সবকিছু ঠিক থাকলে পরিকল্পনা মোতাবেক আগামী বছর ফেব্রæয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অর্থাৎ পবিত্র রমযান শুরু হবার আগেই অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের মানুষ এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য অপেক্ষা করছে। রাজনীতির ডামাডোলে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগে বিনিয়োগের গতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে নির্বাচনের আগে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে বলে অর্থনীতিবিদগণ আশঙ্কা করছেন। আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই অর্থের ছাড়ছড়ি। যারা নির্বাচনের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পাবেন এবং প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবেন তারা যে কোনো মূল্যেই হোক জয়লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেন।

একজন প্রার্থী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে পারবেন তার সীমা নির্ধারণ করা হলেও নিকট অতীতে দেখা গেছে, একজন প্রার্থীর নির্বাচনে অনেক গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করেন। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে যে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তা ছিল এক তরফা এবং প্রতিদ্ব›িদ্বতাবিহীন। কাজেই সে নির্বাচনগুলোতে অবৈধ অর্থ ব্যবহারের তেমন একটা প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তা সত্বেও প্রার্থীরা বিজয় নিশ্চিত করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন। আগামীতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল নির্বাচন হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। নির্বাচন শক্ত প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক হবে এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়িগণ বর্তমানে কিছুটা হলেও হাত গুটিয়ে বসে আছেন। তারা অপেক্ষা করছেন আগামী নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে তা দেখার জন্য।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাকার খেলা হবে এবং আগের মতোই ব্যবসায়ি-উদ্যোক্তাগণ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে। নির্বাচন উপলক্ষে মনোনয়ন বাণিজ্য চলতে পারে। ঋণ খেলাপি এবং অবৈধ অর্থের মালিকরা যাতে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন ধরনের অসুবিধার মুখোমুখি না হন সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বিদ্যমান বৃহৎ ঋণ খেলাপিদের ছাড় দেবার জন্য একটি বিশেষ নীতিমালা ঘোষণা করেছে। ঋণ খেলাপিরা মাত্র ২ শতাংশ নগদ ডাউন পেমেন্ট জমা দিয়ে ব্যাংক থেকে তাদের খেলাপি ঋণ ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলিকরণ করিয়ে নিবেন। এর জন্য তারা ২ বছরের গ্রেস পিরিয়ড পাবেন। বিগত সরকার আমলে আ হ ম মোস্তাফা কামাল অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রথম বারের মতো এ ধরনের সুয়োগ দেয়া হয়েছিল। তবে তার সময় গ্রেস পিরিয়ডের পরিমাণ ১ বছর। এখন তা ২ বছর করা হয়েছে। যারা বৃহৎ ঋণ খেলাপি এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে চান তারা এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন।

অর্থাৎ যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ১০০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি তিনি মাত্র ২ কোটি টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে নিজেকে ঋণ খেলাপিমুক্ত করতে পারবেন। নিশ্চিতভাবেই এটা করা হয়েছে ঋণ খেলাপিদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুবিধা দেবার জন্য। আগের বার যখন এ ধরনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল তখন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টগণ তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিতর্কিত সুবিধা আবারো দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সিডিউল ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু সেটা কিভাবে করা হবে? কিস্তি আদায় না করেই খেলাপি ঋণ আড়ালে লুকিয়ে রেখে ব্যাংকের মূল লেজার ক্লিন দেখানোর পরিণতি কি হতে পারে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? ঋণ খেলাপিদের অনৈতিক সুবিধাদানের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগদান কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না বরং যারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন তাদের অন্তত দু’বছর আগে থেকে খেলাপি ঋণ মুক্ত থাকতে হবে এমন একটি বিধান জারি করা প্রয়োজন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্থের খেলা চলবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। জাতীয় নির্বাচনে অর্থ ব্যয়ের যে সীমা রেখা নির্ধারিত থাকে তা কোন বারই মেনে চলা হয় না। নির্বাচন উপলক্ষে যে অর্থ ব্যয় করা হবে তা অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয়। ব্যয়িত দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে সহায়ক হবে না। নির্বাচনের প্রাক্কালে বিদেশ থেকেও প্রচুর অর্থ দেশে চলে আসতে পারে। নির্বাচন উপলক্ষে ব্যয়িত অর্থ কোন না কোনভাবে বাজারে চলে আসবে। ফলে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি আরো বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই বিগত সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও স্থানীয় বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মূল্যস্ফীতির গড় হার ৯ শতাংশের নিচে নামানো যাচ্ছে না। নানাভাবে চেষ্টা করেও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার কোনটিই কাজে আসছে না। নির্বাচনের প্রাক্কালে উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি অর্থনীতিতে জাল নোটের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেতে পারে বলে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন। তারা মনে করছেন, দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করার লক্ষ্য নিয়ে একটি বিশেষ মহল পরিকল্পিতভাবে বাজারে জাল নোট ছড়িয়ে দেয়ার আশংকা রয়েছে। দেশের বাইরে থেকে একটি মহল পরিকল্পনা মোতাবেক দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে জাল নোট ছড়িয়ে দিতে পারে। ইতিমধ্যেই সে ধরনের কিছু আলামতও লক্ষ্য করা গেছে। এ মুহূর্তে যদি মুদ্রা বাজারে জাল নোটের উপস্থিতি বেড়ে যায় তা অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা লেনদেনের সময় সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সতর্কতা কোন কাজে আসবে বলে মনে হয় না। কারণ আর্থিক লেনদেনকালে অধিকংশ সময়ই নোটে সত্যাসত্য যাচাই করা সম্ভব হয় না। এছাড়া জাল নোটগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যে খোলা চোখে তা সঠিক নাকি জাল তা নিরূপন করা কঠিন।

একটি দেশের মুদ্রা ব্যবস্থার সফলতা নির্ভর করে বিশ^াসযোগ্যতার উপর। সাধারণ মানুষ যদি প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থার উপর নির্ভেজাল আস্থা ও বিশ^াস রাখতে না পারে তাহলে অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশে^র কোন দেশের অর্থনীতিই সম্পূর্ণ জাল মুদ্রার প্রভাবভুক্ত নয়। তবে প্রতিটি দেশই চেষ্টা করে কিভাবে অর্থনীতিতে জাল মুদ্রার উপস্থিতি কমিয়ে স্বীকৃত রাষ্ট্রীয় মুদ্রার উপর ভোক্তাদের আস্থা ও বিশ^াস অটুট রাখা যায়। জাল নোট একটি দেশের অর্থনীতি এবং শাসন ব্যবস্থাকে কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিপর্যস্ত করে তোলে তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে মধ্যযুগীয় সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামল। অনেকেই সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলককে পাগল হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। কিন্তু মোহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন মধ্যযুগের একজন অসাধারণ প্রতিভাবান সুলতান। তিনি চিন্তা-চেতনায় ছিলেন যুগের চেয়েও অগ্রগামী। মোহাম্মদ বিন তুঘলক তার শাসনামলে যে কয়টি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তা ছিল অত্যন্ত বাস্তবধর্মী এবং যুগের চেয়ে অগ্রগামী। মোহাম্মদ বিন তুঘলক হচ্ছেন সে ব্যক্তি যিনি উপমহাদেশে প্রথম প্রতীকী মুদ্রা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্বর্ণ এবং রৌপ্য মুদ্রা বহুল ব্যবহারের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হতো। ফেইস ভ্যালুর চেয়ে রিয়েল ভ্যালু কমে যেতো। এ সমস্যা সমাধানের জন্য মোহাম্মদ বিন তুঘলক রাষ্ট্রীয় কোষাগারে স্বর্ণ এবং রৌপ্য জমা রেখে সে পরিমাণ প্রতীকি নোট বাজারে ছাড়েন। কিন্তু তিনি প্রতীকী মুদ্রা জাল প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি ভাবতে পারেননি মানুষ নোট জাল করতে পারে। কিছু দিনের মধ্যেই দেখা গেল বাজারে জাল নোটের বিপুল উপস্থিতি। জাল নোটের কারণে গ্রাহক প্রতীকী নোট গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে থাকে। আমলারা সুলতানের উপর নানা কারণেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারা এ সুযোগে সাধারণ মানুষকে উস্কে দেয়। সাধারণ মানুষ প্রতীকী নোট গ্রহণ করতে সম্মত হয়নি। ফলে এক সময় মোহাম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীকী মুদ্রা চালুর উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। মোহাম্মদ বিন তুঘলক যে প্রতীকী মুদ্রা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন বর্তমানে আমরা যে কাগজি মুদ্রা বিনিময় করি সেটা তারই পূর্ব উদ্যোগ মাত্র। সঠিকভাবে মুদ্রা ব্যবস্থাপনা করা না গেলে কী সমস্যা হতে পারে তা মোহাম্মদ বিন তুঘলক ভালোভাবেই টের পেয়েছিলেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জাল নোটের উপস্থিতি সব সময়ই ছিল এবং এখনো আছে। দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায় তখন জাল নোটের উপস্থিতি বাড়ে। সরকার চেষ্টা করে থাকেন কিভাবে জাল নোটের উপস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। কিন্তু সরকারের সে উদ্যোগ পুরোপুরি সফল হয় না এর মধ্যে যারা জাল নোট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সংস্থার এক শ্রেণির কর্মকর্তা আছেন যারা নোট জাল ঠেকানোর পরিবর্তে নোট জালকারিদের সঙ্গে আতাত করে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে নোট জালকরণে সহায়তা করে থাকেন। মাঝে মাঝেই জাল নোট মুদ্রণের কারখানার খবর পাওয়া য়ায়। আইন প্রয়োগকারি সংস্থার সদস্যরা এদের গ্রেপ্তার করেন। কিন্তু এক সময় তারা ঠিকই জেল থেকে বেরিয়ে আসেন এবং পূর্ণোদ্যমে তাদের কার্যক্রম চালাতে থাকে। তবে বাংলাদেশের বাজারে জাল নোটের যে উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তার বেশির ভাগই পাশর্^বর্তী রাষ্ট্র থেকে মুদ্রিত হয়ে আসে। একটি শক্তিশালি আন্তর্জাতিক চক্র জাল নোট মুদ্রণ ও বিতরণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বা বাজারে কী পরিমাণ জাল নোট আছে তার কোন সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারবেন না। কারণ যারা নোট জাল এবং বিনিময় করেন তারা তার পরিমাণ কখনোই কারো নিকট প্রকাশ করেন না। কাজেই জাল নোটের পরিমাণ কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন না। দেশের একজন অর্থনীতিবিদ,যিনি বিতর্কিত নানা গবেষণার জন্য খ্যাত তিনি তার এক গবেষণায় উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের বাজারে প্রতিদিন ৫ হাজার কোটি টাকার জাল নোট প্রবেশ করে। তার এই পরিসংখ্যান ছিল বিস্ময়কর এবং আজগুবি। কারণ প্রতিদিন যদি ৫ হাজার কোটি টাকার জাল নোট বাজারে প্রবেশ করে তাহলে সেই বছরের জিডিপি’র চেয়ে জাল নোটের পরিমাণ হয় অনেক বেশি। এটা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদ তার বক্তব্যের সংশোধনী দেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন বাজারে ৫ হাজার কোটি টাকার জাল নোট প্রবেশ করে না। জাল নোট ৫ হাজার বার হাতবদল হয়। তার এ বক্তব্যও ছিল নির্জলা মিথ্যাচার। কারণ কারো পক্ষেই গণনা করা সম্ভব নয় জাল নোট প্রতিদিন কতবার হাত বদল হয়। তবে আমাদের অর্থনীতিতে জাল মুদ্রার উপস্থিতি আছে এবং তা প্রবলভাবেই এটা কোনক্রমেই অস্বীকার করা যাবে না। নোট জালকারিরা অত্যন্ত শক্তিশালি এবং প্রায়শই সরকারের মহল বিশেষ থেকে সমর্থন-সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। জাল নোটকারি গ্রেপ্তার হলে তাদের বিরুদ্ধে এমনভাবে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় যাতে তারা সহজেই মুক্তি পেতে পারেন।

বাজারে কত পরিমাণ জাল নোট আছে বা প্রতিদিন কত সংখ্যক জাল নোট হাত বদল হয় তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের দেশের বাজারে জাল নোটের বিপুল উপস্থিতি রয়েছে। বিশেষ বিশেষ সময়ে আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে বাজারে জাল নোটের বিস্তৃতি ঘটে। যেমন দু’ঈদের সময় বাজারে বিপুল পরিমাণে জাল নোট ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা পুজার সময় বাজারে জাল নোটের উপস্থিতি বাড়ে। বর্তমানে দেশের মানুষ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষমান রয়েছে। এ সময় জাল নোটের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পেতে পারে। জাল নোট গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়। অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়। দেশের মুদ্রা ব্যবস্থার উপর থেকে মানুষের আস্থা কমে যায়। বর্তমান যুগে পণ্য বিনিময় প্রথা নেই বললেই চলে। ফলে পণ্য বিনিময়ের সহজ পন্থা হচ্ছে মুদ্রা। কোন কারণে সে মুদ্রা ব্যবস্থাপনার উপর থেকে মানুষের আস্থা হারিয়ে গেলে বাজারে স্বাভাবিক লেনদেন বিঘিœত হবে। জাল নোটের প্রভাব কমানো না গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম নিয়ে সঙ্কট সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয় জাল মুদ্রার কারণে মুদ্রা ব্যবস্থার উপর থেকে মানুষের আস্থা ও বিশ^াস নষ্ট হলে রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। কারণ প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিশ্চয়ই চাইবেন না তাদের প্রেরিত কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিগণ জাল নোট গ্রহণ করে প্রতারিত হোক। বরং তারা চেষ্টা করবে তাদের উপার্জিত অর্থ বিদেশেই কোন ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে।

নির্বাচনের ডামাডোলে আমরা যদি মুদ্রা ব্যবস্থাপনার উপর অবহেলা করি তাহলে দেশ এক মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে। তাই এখনই জাল নোটের আগ্রাসন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থার নিশ্চয়ই জানা থাকার কথা কারা এবং কোথায় জাল নোট তৈরি করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে জাল নোট মুদ্রণের সম্ভাব্য স্থানে অভিযান চালাতে হবে। কারখানাগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধ করা পাশাপাশ যারা জাল নোট তৈরিতে নিয়োজিত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি সীমান্তের ওপার থেকে জালনোট যাতে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য কড়াকড়ি নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। যে কোন মূল্যেই হোক জাল নোটের বিস্তার রোধ করতে হবে। অন্যথায় দেশের মুদ্রা ব্যবস্থার উপর থেকে মানুষের আস্থা এবং বিশ^াস নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যা অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ ক্ষতির প্রভাব দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকবে। অর্থনীতির ভার বহন করতে পারবে না। তাই জাল নোট প্রতিরোধ এখন অর্থনীতির একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিৎ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক।