রিদওয়ান বিন ওয়ালি উল্লাহ

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চেতনা ব্যবসী ছিল আওয়ামিলীগ। অথচ তাদের প্রণয়ণকৃত রাজাকারের তালিকায় তাদের দলের লোকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আবার এ চেতনা ব্যবসার মাধ্যমে ১৬ বছর বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে ধ্বংস করে দিয়েছে। মুখে মুখে ৭১ এর চেতনার ফেনা তুলে ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করে দেশের অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলতে ২৮ লক্ষ ৪১ হাজার ৫৩০ কোটি ৩৯ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা। যেখানে পদ্মাসেতু আর মেট্রোরেলে খরচ হয়েছে মাত্র ৬৫ হাজার কোটি টাকার মতো। ১৫ বছরে ভোট চুরি ও ডাকাতি করে দেশের সামাজিক অবস্থাকে বিষিয়ে তুলেছিল। জঙ্গি নাটক করে দেশের সংস্কৃতি ও সম্পদ ধ্বংস করেছে। প্রহসন করে জামায়াত নেতাদের শহীদ, বিডিআর হত্যা, হেফাজত ক্রাকডাউন, গুম, খুন, আয়নাঘর প্রতিষ্ঠা করে দেশবাসীকে অসহায় করে রেখেছিল। আগস্ট বিপ্লবে কোনো যুদ্ধ নয়, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত ২০০০ এর অধিক নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। হেলিকপ্টার থেকে নিরাপদ শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধাকে হত্যা করেছে। লাশ পুড়িয়ে ফেলেছে। শিক্ষা ব্যবস্থার বারটা বাজিয়েছে। শুধু মুজিববর্ষ উদযাপনে মোট ১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা ধ্বংস করেছে। গণপ্রত্যাখ্যাত ২০১৪, ১৮ ও ২৪ সালের ভূয়া, রাতের ও আমি-ডামির নির্বাচনে অপচয় করেছে রাষ্ট্রের ২৬৫ (দশম), ৭০০ (একাদশ), ২২৭৭ (দ্বাদশ) কোটি অর্থাৎ ৩২৪২ কোটি টাকা (বিবিসি বাংলা, ৩ জানুয়ারি, ২০২৪)। অথচ যাদেরকে চেতনা নেই বলে অভিযোগ করে সে দলে দূর্নীতি শুধু শুন্যের কোটায়ই নয় বরং তাদের দুজন মন্ত্রী ৩টি মন্ত্রণালয় চালিয়ে ১ পয়সার দূর্নীতিও করেনাই। ইসলামী ব্যাংককে এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাংক বানিয়েছে। আরো নানা সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে সাফল্যের সাথে পরিচালনা করে দেশের সেবা করে যাচ্ছে। ৫৩ বছরের অভিজ্ঞতা বলে, ৭১ নিয়ে মুখে ফেনা তোলা মানেই সে চরম দূর্নীতিগ্রস্থ ও মানুষের অধিকার হরণকারী। যেন ‘চেতনার সাইনবোর্ড’ অন্যায় ঢাকার ঢাল। আর যারা চেতনা নিয়ে খই ফুটায় না, তারাই শতভাগ দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে। যে লোকটা সর্বোচ্চ ক্ষমতা পেয়ে দেশের ১ পয়সাও তসরুফ না করে বরং দেশের সম্পদ রক্ষায় আমানতদারের ভূমিকা পালন করেছে, তাকে চেতনাহীন বলা মানে নিজেকে হয় পাগল না হয় ধান্ধাবাজ হিসেবে পরিচয় দেয়া। নিজের দেশকে ১০০ ভাগ ওউন করা ছাড়া ১০০ ভাগ দূর্নীতি মুক্ত থাকা সম্ভব নয়।

২৪ এর ৫ আগষ্টের বিপ্লবোত্তর প্রতিষ্ঠিত নতুন দলের নেতাদের কাছে দেশপ্রেমিক নাগরিক সে পুরনো বয়ান প্রত্যাশা করেনি। প্রতিষ্ঠার পরপর তাদের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ ওঠা ও তাদের মুখে পুরাতন চেতনা ব্যবসার বয়ান শুনে সন্দেহ দিন দিন বেড়েই চলেছে যে, তারাও কী আগের পতিত শক্তির মতই দূর্নীতি ঢাকার ঢাল হিসেবেই এটাকে ব্যবহার করছে? রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় কী তাদের বাস্তবভিত্তিক দেশের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে নিজেদের নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের প্রমাণ দেয়ার কোনো ইস্যু নেই। কিংবা সামর্থ্য বা যোগ্যতা নেই।

৭১ সালে কিছু দল মনে করেছে যে, ইন্ডিয়া ব্যাকড স্বাধীনতা আমাদের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা পূরণ করতে দেবেনা। কিন্তু তাই বলে সে তো যুদ্ধাপরাধী হয়ে যায় না। আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের কোনো প্রমাণ মেলেনি। যে কয়টা বিচার হয়েছে সবগুলো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আর রাজাকারের সংখ্যায় তো আওয়ামীলীগ চ্যাম্পিয়ন। দ্বিতীয় অবস্থানে বিএনপি। স্বাধীনতার পরে ৫৩ বছরের অধিকাংশ সময়ই বাংলাদেশ ভারতের ভৃত্য হয়েই ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামা য়াতে ইসলামী দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান মেনেই রাজনীতি করছে। কখনই বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর অপচেষ্টা করেনি। এবং তাদের গঠনতন্ত্রেও কোথাও পাকিস্তান পন্থার লেশ মাত্রও নেই। বরং স্বাধীনতা পরবর্তী তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ কিংবা দূর্নীতির কোনো মামলা হয়নি। এমনকি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানান ক্ষেত্রসহ ৫ বছর ৩টি মন্ত্রনালয় চালিয়ে তারা নিজেদেরকে সাচ্চা দেশপ্রেমিক প্রমান করেছে। অথচ তাদেরকে পাকিস্তান পন্থী বলছে এমন লোকেরা যারা দেশের হাজারহাজার কোটি টাকা লুট করেছে, যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণের মামলা রয়েছে। ফলে এটা স্পষ্ট যে, স্বাচ্চা দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়া কোনো ব্যক্তিকে ৭১ এর চেতনা বিরোধী কিংবা পাকিস্তানপন্থী বলে গালি দেয়া মানে এসব কথা বলে নিজের দূর্নীতি ঢাকার ব্যবস্থা করা।

হাসিনা জামায়াতীদের বলতো পাকপন্থী। অথচ মীর কাশেম আলী নিশ্চিত গ্রেফতার জেনেও লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। আর হাসিনা বাংলাদেশপন্থী দাবি করেও ইন্ডিয়া পালিয়ে গেছে। এর চেয়ে লজ্জা আর কী হতে পারে? সুতরাং জামায়াতকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানপন্থী আবিষ্কার করার অর্থ হচ্ছে নিজেদের দেউলিয়াত্বের প্রকাশ করা। গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করার যোগ্যতা না থাকায় পরিত্যক্ত ইস্যু নিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হওয়ার ধান্ধা ছাড়া আর কিছু না। কারণ জামায়াত সামাজিক নানা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও মন্ত্রীত্ব চালিয়ে যে দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে তা আর কেউ পারেনি।

এসব বয়ানের সাথে দেশের উন্নয়নের কোন সম্পর্ক নেই। বরং বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা থাকে। দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা সমস্যার সমাধানে টিভি টকশো, কর্মশালা, গোল টেবিল বৈঠক, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, সাইন্স ফেস্ট, বিজনেস ফেস্ট, সীমান্ত, প্রতীরক্ষা ব্যবস্থা, ফুটপাথ থেকে সচিবালয় পর্যন্ত চাঁদাবাজি বন্ধ করণ এমন নানা আয়োজনের সুযোগ আছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- কিছু সংখ্যক ক্ষমতা লোভী জাতীয় ইস্যু বাদ দিয়ে ফালতু বয়ান নিয়ে ব্যস্ত। যেখানে দেশের কোন কল্যাণ নেই।

মওদূদী ইসলাম বলতে কিছু নেই। এটা অভিযোগকারীদের মূর্খতা। জামায়াতে ইসলামীও মওদূদীর অনুসারী না। মওদূদী যেমন আল্লাহর রাসূল (স.)কে সকল ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন। জামায়াতে ইসলামীও বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মদ (স.) কেই আদর্শ মানেন। যা তাদের গঠনতন্ত্রের ২ নম্বর ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে। যারা মওদূদী ইসলাম বলে তারা ইসলামের কিছুই বোঝেনা। এদের সামনে এনে জেরা শুরু করলে নাকানিচুবানি খেয়ে যাবে।

