হাসনা হেনা

আমাদের মহিমান্বিত ঈদ দুটি। একটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর। আরেকটি হচ্ছে ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহা যেমন বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কথা বলে, তেমনি আবার মহান ত্যাগের কথাও বলে। যার ফলে এ ঈদকে কুরবানির ঈদও বলা হয়। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার মাঝে ২ মাস ১০ দিন ব্যবধান থাকে। ফলে একটি ঈদ শেষ হতে না হতে আরেকটি ঈদ চলে আসে। এটাই আল্লাহর বিধান। এভাবেই মুসলমানরা পালন করে দুটি উৎসব।

কুরবানির শাব্দিক অর্থ হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভ। সুন্নতী ইব্রাহিমির অংশ হলো মূলত ইব্রাহিম( আ) কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাইলকে আল্লাহর নামে কুরবানি দেয়া। এ ঈদের দুটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, সন্তুষ্টি লাভ, আরেকটি হচ্ছে সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা। সকালে রক্তিম সূর্য উপরে উঠার সময়ে কুরবানি করা হয় বলে এ দিনটিকে ইয়াওমূল আজহা বলা হয়ে থাকে।

কুরবানির আরেকটি শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ত্যাগ। আর হজের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে পবিত্রস্থান ভ্রমন। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম প্রতিটি মুসলিম নরনারীর জন্য ফরজ আল্লাহর এ হুকুম পালন করা। আল্লাহর হুকুম মান্য করার এক উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত দৃষ্টান্ত হচ্ছে মুসলমানদের এ কুরবানি। আমাদের নবী হযরত ইব্রাহিম (আ) খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মহান আল্লাহ তা’আলা হযরত ইব্রাহীমকে স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দেন। ইব্রাহীম স্বপ্নে এ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কুরবানি করলেন। কয়েক দিন পর তিনি আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। এরপর ইব্রাহীম ১০০টি উট কুরবানি করেন। এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখেন। এরপর ভাবলেন, তার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কুরবানির উদ্দেশে প্রস্তুতিসহ আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করেন।

আল্লাহর হুকুমে নিজ সন্তানকে কুরবানি করতে গেলে আল্লাহ বলেন, ওহে ইব্রাহিম আমি তোমার ছেলেকে আমার নামে উৎসর্গ করতে বলেছি, হত্যা করতে বলিনি। ঘটনায় প্রমাণিত হয় আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তৎকালীন সময়ে দেব-দেবির উদ্দেশ্যে মানুষ কুরবানি কিংবা নরবলির যে প্রথা প্রচলিত ছিল তার উচ্ছেদ সাধনের উদ্দেশ্য ও ছিল এই কুরবানি। আল্লাহ বলেন, আসলে মানুষ জবাই করার জিনিস না, যদি জবাই করতে হয় তবে পশু জবাই করো। না হয় এ প্রথা আজও চলমান থাকত। এটি মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় ইবাদত। জিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে এই ইবাদত পালন করতে হয়।

ঈদুল আজহার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ বলেন, তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্য সালাত আদায় করো এবং কুরবানি করো। (সুরা কাওসার-২), আমাদের প্রিয় হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্বেও যে কুরবানি করলো না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’

কুরবানির আরেকটি মহান দিক হচ্ছে আত্মশুদ্ধিতা। আত্মশুদ্ধির মর্ম হচ্ছে নিজের নফসকে ষড়রিপুর বেড়াজাল থেকে মুক্ত করা।

যে বেড়াজালে আটকা পরেছিলেন হাবিল-কাবিল তার বোন আকলিমাকে বিয়ে করা নিয়ে। মূলত কুরবানি এখান থেকে শুরু। যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা দেখতে চেয়েছিলেন ত্যাগের মহিমা। ত্যাগের মাধ্যমেই বিনাশ হয় কাম এবং ক্রোধ। এ কাম-ক্রোধ দমনের বিশাল পরীক্ষায় ফেলেছিলেন হাবীল এবং কাবীলকে। যখন হাবীল এবং কাবীলের মধ্যে সুন্দরী বোন আকলিমাকে বিয়ে করা নিয়ে দ্বন্দ্ববাঁধে কুরবানির মাধ্যমেই আল্লাহ এর ফয়সালা বেঁধে দিয়েছিলেন।

