আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা লাভ; কিন্তু এ জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। পৃথিবীতে কোন জাতিই এতো চড়া মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। কিন্তু নেতিবাচক রাজনীতি ও মহল বিশেষের ক্ষমতালিপ্সা আমাদের এ মহান অর্জনকে পুরোপুরি ফলপ্রসূ হতে দেয়নি। যে চেতনা ধারণ করে মুক্তি পাগল জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, স্বাধীনতার পর তা আর চেতনা থাকে নি বরং মহল বিশেষ আত্মস্বার্থ চরিতার্থকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বানিয়েছিলো। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা গণতন্ত্রকে বলি দিতে কসুর করা হয়নি। ফলে ১৯৭৫ সালে দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হয়েছিলো। এতে ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর পতন হলেও এজন্য জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।
১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর মনে করা হয়েছিলো যে, দেশে সুস্থ্যধারার গণতান্ত্রিক চর্চা অবারিত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়েনি। সে দুর্ভাগ্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে আততায়ীদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। জাতি এ ধাক্কা সামাল দেয়ার আগেই ১৯৮২ সালে রাতের আঁধারে একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়। এ অবৈধ শাসন দীর্ঘায়িত হয় ৯ বছরের জন্য। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হলেও এজন্য আমাদেরকে চড়ামূল্য দিতে হয়েছে। এরপর গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়ার জন্য জামায়াতের দেয়া ফর্মূলা মোতাবেক ১৯৯১ সালে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ধরে নেয়া হয়েছিলো যে, দেশের গণতন্ত্রের ভাগ্যাকাশ থেকে কালো মেঘ চিরদিনের জন্য কেটে যাবে। কিন্তু ক্ষমতা পাগলদের ক্ষমতালিপ্সার কারণে সে আশায়ও গুড়েবালী পড়েছে। যারা কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসতে সমর্থ হয়েছিলেন, তারাই তাদের জন্ম পরিচয় ভুলে গিয়েছিলেন। তারা কেয়ারটেকার সরকারকে আর চিনতেই পারেন নি। ফলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই কেয়ারটেকার সরকারের স্থায়ী বিধান সংবিধানে প্রতিস্থাপনের জন্য বিরোধী দলগুলো একদফার আন্দোলন শুরু করতে হয়েছিলো। সে দাবি আদায়ে ১৯৩ দিনের হরতাল করতে হলো। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের দাবির মুখে নিজেরাই সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকারের স্থায়ী বিধান সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করলেন। কিন্তু সে আন্দোলনে ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যানটা নেহায়েত কম ছিলো না।
এবার অন্তত ধরে নেয়া হয়েছিলো যে, দেশের নির্বাচন পদ্ধতি ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিতর্কের চিরতরে অবসান হয়েছে। কিন্তু সে অর্জনও আমরা ধরে রাখতে পারিনি বরং নানা ছলছুতায় এবং তথাকথিত আন্দোলনের নামে সারাদেশে হত্যাযজ্ঞ সহ ব্যাপক নাশকতা চালিয়ে ২০০৬ সালে একটি সাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকারকে উৎখাত করে ১/১১-এর এক অদ্ভূত প্রকৃতির জরুরি সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে ২ বছর ধরে দেশকে বিরাজনীতিকরণ ও আওয়ামী লীগকে পূনর্বাসনের নীলনকসা প্রণয়ন করেছে এবং সে নীলনকসার অংশ হিসাবে ২০০৮ সালে সাজানো, পাতানো ও সমঝোতার নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতায় এসে তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্যই অবাধ গণতন্ত্রের রক্ষাকবজ নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে ফ্যাসিবাদী শাসন চিরস্থায়ী করার দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়েছিলো আওয়ামী লীগ। কিন্তু গত বছরের জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। জাতীয় জীবনে দেখা দিয়েছে এক স্বপ্লীল প্রভাতের হাতছানি। কিন্তু এজন্য আমাদেরকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ছাত্র-জনতা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশকে আওয়ামী-বাকশাল মুক্ত করেছে। কিন্তু শ্রেণি বিশেষের অহমিকা ও অহেতুক জিদের কারণেই তাও ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মূলত, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের প্রায় ১৬ বছরের ধরে চলা মাফিয়াতান্ত্রিক অপশাসন-দুঃশাসননের অবসান ঘটেছে। সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের হলেও পতিত সরকারের শাসনামলে কারো কথা বলার অধিকার ছিলো না। দেশ চলেছে ‘এক নেতা একদেশ’ আদর্শের ভিত্তিতে। একেবারে ফেরাউনী শাসন বললেও অত্যুক্তি হবার কথা নয়। মূলত, তখন দেশে সাংবিধান ও আইনের শাসন ছিলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। চৌর্যবৃত্তি ও কথিত নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে ব্রুট মেজোরিটির জোরে সংবিধানকে রীতিমত ক্ষমতাসীনদের দলীয় ইস্তেহারে পরিণত করা হয়েছিলো। দেশকে পরিণত করা হয়েছিলো অপরাধ ও অপরাধীদের অভয়ারণ্যে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে রীতিমত দলীয় হাইকমান্ডে পরিণত করা হয়। বিচারাঙ্গন, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষা প্রশাসন নির্লজ্জভাবে দলীয়করণ করা হয়। ফলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিরা সরকারের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করেন। ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে পড়ে। দেশ পরিণত হয় আওয়ামী বাকশালীদের অভয়ারণ্যে। যেখানে সাধারণ মানুষ বা বিরোধী মতের কোন অধিকার ছিলো না বরং সকল অধিকার ক্ষমতাসীনদের জন্যই ছিলো। এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ, সংবিধান, আইন-কানুন সহ রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগুলোকে ক্ষমতাসীনরা রীতিমত রাবার স্ট্যাম্প হিসাবে ব্যবহার করেছে। আইনের অপপ্রয়োগ অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করছিলো। ফলে মানুষের জানমাল হয়ে ওঠেছিলো ক্ষমতাসীনদের পুতুল নাচের নাট্যশালার অনুসঙ্গ।
পরপর তিনটি সাজানো-পাতানো নির্বাচন, বিরোধী দলের ওপর কঠোর দলনপীড়ন এবং সরকার বিরোধীদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে মনে করা হয়েছিলো যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদ স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। বিশেষ করে এদের সাথে আমাদের বৃহত প্রতিবেশীদের সব ধরনের সহযোগিতা-সমর্থনের কারণে মনে করা হয়েছিলো জাতির ঘাড় থেকে এ জগদ্দল পাথর কোনভাবেই নামানো সম্ভব হবে না। বিষয়টি তদানীন্তন ক্ষমতাসীনদের গর্বভরেই বলতে শোনা গেছে। খোদ আওয়ামী সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দম্ভভরেই বলেছিলেন যে, তার সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানোর শক্তি দুনিয়াতে এখনো সৃষ্টি হয়নি। কোন কোন আওয়ামী লীগ নেতাকে এমনও বলতে শোনা গেছে যে, ‘শেখ হাসিনা যতদিন জীবিত থাকবেন, আওয়ামী ততদিনই ক্ষমতায় থাকবে’। আবার কেউ কেউ আরো একধাপ বাড়িয়ে বলতেন যে, ‘আওয়ামী লীগকে একশ’ বছরেও কেউ ক্ষমতা থেকে নামাতে পারবে না’। কিন্তু ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ বা পাওয়ার হাউস যে অন্যকোন জায়গায় তা কিন্তু তারা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করে অবৈধ ক্ষমতার দম্ভে হেন অপরাধ নেই তারা করেনি। আওয়ামী শাসনামলে টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজি এবং ব্যাপকভিত্তিক জুলুমবাজীর কারণে সাবেক প্রধান বিচারপতি মরহুম হাবিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘বাজীকরের সরকার’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে রীতিমত সোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। সে সময় আওয়ামী লীগের অপকর্ম ও চুরিদারি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আওয়ামী লীগ দেখলেই ‘তুই চোর’ বলে সম্বোধন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এবিএম মূসা। এ থেকে প্রমাণ হয়, আওয়ামী-বাকশালীরা দেশকে কীভাবে স্মশানে পরিণত করেছিলো। মূলত, দেশকে পরিণত করা হয়েছিলো শ্রেণি বিশেষের পৈতৃক সম্পত্তি, অপরাধ ও অপরাধীদের লাগামহীন চারণ ভূমিতে।
তবে জুলাই বিপ্লবের পর দেশে নতুন করে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিলো। মনে করা হয়েছিল যে, অনেক ত্যাগ ও কুরবানীর বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের মূল্য দেয়া যুগের অবসান হয়েছে। অনেক চড়াদামে অর্জিত এ বিপ্লব দেশ ও জাতিকে একটি ইতিবাচক গন্তব্যে নিয়ে যাবে। বিপ্লবোত্তর অন্তর্বর্তী সরকার এবং বিপ্লবের স্টেক হোল্ডার সকল রাজনৈতিক দল ও শক্তি এ মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলো যে, ফ্যাসিবাদের আমলে ধ্বংসকৃত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কাক্সিক্ষত সংস্কার, জুলাই সনদ প্রণয়ন এবং এর সাংবিধানিক ভিত্তি প্রদান, গণহত্যাকারীদের দৃশ্যমান হওয়ার পর দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কক্ষচ্যুত গণতন্ত্র ফিরে আসবে কক্ষপথে।
মূলত, সে কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধীনে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক বৈঠকের মধ্যেই মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা জাতির সামনে জুলাই ঘোষণা উপস্থাপন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে কিছুটা মতবিরোধ দেখা দিলে সকলের মতামতের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হয় এবং সে সনদে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষরের পরই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয় প্রস্তাবিত রূপরেখা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করার পর দেশের একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি করা শুরু করে। তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলেও এর সাংবিধানিক ভিত্তি দিতে চান না বরং এটিকে তারা কাজীর গরু ‘কিতাবে আছে; গোয়ালে নেই’ এমন অবস্থায় রেখে পুরো জুলাই বিপ্লবকে অকার্যকর ও মূল্যহীন করতে চান। তারা জুলাই সনদ স্বাক্ষর করলে তা বাস্তবায়নে সাংবিধানিক ভিত্তি তথা গণভোটে আগ্রহী হন। কিন্তু বিএনপি কেন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগে বিরোধী অবস্থান নিয়েছে, তা কারো বোধগম্য নয়।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সাথে গণভোটের পক্ষে হলেও এ বিষয়ে যেসব জটিলতার সৃষ্টি হবে, সেসব কোন ভাবেই বিবেচনায় নিচ্ছে না। তারা নানা কথা বললেও কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় খরচ বাঁচানোর কথা বলছেন। অবশ্য এর একটা মোক্ষম জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন এনসিপির শীর্ষনেতা নাসির উদ্দীন পাটোয়ারী। তার দাবি, যুবদলের এক নেতার চাঁদাবাজীর টাকা দিয়েই দেশে গণভোট আয়োজন করা সম্ভব। বিএনপির খরচ বাঁচানোর দাবি যে কতখানি হাস্যকর ও আদর্শিক দেউলিয়াপনা তা নিকট অতীতে তাকালেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। তারা ১৯৯৬ সালে শুধুমাত্র নিজেদের জিদ রক্ষার জন্য একটি নির্বাচন করেছিলেন এবং বিরোধী দলের দাবির মুখে সংবিধান সংশোধন করে মাত্র ১৯ দিনের মাথায় সে সংসদ বিলুপ্ত করা হয়েছিলো। আর বিএনপির রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যই নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে দেশ ১৯৩ দিনের হরতালের মুখোমুখী হয়েছিলো। তাই রাষ্ট্রীয় খরচ বাঁচাতে একই দিন গণভোটের দাবি ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ বা ‘মাছের মায়ের পুত্র শোক’-বৈ কিছুই নয়।
মূলত, বিএনপি জুলাই সনদ বা সংবিধান সংশোধন কিছুই চায় না বরং তারা নিজেরা পুরনো বৃত্তে ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার দিবাস্বপ্নে বিভোর। তারা ঐকমত্য কমিশনের সকল বৈঠকেই সংস্কার, জুলাই সনদ এবং সংবিধান সংশোধনের পুরোপুরি বিরোধীতা করে এসেছেন। কিন্তু সকল রাজনৈতিক দলের দৃঢ় অবস্থান ও প্রবল জনমতের চাপেই তারা মৌখিকভাবে সংস্কার ও সংবিধান সংশোধনে মতামত দিয়ে জুলাই সনদ স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু যখন স্বাক্ষরিত সনদের সাংবিধানিক ভিত্তি দেয়ার জন্য গণভোটের প্রশ্ন উঠেছে, তখন তারা পুরোপুরি ইউটার্ন নিয়েছেন। জুলাই সনদে আইনগত ভিত্তি দিতে যে তারা আন্তরিক নন, তা বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান, সিনিয়র নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দীনের বক্তব্য থেকে রীতিমত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের জুলাই সনদের প্রয়োজন নেই’। এতে বোঝা যায়, তারা দেশ ও জাতির স্বার্থের বিপরীতে ক্ষমতাকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। যা বিএনপির দ্বি-চারিতা ও আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিএনপি যে সংস্কার, জুলাই সনদ ও সংবিধান সংশোধন নিয়ে রীতিমত ‘ঢাক ঢাক গুর গুর’ খেলছে তা দলটির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীমের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রস্তাবনা বা সুপারিশ দাখিলের পর তিনি বলেছিলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা না করে জাতীয় বিভক্তি সৃষ্টি করেছে’। এমনকি কী তিনি এমন দাবিও করে বসেছেন যে, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে’। যা আওয়ামী লীগের ২০০৬ সালের ভূমিকার কথাই নতুন করে স্মরণ করে দেয়।
একথা কারো অজানা নয় যে, আওয়ামী লীগ ২০০৬ সালে তদানীন্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এম আজিজকে নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের দাবির মুখে তাকে ছুটিতে পাঠিয়ে বিচারপতি মাহফুজুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার করা হলেও তাদের অপপ্রয়াস বন্ধ হয়নি। এরপর কেয়ারটেকার সরকারের সম্ভাব্য প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে নানাভাবে বিতর্কিত করার কারণে তিনি দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে কেয়ারটেকার সরকার গঠন হলেও সরকারের সকল সদস্যদের বিরুদ্ধেই তারা বিষোদগার করতে ভোলেনি। এমনকি তারা রাষ্ট্রের সকল অবকাঠামো ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বকে বিতর্কিত করতে মোটেই কসুর করেনি। ফলে ১/১১-এর মত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। মূলত, আওয়ামী লীগের সবকিছুতে না বলার কারণেই ১/১১ সৃষ্টি হয়েছিলো। সে ধারাবাহিকতায় বিএনপি যদি সবকিছুতে না বলতে থাকে তাহলে আমাদের গন্তব্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও আমাদের জন্য যে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে না, তা কিন্তু নিশ্চিত করেই বলা যায়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, একশ্রেণির স্বার্থান্ধ রাজনীতিকের কারণেই আমাদের দেশের চলমান রাজনীতি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে। সম্প্রতি জামায়াতের সাথে রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্নতর হওয়ায় বিএনপির সিনিয়র নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ১৯৭১-এর ভূমিকার জন্য জামায়াতের বিচার দাবি করেছেন। অথচ বিএনপি এ দলটির সমর্থন নিয়ে ১৯৯১ সালে সরকার গঠন, ২০০১ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচন ও একসাথে সরকার গঠন এবং ২০১৮ সালে একই প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। এখন রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে দলটির বিচার দাবি করা কেউই যৌক্তিক ও কাক্সিক্ষত মনে করছেন না।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে জুলাই বিপ্লব পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে আমরা সর্বোচ্চ কোরবানী করেছি। বারবার স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ তাড়াতে গিয়েও আমাদেরকে চড়ামূল্য দিতে হয়েছে। বিজয়ও এসেছে বারবার। কিন্তু ক্ষমতাকেন্দ্রীয় নেতিবাচক রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে এসব বিজয়ের সুফল আমরা পুরোপুরি ঘরে তুলতে পারিনি বরং হীন রাজনৈতিক স্বার্থেই তা বারবার জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে।
এবারের জুলাই বিপ্লব সে অশুভ বৃত্তেই আটকা পড়তে যাচ্ছে রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই। মূলত, একশ্রেণির রাজনীতিকরা দেশকে পুরনো বৃত্তেই দেখতে চাচ্ছেন। তারা হয়তো মনে করছেন দেশটা ‘দুগ্ধবতী গাভী’। তাই অতীতে দেশটাকে যেভাবে দোহন করা হয়েছে, ভবিষ্যতের কাণ্ডারীরাও হয়তো সেভাবেই দোহন করতে চান। এমন নেতিবাচক রাজনৈতিক মানসিকতা থেকেই আমাদের কোন অর্জনই ফলবতী হচ্ছে না। তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, আর কত মূল্য দিলেও আমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারবো? এমন ভাবনা কি শুধুই অমূলক?