ফারহানা মৌ ইরিন
জাপানে মার্কিন ‘টাইফুন’ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা এক নতুন ভূরাজনৈতিক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যুক্তরা’্র বলছে, এটি তাদের আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা জোরদারের অংশ; কিন্তু চীন ও রাশিয়া সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেÑ এ পদক্ষেপ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে বিপদে ফেলবে।
ঠাণ্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী যুক্তরা’্র সবসময়ই এশিয়াকে তাদের কৌশলগত এলাকা হিসেবে দেখেছে। দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান প্রণালি কিংবা কোরীয় উপদ্বীপÑ প্রতিটি অঞ্চলে তারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সক্রিয়। চীনের উত্থান ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়ন যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বেশি দৃঢ় উপস্থিতি দেখাতে বাধ্য করেছে। তাই জাপানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা তাদের পুরোনো কৌশলেরই আধুনিক রূপ।
টাইফুন ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন নিছক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নয়; এর ভেতরে আছে শক্তি প্রদর্শনের বার্তা। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করছে যে, তারা শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও এশিয়ায় ‘চূড়ান্ত প্রভাবক’ হয়ে থাকতে চায়। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার আশঙ্কা, এ পদক্ষেপ এক নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার দরজা খুলে দেবে। ছোট ছোট দেশগুলোÑ যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন কিংবা এমনকি আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রগুলো এ প্রতিযোগিতার চাপে পড়বে।
এ পদক্ষেপ যতটা না নিরাপত্তা আনবে, তার চেয়ে বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি করবে। ইতিহাস প্রমাণ করে, প্রতিটি অস্ত্র মোতায়েনই প্রতিপক্ষকে নতুন অস্ত্র পরীক্ষার দিকে ঠেলে দেয়। ফলে নিরাপত্তা বাড়ার বদলে পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়ে। জাপান হয়তো সাময়িকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে; কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি ফল হতে পারে আঞ্চলিক সংঘাত।
জাপানে টাইফুন ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন আসলে এক ধরণের দ্বিমুখী সংকেত বহন করছে। একদিকে যুক্তরা’্র দেখাতে চাইছে যে, তারা এখনো বৈশ্বিক শক্তির মঞ্চে প্রধান খেলোয়াড় এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরে তাদের উপস্থিতি অটল। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার কাছে এটি নিছক প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নয়, বরং ক্ষমতার এক প্রকাশ্য প্রদর্শন।
চীন ও রাশিয়ার চোখে এটি সরাসরি উসকানি, ফলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। আর ইতিহাস বলে, যখন বড় শক্তিগুলো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, তখন তার চাপ গড়িয়ে পড়ে ছোট দেশগুলোর উপরেই, জাপানের এ সিদ্ধান্ত তাদের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধও করতে পারে। কারণ, তারা যদি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হয়, তবে নিজেদের স্বাধীন নিরাপত্তা নীতিকে আড়ালেই ফেলে দিচ্ছে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়বে- কোনো সংঘাত শুরু হলে জাপান সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে।
তাছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা’ শব্দটা কেবল একটি ধারণা নয়, এর বাস্তব ফল ভয়ংকর। নতুন একটি ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন মানে প্রতিপক্ষ আরও উন্নত ও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র আনবে। এ চক্র কখনো শান্তি আনে না, বরং অনিশ্চয়তা, শঙ্কা ও অস্থিতিশীলতাকে গভীর করে তোলে। তাই বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র যতটা না জাপানকে নিরাপত্তা দিচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ঝুঁকির পথে দিকে ঠেলে দিচ্ছে। টাইফুন ক্ষেপণাস্ত্রের মোতায়েন কেবল জাপান-আমেরিকার যৌথ পদক্ষেপ নয়, এটি সমগ্র এশিয়ার শান্তি-শৃঙ্খলার ওপর এক নতুন প্রশ্নচিহ্ন। নিরাপত্তার নামে যদি উত্তেজনাই জন্ম নেয়, তবে এর দায় শুধু একটি দেশ নয়, বরং পুরো বিশ্বকেই বহন করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়