নজরুল রাসেল
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে মানুষের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোর অবাধ প্রদর্শনী। হাসপাতালের বিছানা, শ্রেণিকক্ষ, শোবার ঘর, এমনকি ওয়াশরুমে ধারণ করা ভিডিও কিংবা ছবি সামনে চলে আসেÑ কখনো নিজেদের আগ্রহে, কখনো কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের মাধ্যমে। লক্ষ্য একটাইÑ ভিউ বাড়ানো, ভাইরাল হওয়া, সেলিব্রেটি হয়ে ওঠা কিংবা ডলার কামানো। কিন্তু আমরা ভুলে যাই কোনটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখা উচিত আর কোনটি জনসমক্ষে আনা উচিত। নৈতিকতা যেন এখন অ্যালগরিদমের কাছে বন্দী।
অনেকদিন আগে এক জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায় একজনের ট্র্যাজেডির খবর ছাপা হয়। পাশে একটি কিউআর কোড ছিল; সেখানে লেখা, ‘...এর মায়ের কান্নার ভিডিও দেখতে কিউআর কোড স্ক্যান করুন!’ আমরা অনেকেই তখন সমালোচনা করে বলেছিলাম, ‘মায়ের কান্নাও কি বিক্রি হচ্ছে?’ কিন্তু আজ সে প্রশ্ন অপ্রয়োজনীয়; এখন শুধু কান্নাই নয়, মানুষের জন্ম, জীবনযাপন, এমনকি মৃত্যুযন্ত্রণাও বিক্রির পণ্যে পরিণত হয়েছে। আমরা যেন আজ মানবিকতা ভুলে, ব্যক্তিগত জীবনযাপন ও ট্র্যাজেডিকে কনটেন্ট বানানোর শিল্পে পরিণত করেছি।
গত ১৬ অক্টোবর এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। আমরা দেখেছি কীভাবে একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানের মেয়েদের ও সাথে তাদের মায়েদের আবেগ-উচ্ছ্বাসকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কনটেন্টে রূপান্তরিত করা হয়েছে। শুধু এ বছরই নয়, প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের দিনগুলোকে এভাবে বাণিজ্যিক আবেগের ফ্রেমে বন্দি করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব কনটেন্টের সহজ শিকার হচ্ছে আমাদের মেয়ে শিক্ষার্থীরা। তারা বুঝে-না বুঝে এসব ‘ভিউ ব্যবসায়ীদের’ ফাঁদে পা দিচ্ছে। বাড়তি হিসেবে এ বছর এর সাথে যুক্ত হয়েছে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মায়েরা।
আমরা একটু লক্ষ্য করলে দেখবো, প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর কেবল মেয়েদের ছবি ও ভিডিও-ই ছড়ানো হয়। কেন শুধু মেয়ে শিক্ষার্থীদের ফোকাস করা হয়, তার উদ্দেশ্য আমাদের কাছে এতটাই স্পষ্ট যে আলাদা ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না। মেয়েদের হাসি, কান্না, আবেগ নির্দ্বিধায় মিডিয়াকর্মী ও কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ক্যামেরায় বন্দি হয় এবং তা বাণিজ্যিকভাবে প্রচারিত হয়। আনন্দের মুহূর্তে তাদের অঙ্গভঙ্গি, গান গাওয়া, নাচের ভিডিও অবাধে রেকর্ড ও প্রচার করা হয়। এমনকি অহরহ সেসব ভিডিও কেটে আলাদা করে, ক্যাপশন দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভোক্তাদের কাছে ‘বিক্রি’ করা হয় (সরি, এটা আসলে বিক্রিই)। এই সকল মেয়ে শিক্ষার্থীরা জানতেও পারে না, তাদের সেই একান্ত মুহূর্তগুলো কীভাবে হাজারো চোখের ‘ভোগ্য’ বস্তুতে পরিণত হচ্ছে।
আবার এর উল্টো চিত্রও আছে। কিছু সেলিব্রিটিরা নিজেরাই পাপ্পারাজিদের মাধ্যমে নিজের গোপন মুহূর্তের ছবি ছড়াতে সাহায্য করেনÑ কারণ, সেলিব্রিটিদের আনুষ্ঠানিক ফটোশুট নয়, হঠাৎ তুলে ফেলা ‘উপস্ মোমেন্ট’ই মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করে বেশি। এসব ছবি ভাইরাল হলে তারা আলোচনায় আসেন, কাজ পান, অর্থ পান। উঠতি মডেল ও বয়সের কারনে তরুণীদের সাথে প্রতিযোগিতার পিছিয়ে পড়া সেলিব্রিটিরা (সবাই নয়) সাধারণত এরকম কৃত্রিম ‘উপস্ মোমেন্ট’ তৈরি করেন। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরণের চর্চা আমাদের দেশেও চোখে পড়ছে। বাস্তবতায়, ব্যক্তিগততাকে পণ্য বানানোই যেন আজকের দিনে ক্যারিয়ার তৈরির সহজ কৌশল।