অভিযোগকারীদের একটা অংশ (সমাজের নেতৃস্থানীয়) ভালো করেই জানে, ইসলামী আদর্শে পরিচালিত ইসলামী দল মানে শুধু কালেমা পড়ে দুনিয়ার আকাম-কুকাম করার ইসলাম না, শুধু নামাজ-রোজার ইসলাম না। বরং এটা যাবতীয় অন্যায়ের আতঙ্ক, সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতৃত্বদানকারী বিশ্বনবী (স.) এর সেই বিপ্লবী ইসলাম। ফলে এরা নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে ইসলামকে হেয় করার জন্য ও মানুষকে ধোকা দিয়ে স্বার্থ হাসিলের জন্য কখনো বলে মওদূদী ইসলাম, কখনো চরমোনাই ইসলাম, কখনো ফুরফুরা ইসলাম, কখনো শরষীনা ইসলাম, কখনো সউদী ইসলাম ইত্যাদি নামে বয়ান তুলে। আর যুগে যুগে এদের পেট্রোনাইজ করে ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ব। ঠিক যেমন যুগে যুগে নবী-রাসুলদেকে (স.) ইসলাম বিদ্বেষীরা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব হারানের ভয়ে পাগল, কবি, গনক ইত্যাদি অপবাদ দিতো।

ঠিকানায় খালিদ মহিউদ্দিনের শো’তে রেজাউল করীম রনি বলেন, এদেশে মধ্যমপন্থার রাজনীতি দরকার যা জামায়াত পারবেনা। তার কথায় বোঝাগেছে ইসলামি রাজনীতির মাধ্যমে মধ্যমপন্থী রাজনীতি গড়া সম্ভব না। এটি ইসলাম ও ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে স্পষ্ট অপবাদ। তিনি না বুঝে থাকলে ইসলামের মধ্যপন্থা সম্পর্কে তার অধ্যয়ন করা জরুরি। পৃথিবীতে একমাত্র ইসলামপন্থা দিয়েই মধ্যমপন্থী সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলা সম্ভব। এ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহই বলেছেন, আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের উপর সাক্ষী হও এবং রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের উপর (২:১৪৩)।

বাংলাদেশের নাগরিকদের ইতিহাস ভালোভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। হাজার হাজার বছর আগে থেকেই এ অঞ্চলে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপিত হয়ে আজও চর্চা হচ্ছে। যার ফলে এ অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা দাড়িয়েছে ৯২ ভাগে। তাই এখানে মধ্যপন্থার রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামী রাজনীতিই বেশি যুৎসই হবে।

৫ আগস্ট বিপ্লবোত্তর মানুষ রাজনীতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছে। ৫৩ বছরে বড় দলগুলোকে দূর্নীতিগ্রস্থ দেখেছে। অন্যদিকে জামায়াতকে দুর্নীতিমুক্ত দেখে মানুষ ভাবছে, সবাইকে দেখা শেষ। এবার জামায়াতকে ক্ষমতায় দেখার পালা। জনগণের মধ্যে এ ইতিবাচক ও সংস্কার মূলক পরিবর্তন দেখে স্বার্থান্বেষীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রত্যাখ্যাত পুরাতন ইস্যু নিয়ে জামায়াতকে ঘায়েল করতে পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। ইসলামী শক্তিগুলোর ঐক্য শক্তিতে ভীত হয়ে তারা সংঘবদ্ধভাবে নানান প্লাটফর্ম থেকে বয়ান তুলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠেছে।

প্রতিকারের উপায়: ১. রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অন্যায়ভাবে ঘায়েল না করে নৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করার সংস্কৃতি চালু করা। ২. নৈতিকতার মাধ্যমে দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়া। ৩. বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি চর্চা করা। ৪. গুম, খুন, হত্যা ও চাঁদাবাজির রাজনীতি বন্ধ করা। ৫. মিথ্যা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার অপরাজনীতি বন্ধ করা। ৫. রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। ৬. ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে অনৈসলামিক দলের নেতাগণকে তাফসীর, হাদীসগ্রন্থ ও ইসলামী সাহিত্য উপহার প্রদান। ৭. সকল দলের মধ্যে পরস্পর সংশোধনের রাস্তা খোলা রাখা। ৮. দায় চাপানোর রাজনীতি বন্ধ করা। ৯২% মুসলমানের দেশ হিসেবে সকল রাজনীতিবিদকে এ অঞ্চলে ইসলামের ইতিহাস, সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা আবশ্যক। ৯. ৪৭-৭১-২৪ এর স্পিরিটকে সমুন্নত রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা। ১০. দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সমন্বিত কাজ করা।

লেখক : শিক্ষক, শহিদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ।