পৃথিবী জুড়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বাড়ছে হিংসা-প্রতিহিংসা, যুদ্ধ, ক্ষুধা, রাজনৈতিক সংঘাত। ফলে দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, কখনো নিজ দেশের দ্বারা, কখনো ভিনদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে। যার দৃষ্টান্ত ফিলিস্তিনের গাজা। গাজার শিশুরা আজ কাঁদতেও ভুলে গেছে। ইসরাইলি বাহিনীর নিষ্ঠুরতায় গাজার নিষ্পাপ শিশুরা অকালেই ঝরে যাচ্ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে। এ হামলায় ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। আর আহতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। গাজার ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৮৫ বর্গকিলোমিটারই সন্ত্রাসী ইসরাইল বাহিনীর দখলে। ফলে অনেকে নিজ বসতভিটা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। অথচ মানবাধিকারের প্রবক্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। গাজাবাসীর দুঃখ কষ্ট অনুধাবন করার বিবেকটুকু তাদের জাগ্রত হয় না।

বর্তমানে পৃথিবীতে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কত। আর কোন দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে তা বুঝার জন্য আইডিএমসির প্রতিবেদনই যথেষ্ট। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ২০২৪ সালে বিশ্বে ৮ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা নজিরবিহীন। গৃহহীন হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। নিজ দেশ ত্যাগ না করেও তারা আশ্রয়হীন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, ভারতের অবস্থান এক নম্বরে। আইডিএমসির প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয় ২০২৩ সালে সংঘাত সহিংসতার প্রায় ৭ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৯৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ১ কোটি ১০ লাখের মতো মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফিলিপাইনে ৮৯ লাখ ৯৬ হাজার মানুষ, তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫৪ লাখ ৩১ হাজার মানুষ ভারতে, চতুর্থ সর্বোচ্চ ৩৯ লাখ ২৬ হাজার মানুষ চীনে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর সংঘাত-সহিংসতায় সুদানে ৯১ লাখ মানুষ, ফিলিস্তিনে ৩২ লাখ মানুষ, গাজায় ২০ লাখ মানুষ, লেবাননে ১১ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

প্রতিবেদনে আরও দু ধরনের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। এক অভ্যন্তরীণ সংঘাত। দুই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সিরিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক কঙ্গো, বুরকিনা ফাসো, সুদান ও সোমালিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের চাইতে সংঘাতে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। মানুষ কেন বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন? এমন প্রশ্ন যে কারও মনে জাগ্রত হতে পারে! হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন, সংঘাত ও সহিংসতা। বাস্তুচ্যুতের ঘটনা কোন একটি দেশ বা জনপদ ঘিরে হচ্ছে তা কিন্তু নয়; পৃথিবী জুড়ে বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালে বিশ্বে প্রায় ১১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বিশেষ করে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্প। সুদানের সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর সংঘাত। ফিলিস্তিনের গাজায় হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আমাদের দেশে দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। এটা কারও কারও কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে! গত ১৪ মে প্রথম আলো পত্রিকার শিরোনাম ছিল-দেশে দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত মানুষ ২৪ লাখ (সূত্র : ১৪ মে, ২০২৫, প্রথম আলো)। এ খবরটি মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়! অন্যান্য দাবি-দাওয়ার খবরে এ প্রতিবেদনটি হয়ত আলোড়িত করেনি। প্রকাশিত প্রতিবেদনের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো- প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা টানা ৪ বছর ধরে বেড়েছে। দুর্যোগ বাস্তুচ্যুতির বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। ১৩ মে নরওয়েভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) প্রকাশিত বৈশ্বিক অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালে দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪ লাখ। এর আগের (২০২৩ সালে) দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ লাখ। ওই বছরও বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। এক বছরের ব্যবধানে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৬ লাখ বেড়ে ২৪ লাখ হয়েছে। মোট বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যায় এটা দেশে সর্বোচ্চ তৃতীয়। এর আগে ২০১৯ সালে বন্যায় এবং ২০২০ সালে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও আম্পানের কারণে এর চেয়ে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত ছিলেন। দুর্যোগ ছাড়াও দেশে গত বছর সংঘাত ও সহিংসতায় ২ হাজার ৮০০ জন বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের সংখ্যা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। অথচ নায়ক- নায়িকার বিয়ে-শাদি কিংবা পরকিয়ার খবর নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। ওইসব খবর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে যেভাবে ফলাও করে প্রচারিত হয় তার ছিটে ফোটাও যদি বাস্তুচ্যুত মানুষের খবর প্রচারিত হতো, তাহলে এ সংখ্যা নি:সন্দেহে অনেকটাই কমে আসতো। প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই নড়েচড়ে বসতো। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট বিতাড়িত হওয়ার পর আমরা যে স্বপ্নের বাংলাদেশ চেয়েছিলাম সে ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা আশাহতই হয়েছি। কারণ আমরা নিজেদের স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। শুধু নিজে কিভাবে ভালো থাকা যায়, কিভাবে বেশি অর্থ পকেটে নেয়া যায় সে চিন্তায় বিভোর থাকি। দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা প্রায়ই বলেন, জনগণের কল্যাণের জন্য নাকি তারা রাজনীতি করেন। অথচ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি; বরং ‘‘যে যায় লংঙ্কায় সে হয় রাবণ’’ ভাবটা ঠিক এমনই। মানুষ পরিবর্তন হয়। সাইনবোর্ড পরিবর্তন হয়। কিন্তু পরিবর্তন হয় না কিছু মানুষের জীবন। যার দৃষ্টান্ত ২৪ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বহু পরিবার বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের ভাষ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সিডর ও আইলার পর দেশে জলবায়ু উদ্বাস্তু সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। ঘূর্ণিঝড় সিডরে ৬ লাখ ৫০ হাজার, ঘূর্ণিঝড় বিজলিতে প্রায় ২০ হাজার, ঘূর্ণিঝড় আইলায় ৮ লাখ ৪২ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ সংখ্যা ২০৩০ সালের দিকে ৪ কোটি ৮৩ লাখ এবং ২০৪০ সালে ৯ কোটি ৫৭ লাখে দাঁড়াতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। ২০২৩ সালের ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশে আঘাত হানে। ওই ঝড়ে বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। (সূত্র : ১৬ জুন, ২০২৪, প্রথম আলো) বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুতি বাড়ার পেছনে শুধু জলবায়ু, বন্যা, খরা দায়ী নয়; অভ্যন্তরীণ সংঘাত সহিংসতায়ও মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। তাছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণ পুরো দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। দেশের নদী নালা ও খাল বিল দখল করে ভরাট করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। কিন্তু কেউ টু শব্দটুকু উচ্চারণ করে না। নদী নালা, খাল, বিল দিয়ে সঠিকভাবে পানিপ্রবাহ চলাচল করতে পারছে না। ফলে দেশে বন্যার তীব্রতা বাড়ছে। বন্যার কারণে প্রতিবছর লাখো মানুষ অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। যারা নিজ বাসা বাড়ি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন তাদের বড় একটি অংশ দেশের বিভিন্ন জেলা শহর, বিভাগীয় শহর ও রাজধানী শহরে বস্তির বাসিন্দা হচ্ছেন। এসব বস্তিতে বসবাসকারীর ৮১ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত।

রাজধানীর মিরপুর, কালসী, দশ নম্বর গোল চত্বর, মহাখালী, ফার্মগেট, তিব্বত, শ্যামলী, সদরঘাট, গুলিস্তান, খিঁলগাও, মতিঝিলের বিভিন্ন ফ্লাইওভারের নিচে, রেল লাইনের পাশে একাধিক বাস্তুচ্যুত পরিবারের বসবাস। একসময় যারা ধনাঢ্য ছিলেন। তাদের কেউ কেউ আম্পান, সিডর-আইলা ও রেমালের নিষ্ঠুরতায় নিঃস্ব হয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এসব মানুষের সহায়সম্বল বলতে তিন কিংবা চার ফুটের পলিথিন, কয়েক টুকরা সুতলি আর চারটি ইট। এসব উপকরণ দিয়েই তৈরি হয় ঘর। এসব ঘরের বাসিন্দারা বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে। শুধু কি তাই! খুপড়ির মতো ঘর হওয়ায় সবাই এক সাথে ঘুমাতে পারে না। পালা করে ঘুমায়। রান্নাবান্নাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে ড্রেনের ময়লা পানিই একমাত্র ভরসা। সপ্তাহ পার হলেও গোসল জোটে না। এসব মানুষের সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। ‘‘সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে এক গবেষণা মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি ৭ জনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হবেন। এ হিসাবে ২০৫০ সালের মধ্যে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখে দাঁড়াবে।’’ এই প্রবণতা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন একটি দিকনির্দেশনামূলক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। যেন বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কমে আসে, এমনটিই বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রত্যাশা।