এর আগে গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। সে’দিন থেকে গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে কনটেন্টের জোয়ার। বেঁচে যাওয়া কিংবা হতভাগ্য স্বজনদের শোকে কাতর চেহারাগুলোর উপর একেবারে ক্লোজ শটে ফোকাস করা হয়। কনটেন্ট নির্মাতা, মৌসুমি ভøগারদের উৎসাহ ছিল এসব মর্মান্তিকতা প্রকাশের দৌড়ে সবার আগে। উদ্ধারকাজ নয়, ট্র্যাজেডিকে প্রদর্শনের প্রতিযোগিতাই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছিল সেদিন। এ ধরনের ঘটনাগুলো আমাদের এমন এক নিউ-মিডিয়া বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায়, যাকে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য অবজার্ভারের সহকারী সম্পাদক রবার্ট ইয়েটস চিহ্নিত করেছেন ‘খুব খারাপ সংবাদ থেকে যৌনসুখ ভোগ’ হিসেবে। গার্ডিয়ানে লেখা এক ব্লগে তিনি বলেন, মানুষের দুর্ভাগ্যের প্রতি তীব্র আগ্রহই একধরনের অপার্থিব আনন্দ তৈরি করে। দুর্যোগ যত বড়, শোক যত গাঢ়, ততই মুনাফার সম্ভাবনা বেড়ে যায়Ñ এটাই আজকের দৃষ্টিভঙ্গি।
মিডিয়া কাভারেজ অনেকাংশেই এখন ‘ভয়্যুরিস্টিক’Ñঅন্যের ব্যক্তিগত কষ্ট দেখে একধরনের বিনোদন পাওয়ার নামান্তর। এ ভয়ঙ্কর প্রবণতায় সংবাদ-ভোক্তারাও এক ধরনের বদলি শোক অনুভব করেনÑ ক্যাথারসিসের নাম করে তারা পরিতৃপ্তি পান। ঘটনার সঙ্গে সম্পর্ক নেই, তবু ট্র্যাজেডির উপর মন্তব্য, শেয়ার করা যেন একধরনের নৈতিক অধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অদ্ভুত সহানুভূতি আমাদের আসল মানবিক চেতনার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন যেন এক তথ্যশ্মশান, সেটা ফিলিস্তিনের গাজা হোক বা ঢাকার উত্তরা। যেখানে ভাইরালের আশায় শিশুদের পোড়া শরীর, আইডি কার্ড, বইখাতা পর্যন্ত আপলোড হয়। নেটিজেনরা নিজেদের মানবিক দাবি করার সাথে সাথে এ ট্র্যাজেডিগুলোকে ব্যক্তিগত অর্জন বানিয়ে নিচ্ছেন এবং প্রোফাইল ভারি করে নিচ্ছেন। প্রতিটি ট্র্যাজেডি এখন একটি ট্রেন্ডিং বিষয় হয়ে উঠছে, ব্যক্তিগত ক্ষতিকে জনসাধারণের নাট্যমঞ্চে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি, এ সমস্ত ট্রেন্ডিং মূলত শোকের উপর দাঁড়ানো নিষ্ঠুর মুনাফাবাণিজ্য।
এ রোগটি বিশ্বব্যাপী; কিন্তু আমাদের দেশে এর বিস্তার বিশেষভাবে মারাত্মক। এখন রাস্তার পাশে কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলে আমরা প্রথমেই তার পাশে দাঁড়াই না; মোবাইল বের করি, ভিডিও করি, কখনো কখনো লাইভে যাই! আগুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যাÑসবই এখন কনটেন্ট। আমাদের মানবিকতার অস্তিত্ব মুছে যাচ্ছে প্রযুক্তির চটকদার ব্যাকগ্রাউন্ডে। সমাজজুড়ে চলছে এক করুণ স্বার্থপরতার মহড়া, যেখানে ব্যথা, কান্না, চিৎকারও বিনোদনের উপকরণ। ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুদের মুখ, কিশোরীদের আত্মহত্যার নোট, এমনকি আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের শেষ মুহূর্তগুলোÑকিছুই কনটেন্টের বাইরে নয় এখন।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টাইমসের লেখক ক্যারল সার্লার ‘দিজ নিউ অ্যান্ড পিকিউলার পর্নোগ্রাফি অব গ্রিফ’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘শোকের এই নতুন ও অদ্ভুত পর্নোগ্রাফি’কে অনেক সময় ‘উৎসর্গ’ নামে ডাকা হয়। একটি মৃত্যু, একটি কান্না, একটি পুড়ে যাওয়া শরীরÑ এগুলো এখন শুধু লাইক, শেয়ার আর রিলস্। এই নির্মম সত্যই আজকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিচ্ছবি। আমরা সবাই যেন এক অদৃশ্য কন্টেন্টভুক শ্রেণির সদস্য, যাদের চোখে ট্র্যাজেডিরও বাজারমূল্য নির্ধারিত।
ফরাসি দার্শনিক গাই ডিবর্ড বহু আগেই এ ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ আঁচ করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘দ্য সোসাইটি অব স্পেকটেকল’-এ তিনি লিখেছিলেন, ‘যে জীবন আগে যাপন করা হতো, তা এখন উপস্থাপনে সীমাবদ্ধ। এখন ইমেজ আমাদের বাস্তবতা নির্ধারণ করে, অনুভবকে বিকৃত করে। আমরা এখন জীবন বাঁচি না, দেখি; অনুভব করি না, কনজিউম করি। এমন বাস্তবতায় এসে প্রশ্ন থেকেই যায়: মানুষের অন্তর্জগৎ কি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্রির সামগ্রী? কৃত্রিম দুঃখে ভেসে, প্রকৃত মানবিকতায় বিস্মৃত না হয়ে, আমরা কি আরেকটি রিল, আরেকটি পোস্ট, আরেকটি ভাইরাল ছাড়া আর কিছুই চিন্তা করতে পারছি না? যদি এসবের উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে আমাদের এ প্রবণতা হবে মর্মান্তিক-কিন্তু বাস্তব।
লেখক : প্রাবন্ধিক