আল্লাহ বলেন, কুরবানির রক্ত, গোশত কিছুই আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু বান্দার তাকওয়া ও আল্লাহভীতি, (সুরা- আল হজ্জ, আয়াত- ৩৭।) কাবীল হাবীলের প্রতি ঈর্ষান্বিত হন হাবীলকে হত্যা করেন। এটি ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকাণ্ড। মূলত কাবীল তার ক্রোধ দমনে ব্যার্থ হয়েছিল। এজন্য আল্লাহ বলেন- আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য এমন অনেক জ্বিন এবং মানুষ যাদের ক্বালব বা অন্তর আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা বুঝে না, তাদের চোখ আছে, তা দিয়ে তারা দেখে না। তাদের কান আছে তা দিয়ে শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতোই এবং তার চেয়েও নিকৃষ্টতম। তারাই গাফেল। (সুরা আল আরাফ-আয়াত-১৭৯। কাজেই এ উক্তির মধ্য দিয়ে ক্বালব এবং আত্মাশুদ্ধির বিষয় ও গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। যে শুদ্ধিতার ভিত্তি হচ্ছে কুরবানি যার অর্থ আল্লাহর নৈকট্য লাভ। আল্লাহর হুকুম মান্য করা প্রত্যেক নর নারীর জন্য ফরজ।

ঈদুল আজহায় ত্যাগ যেখানে মূল খুটি তাই ইব্রাহিম (আ), বিবি হাজেরা ও ইসমাইলের পর ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই ঈদ। যারফলে কুরবানির স্মৃতিবাহী জিলহজ্জ মাসে হজ্জ উপলক্ষে সমগ্র পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মুসলমান সমবেত হয় ইসমাঈল (আ) স্মৃতি বিজড়িত মক্কা মদীনায়। তারা ইব্রাহীমি আদর্শে আদর্শবান হওয়ার চেষ্টা করেন। এজন্য হজ্জে ভাতৃত্ব বোধ, সংহতি ও ঐক্য জড়িত। যদি আমরা উপলব্ধি করি।

সিরাতুল মুসতাকিমের পথে চলার অংগীকারে প্রত্যয়ী হওয়ার এক সফল অনুষ্ঠান এ পবিত্র ঈদ। যার মাধ্যমে একটি বিষয় জোরালেভাবে প্রতীয়মান হয় যে আল্লাহর হুকুম মান্য করা অতি জরুরি এবং ফরজ যার মধ্যে মানবকল্যাণ নিহিত। কাফির, মুশরিকরা তাদের দেব, দেবী ও বিভিন্ন কবর বেদীতে নরবলির প্রতিবাদ স্বরূপ আল্লাহর তরফ থেকে যে কুরবানির প্রচলন হয় সেটা শুধু ঐটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে এটা ভোগবাদী প্রথায় রূপান্তরিত হবে।

আল্লাহর জন্য মানুষ তার প্রিয় জিনিস কুরবানি করার জন্য রাজি আছে কিনা সেটা প্রমাণের জন্য পুত্র কুরবানি দেওয়ার মত কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে না একটি হালাল পশু কুরবানির মাধ্যমেই আমরা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। আর সারাবছর পশু কুরবানি না, মানুষকে নানান কায়দায় দান খয়রাতের মাধ্যমে ত্যাগের এই মহিমা সমুজ্জ্বল রাখতে পারি। যার সুষ্পস্টতায় আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ তোমারা তোমাদের উপার্জিত হালাল মালের কিছু অংশ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো। তোমাদের জন্য যা জমিন হতে বের করেছি তার অংশ ব্যায় করো।(সুরা বাকারা আয়াত -২৬৭)।

সারা বছর নানান ত্যাগের মাধ্যমে আমরা সৃষ্টি করতে পারি, বৃদ্ধি করতে পারি ত্যাগের মহিমা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি শান্তি। তাই ঈদ এক সার্বজনীন আনন্দের নাম যার পবিত্রতা রক্ষা করা প্রতিটা মুসলিম নরনারীর জন্য অতীব জরুরি। মনের পশুকে জবাই করা, সমাজে ত্যাগের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষা। এ শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তৌফিক দিন। আমিন।

লেখিকা : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ।