মো: আব্দুল্লাহ আল মুনাইম
মৃত্যু এমন এক সত্য যা আমরা সবাই জানি। কখন কার কোথায় কিভাবে মৃত্যু হবে তা আমরা জানি না। কিন্তু মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা তো আমরা চাইতেই পারি তাই না? স্বাভাবিক মৃত্যু আর অস্বাভাবিক ও রহস্যজনক মৃত্যুর মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমরা জানি মানুষের মৌলিক চাহিদা পাঁচটি (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা)। এছাড়াও প্রতিটি নাগরিকের জান ও মালের নিরাপত্তা একটি রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যা সংবিধানেও উল্লেখ করা হয়েছে। একজন নাগরিক শুধু মৌলিক চাহিদা গুলোর নিশ্চয়তাই চায় না রাষ্ট্রের কাছে তার জীবন, সম্পদ এবং সম্মানের নিশ্চয়তা চায়। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে আসলেই কি তা সম্ভব হচ্ছে? আমরা কি নিরাপদ মৃত্যুর নিশ্চয়তা পাচ্ছি?
বর্তমানে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আমাদের চারপাশের পরিবেশ। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার ফলে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বর্তমানে সংবাদ মাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া সবখানেই প্রতিদিন দেখা যায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, সড়ক দুর্ঘটনা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিখোঁজ, অপমৃত্যু, মব সৃষ্টি করে গণধোলাই কিংবা ধর্ষণের শিকার হয়ে খুন। যা অতীতের তুলনায় ভয়ঙ্কর হারের বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব ঘটনায় আমরা যেন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে একটি স্বাভাবিক মৃত্যু থেকে আমরা অনেক দুরে চলে যাচ্ছি যা কখনোই কাম্য নয়। অথচ আমাদের রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের জান ও মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। ফলে আমরা পড়ছি সংকটে। গত ১৫ জুলাই প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে খুনের ঘটনা। জানুয়ারিতে সারা দেশে খুনের মামলা হয় ২৯৪টি, জুনে হয়েছে ৩৪৪টি। গত ছয় মাসে ডাকাতি, দস্যুতা, ধর্ষণ ও পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার মতো ঘটনায় মামলা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে।” যা সাধারণ নাগরিকের জন্য হুমকিস্বরূপ।
গণমাধ্যমের তথ্যমতে, গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৩৫ জন। ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় অর্ধশতাধিক আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে। সে দিন দুপুরে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এ দুর্ঘটনায় হতাহতদের বেশিরভাগই শিশু। অথচ তাদের জীবন কতটা অনিরাপদ। এত জীবনের দ্বায়ভার কে নিবে?
ইংরেজ দার্শনিক জন লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদ অনুসারে বলা যায়, “সরকার এবং জনগণের মধ্যে একটি চুক্তি বিদ্যমান, যেখানে সরকার জনগণের অধিকার রক্ষা করবে এবং জনগণ সরকারকে সমর্থন করবে। এ চুক্তির ভিত্তি হল প্রাকৃতিক আইন, যা মানুষের সহজাত অধিকার যেমন জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। যখন সরকার এ অধিকার লঙ্ঘন করে, তখন জনগণের বিদ্রোহ করার অধিকার থাকে।” কিন্তু বর্তমানে আমদের সরকার পুরোপুরি আমাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। তবুও আমরা বিদ্রোহ করতে পারছি না এক অজানা কারণে। আজ বহুমুখী সংকটে আমরা সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, “রাষ্ট্রের বৈধতা বা লেজিটিমেসি” নির্ভর করে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, নিরাপত্তা বিধানে সক্ষমতা এবং জনগণের চাহিদা ও ইচ্ছার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর। কিন্তু একটি রাষ্ট্র যখন জনগণের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় তখনই সে রাষ্ট্রের জনগণ আত্মহননের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। একটি সাধারণ নাগরিকের আত্মহত্যার দায় তার একার নয় সে দ্বায় ঐ রাষ্ট্রের, ঐ সমাজ ব্যবস্থার। কারণ রাষ্ট্র তার মৌলিক চাহিদা পূরণ ওপর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
তাছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের একটি ভয়াবহ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যেকোনো সময় যে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। প্রশাসনের গাফিলতি, দীর্ঘমেয়াদী বিচার প্রক্রিয়া, ন্যায্য বিচার না হওয়া এর মূল কারণ। এর ফলেই জনগণ মব সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এমনকি প্রশাসনের উপস্থিতিতেই কখনও কখনও অপরাধীকে ছিনিয়ে নিয়ে গণধোলাই দেওয়া হচ্ছে। এসব মোটেও বিচ্ছিন্ন ঘটনার নয় এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি লক্ষণীয়। ফলে আমরা নিরাপদ মৃত্যুর নিশ্চয়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। যা একটি রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের নিরাপদ মৃত্যুর নিশ্চয়তা প্রদান করতে প্রয়োজন আইনের সুশাসন যা শুধু কাগজে-কলমে লিপিবদ্ধ না করে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও দরকার ন্যায্য বিচার ব্যবস্থা। প্রতিটি বিচার যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন হয় এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আমরা সাধারণ জনগণ আমরা চাই একটি সুন্দর ও সুশৃংখল রাষ্ট্র। অপমৃত্যু বা রহস্যজনক মৃত্যু আমরা চাই না। তাই বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রের কাছে নিরাপদ মৃত্যুর নিশ্চয়তা আমাদের অন্যতম দাবি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।