর্ষ লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলকে ব্যাহত করেছে। এ অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা বিশ্ব বাণিজ্য এবং শান্তির উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। এখানেই শেষ নয়, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তাইওয়ান প্রণালীতে সামরিক মহড়া বিশ্বকে একটি সম্ভাব্য সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। চীন তাইওয়ানকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাবি করে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী ভূমিকা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সীমান্ত বিরোধ এ অঞ্চলকে একটি ফ্ল্যাশপয়েন্টে রূপান্তরিত করেছে। যদি চীন তাইওয়ানের উপর সামরিক আক্রমণ চালায়, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নীরব থাকবে না। যা একটি পারমাণবিক সংঘাতের দিকেও নিয়ে ােতে পারে। দক্ষিণ এশিয়াও এ সংঘাত-উত্তেজনা থেকে রেহাই পায়নি। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর কেন্দ্রিক উত্তেজনা ২০২৫ সালে নতুন মাত্রা পেয়েছে। সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষ এবং পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর দু’দেশের মধ্যে সীমিত পরিসরে যুদ্ধ হয়ে গেছে। উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং যেকোনো ভুল পদক্ষেপ এ অঞ্চলকে একটি বিধ্বংসী যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ দেশটিকে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিয়ে গেছে। আরাকান আর্মির সাথে সামরিক জান্তার সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এ অস্থিতিশীলতা প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করছে। বিশ্বে প্রায় ১৩,০০০ পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, ও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, এবং ইসরাইললের হাতে কেন্দ্রীভূত। ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষা ও হিরোশিমার বোমার চেয়ে আটগুণ শক্তিশালী ছিল। তা বিশ্বকে পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাক্সক্ষা এবং রাশিয়ার পুতিনের হুমকি বিশ্বকে একটি পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। একটি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু, পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি, এবং বিশ্ব অর্থনীতির পতন ডেকে আনবে। ইন্টারনাল সিপ্লেস মনিটরিং সেন্টারের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে বিশ্বে ৭ কোটি ৫৯ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছে। গাজা, সুদান, এবং ইউক্রেনের সংঘাত এ সংখ্যাকে আরও বাড়িয়েছে। যুদ্ধের কারণে খাদ্য ও জ্বালানির দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে। লোহিত সাগরে হুতি আক্রমণের কারণে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়েছে। ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশ খাদ্য সংকটের মুখে পড়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রতিক সংঘাতের টানা পোড়েনে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং মায়ানমার অভ্যন্তরীণভাবে অস্থিতিশীল হয়েছে এবং দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় বিশ্বকে একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্ব আজ একটি বিপজ্জনক মোড়ে দাঁড়িয়ে। বুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্বকে দুই ভাগে বিভক্ত করছে। ন্যাটো এবং চীন-রাশিয়া জোটের মধ্যে সংঘাত একটি বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের আগমনী বার্তা। মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, এবং ইউরোপের আঞ্চলিক সংঘাতগুলো আর স্থানীয় নেই বরং বড় শক্তিগুলোর সরাসরি বা পরোক্ষ জড়িত থাকার কারণে সংঘাতগুলো বিশ্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক মাত্রা নিচ্ছে। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং উদ্বাস্তু সংকট দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনাকে আরও তীব্র করছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আশার আলোও নিতে চায়নি। মানবসভ্যতার ইতিহাস বলে, সংকট এত গভীর হয়েছে, মানুষ ততই বিকল্প পথ খুঁজে বের করেছে। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে রুখতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে নতুন করে সংলাপ ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সকল দেশকে বাধ্য করতে হবে। জাতিসংঘ ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় সামাজিক বৈষম্য, ধর্মান্ধতা ও জাতিগত বিভাজন রুখতে শিক্ষার বিস্তার ও সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মকে সংঘাত নয়, শান্তির বার্তা শোনাতে হবে। কারণ, তারাই ভবিষ্যতের চালক। গাজার ধ্বংসস্তূপ, ইউক্রেনের রক্তাক্ত মাটি, এবং তাইওয়ান প্রণালীর উত্তপ্ত সামরিক মহড়া বিশ্বকে সতর্ক করছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখন আর কল্পনা নয়; প্রবল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ব এমন এক মুহূর্তে পৌঁছেছে, যেখানে একটি ভুল পদক্ষেপ সভ্যতার সমাপ্তি ডেকে আনবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। প্রতিটি দেশ, প্রতিটি সম্প্রদায় এবং প্রতিটি মানুষের ঐক্য এখন মানবতার একমাত্র আশা। এমতাবস্থায় এ মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ না হলে, মানবজাতি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হবে। যার পরিণতি হবে মৃত্যু, বিপর্যয় এবং ধ্বংস।
লেখক : শিক্ষার্থী ইডেন মহিলা কলেজ।