চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ও ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের পতনোত্তর বাংলাদেশের চারটি সরকারি ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ বিজয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়। বলাবাহুল্য, এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ডাকসুতে ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টি, জাকসুতে ২৫টি পদের মধ্যে ২০টি, চাকসুতে ২৬টির মধ্যে ২৪টি, রাকসুতে ২৩টি পদের মধ্যে ২০টি এবং সাভারের গণবিশ্ববিদালয়ের ১১টি পদের মধ্যে এগারটিতেই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ভূমিধস বিজয় অজর্ন করেছে। এ বিজয় দেশ-বিদেশের ইসলামী শক্তিসমূহকে আশান্বিত করেছে। বিদেশী রাষ্ট্রগুলো নড়েচড়ে বসেছে এবং আগামী দিনের রাজনীতি ও কূটনীতিকরা দিকনির্দেশক হিসেবে জামায়াতকে গণনায় এনে দলটি সম্পর্কে তাদের খোঁজখবর নেয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। কোনো কোনো মহল ইসলামী ছাত্রশিবিরের এ বিজয়ের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিজয়ের পূর্বাভাস দেখতে পারছেন। আবার যারা ইসলাম ও জামায়াতকে পছন্দ করেন না তাদের মধ্যে দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। একটাশ্রেণি এতই হতাশা ব্যক্ত করছেন যে, তারা প্রকাশ্যে বলছেন, জামায়াত যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তিনি বা তারা আত্মহত্যা করবেন। আবার একটি গ্রুপ জামায়াত ঠেকানোর জন্য লাঠি ব্যবহার করে অনিচ্ছুক ভোটারদের কাছ থেকে ভোট আদায়ের প্রকাশ্য ঘোষণা দিচ্ছেন। অর্থাৎ জামায়াত-শিবিরের উত্থানে কেউ উল্লসিত আবার কেউ হতাশাগ্রস্ত। এ হতাশাগ্রস্ততা তাদের কারুর কারুর মধ্যে প্রচণ্ড জিঘাংসার জন্ম দিচ্ছে বলে মনে হয়। নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের এবারের নির্বাচন জাতিকে চারটি ম্যাসেজ দিয়েছে : ১. স্বাধীনতা বিকৃতির ইতিহাস এ দেশে আর চলবে না, ২. গর্বিত মুক্তিযুদ্ধ কারুর বাবার সম্পত্তি নয়, ৩. জামায়াত রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধী এ ন্যারেটিভ আর চলবে না। আমাদের শিক্ষিত যুব শক্তি ইসলাম বিরোধী নয়, ইসলামের সহায়ক শক্তি এবং দেশপ্রেমিক। ৪. বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। এই দেশের মানুষ অন্য কোনো দেশের আধিপত্য মেনে নেবে না, সে দেশ যত বড়ই হোক না কেন।
শহরে-বন্দরে, হাটে-মাঠে-ঘাটে, যানবাহনে সর্বত্র মানুষ এখন নির্ভয়ে তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেছে। অধিকাংশ মানুষই বলতে শুরু করেছেন যে, এ দেশের মানুষ গত চুয়ান্ন বছরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শাসন দেখেছে, এবার তারা জামায়াতকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমানের জনবান্ধব আচরণ, দূরদর্শি নেতৃত্ব, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে ধর্ম, দল-মত নির্বিশেষে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুয়ারে ত্রাণ সহযোগিতা নিয়ে হাজির হওয়াসহ জামায়াত নেতাকর্মীদের সততা, নিষ্ঠা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মুগ্ধ করেছে। তাদের বিশ্বাস সততা ও সুশাসনের কষ্টি পাথরে অতীতের সরকারগুলো ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। জামায়াত ক্ষমতায় আসলে দেশ থেকে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন ও দুর্নীতি নির্মূল সহজতর হবে। জালেম, দুর্নীতিবাজরা ক্ষমতায় আসলে বৈষম্যহীন ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না।
জামায়াত ক্ষমতাকেন্দ্রিক কোনো রাজনৈতিক দল নয়; ইসলামী দাওয়া ও কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে মানুষের চরিত্র গঠন ও সমাজ বিনির্মাণে নিবেদিত একটি আন্দোলন। সমাজের অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বের প্রতিস্থাপন এ দলটির অন্যতম প্রধান কর্মসূচি। দলটি ক্ষমতা ও স্বার্থনির্ভর রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। পবিত্র কুরআনের সূরা হজ্জ এর ৪১নং আয়াত এবং সূরা হুজরাতের ১৫নং আয়াতে বিধৃত নির্দেশনা হচ্ছে তাদের তৎপরতা ও কর্মসূচির উৎস। সূরা হজ্জের ৪১নং আয়াতে বলা হয়েছে : ‘(এসব লোক হচ্ছে তারা) যাদের আমরা জমিনে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত প্রদান করবে, ভাল কাজের আদেশ দিবে, মন্দ কাজ করতে নিষেধ করবে। আর সব কাজের পরিণাম তো আল্লাহর দায়িত্বে।’
সূরা হুজরাতের ১৫নং আয়াতে বলা হয়েছে : ‘মুমিন হলো তারা যারা ইমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও তার রাসূল (সা.)-এর প্রতি এবং অতঃপর আর কোনো সন্দেহ পোষণ করেনি বরং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, মাল সম্পদ ও জানপ্রাণ দিয়ে। এরাই (ইমানের দাবিতে) সত্যবাদি।’
আগেই বলেছি জামায়াত প্রচলিত অর্থে ক্ষমতানির্ভর কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার অনুপ্রেরণার উৎস কুরআন সুন্নাহর দিকনির্দেশনা ও খোলাফায়ে রাশেদীনের দৃষ্টান্ত।
আলোচনার শুরুতে আমি বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে জামায়াতের ব্যাপারে জনমানুষের বর্ধিষ্ণু আকর্ষণ ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কথা বলেছিলাম। তারা জামায়াতকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। পক্ষান্তরে জামায়াত দেশ পরিচালনা ও নেতৃত্বের সুযোগ পেলে নিজেদের করণীয় তথা কর্মপন্থা সম্পর্কে কিছু কিছু কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে যার অর্থ দলটি দায়িত্বের বোঝা গ্রহণ করতে প্রস্তুত। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ অনুকূল বার্তা দিয়েছে। আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অনেকে প্রশ্ন করেন এ নির্বাচনে জামায়াত ও ইসলামপন্থী দলগুলো জোটবদ্ধভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বিদ্যমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামপন্থীরা কি ক্ষমতার মসনদে আসীন হতে পারবে? ইসলামবৈরী শক্তিসমূহ মিশর ও আলজেরিয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটাবে না তো? যদি দেশের আলেম-ওলামা ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং জামায়াত কৌশলী হয়, সামগ্রিকভাবে সকল খাতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করতে পারে তাহলে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট হাসিনার মতো ইসলামবৈরী শক্তিগুলোও পালাতে বাধ্য হবে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা দরকার। মুসলিম বিশ্বের বর্তমান সমস্যা হলো, এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রে স্বয়ং মুসলিমরাই মুসলমানদের শত্রু। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব উম্মার মৌলিক সমস্যাবলি অনুধাবন করতে পারেনি। একটি কার্যকর কৌশল নির্মাণ ও বর্তমান অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে এমন কর্মসূচি প্রণয়নে তাদের ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে হবে। জামায়াতকে প্রতিটি মুসলিম দেশের সাথে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া অপরিহার্য্য।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া যত কঠিন নয়, তার চেয়ে বেশি কঠিন কল্যাণকর কাজে ক্ষমতার প্রয়োগ ও তার Sustainability । ক্ষমতায় যাবার আগে কল্যাণকর কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু পরিকল্পনা যদি না থাকে তাহলে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যায় এবং মানুষের ঘৃণা অর্জন করতে হয়।
ফ্যাসিস্ট আমলে আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির সতেরটি খাতই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। শ্রমঘন শিল্পায়নের পরিবর্তে Capital intensive শিল্পায়নের নীতি অনুসরণ ও উৎপাদন বহির্ভূত (Unproductive) অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর জোর দেয়ার ফলে বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতিই শুধু বাড়েনি বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য ও চড়া সুদে নতুন ঋণ নিতে হচ্ছে। আমাদের সাংবিধানিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিচার ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। মানুষ ইনসাফের কাঙ্গাল হয়ে পড়েছে। খাত ওয়ারি রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ের জন্য জামায়াতকে তার নিজস্ব জনবল তৈরী ও কাজে লাগানো দরকার।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দ্বীনি শিক্ষায় সমৃদ্ধ এত বিশাল একটি জনবল বাংলাদেশে জামায়াতের ন্যায় অন্য কোনও দলের আছে কিনা আমার জানা নেই। চারদলীয় সরকারে জামায়াতের দু’জন মন্ত্রী প্রশাসনিক দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততার যে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে তা একটি অনন্য কীর্তি। ইসলামের আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার জন্য যে, আইনের দরকার তার অনুপস্থিতি আমাদের জন্য পীড়াদায়ক। তবে আশার কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে বর্তমানে যে, ফৌজদারি দেওয়ানি, পারিবারিক ও বাণিজ্যিক এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করা হয় তার ইসলামীকীকরণ খুব কঠিন বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে মরহুম শাহ আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে গঠিত ইসলামিক ল’ রিসার্স এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার বেশ কিছু মৌলিক আইন গ্রন্থ ও আরবী, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় প্রণীত ও প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু পুস্তকের বাংলা তরজমা প্রকাশ করেছে। আরবী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার জনাব সামছুল আলম ও বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের যথাক্রমে চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছেন এবং নিবন্ধকারও প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য হিসাবে দায়িত্বরত আছেন। এর কার্যক্রম আরো সম্প্রসারণ করা দরকার।
রাষ্ট্রীয়ভাবে চর্চা না থাকায় ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে বর্তমানে আমরা দরিদ্র হলেও অতীতের অনেক সম্পদ আমাদের কাছে আছে। মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীর সংকলিত ফতোয়াই আলমগীরী শরীয়া ভিত্তিক আইনের বিশাল একটি গ্রন্থ। আমাদের ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সকল আইন এতে সন্নিবেশিত আছে।
তৎকালীন মুগল সাম্রাজ্যের ৫ হাজার আলেম এ কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন। মুসলিম আইন সংক্রান্ত আরেকটি গ্রন্থ আছে যা আল হেদায়া নামে পরিচিত। তৎকালীন বৃটিশ সরকারের উদ্যোগে চার্লস হেমিলটন ৭৮৩ পৃষ্ঠার এই বিশাল গ্রন্থটি The Hedaya Musalman Law খধি শিরোনাম দিয়ে ইংরেজিতে তরজমা করে ১৮৬০ সালে বাংলার সাবেক গবর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে উৎসর্গ করেছেন। গ্রন্থটির রচয়িতা বুরহান আলদ্বীন আল মারগিনানী। ওসমানীয় খলিফাদের আমলেও ইসলামী আইন Codify করা হয়েছিল এবং তা আরো বিস্তৃত ছিল। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে বিস্তৃত ওসমানীয় খেলাফতের অধীনস্থ রাষ্ট্রসমূহে এ আইন অনুসরণ করা হতো। এটি মাজালা কোড নামে পরিচিত। আমাদের এ রত্নভাণ্ডারগুলো উদ্ধার করে জামায়াত জাতিকে পরিচালনায় এটি ব্যবহার করতে পারে। এ ব্যাপারে আলেম সমাজকেও এগিয়ে আসা দরকার বলে আমি মনে করি।