প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য খাবারের প্রয়োজন হয়। দুমুঠো ভাত নিশ্চিত করার স্বার্থে মানুষ দেশ থেকে দেশান্তরে পাড়ি দেয়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। খাবার প্রয়োজন না হলে মানুষ পরিশ্রম করত না। অথচ এ খাবার কারও কারও কাছে বিলাসিতা। বিয়ে-শাদি, আকিকা, খতনা বা জন্মদিনে খাবার অপচয়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এসব অনুষ্ঠানে যে পরিমাণ খাবার নষ্ট করা হয়, তা দিয়ে আরও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব। অথচ এক সময় মানুষ খাবার শেষ হয়ে গেলে প্লেট চেটে খেত। একটি ভাত মাটিতে পড়ে গেলে তুলে আবার খেত। রাতের ভাত সকালে খেত। পান্তাভাত বলে ফেলে দিত না। এখন ১ বৈশাখ এলেই পান্তাভাত খাওয়ার আয়োজন করা হয়। বর্তমানে অপচয় করাকে অনেকেই স্মার্টনেস মনে করেন। যার যতটুকু খাবার প্রয়োজন, তার চাইতে বেশি খাবার যখন পরিবেশন করা হয়, তখন অধিকাংশ খাবারই যায় ভাগাড়ে। অথচ বিশ্বের বিশাল একটি অংশ এখনও অনাহারে বা অর্ধাহারে দিন পার করছে। আজকার খাবার যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিবেশন করা হয়। ফলে অধিকাংশ খাবারই চলে যায় ভাগাড়ে। এভাবে যদি খাবারের অপচয় চলতে থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে। তখন টাকা পয়সা থাকলেও খাবার কেনা কঠিন হয়ে পড়বে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি নরপশুদের নির্বিচার হামলায় ক্ষুধার্ত শিশুরা একমুঠো খাবারের জন্য বুলেটের সামনে জীবন দেয়। ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভুগছে গাজার শিশুরা। তাদের কাছে একমুঠো খাবার কত মূল্যবান-তা অপচয়কারী মানুষেরা কখনো অনুধাবন করতে পারবে না। যারা অপচয় করে, তাদের কখনো খাবারের জন্য যুদ্ধ করতে হয়নি। ফলে তারা মনের অজান্তে ডাস্টবিনে খাবার ফেলে দিতে কুন্ঠাবোধ করেন না।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৮২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত কাটায়, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনা বলা হয়, বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। জাতিসংঘ আশঙ্কা করেছে, ২০২৫ সালে প্রায় ১২ কোটি মানুষ চরম খাদ্যসংকটে পড়বে। অথচ এ সময়ে ধনী দেশগুলোর সাহায্য হ্রাস পাচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। জাতিসংঘের মতে, ২০২৫ সালে ৩০ কোটি ৭০ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষের মধ্যে ১১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের কাছে খাবার পৌঁছানো সম্ভব হবে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা না-ই বা বললাম। আজকের নতুন প্রজন্ম হয়তো ইতিহাসের পাতায় কিংবা পাঠ্যপস্তুকে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, পঞ্চাশের মন্বন্তর কিংবা ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের কথা পড়েছে, কিন্তু চোখে দেখেনি। দুর্ভিক্ষ কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা খাদ্য ঘাটতির কারণে হয় না; বরং, অর্থনৈতিক বৈষম্য, মজুরি হ্রাস, কর্মসংস্থান সংকট ও খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় ত্রুটির সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৭৭০ সালে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বাংলা ১১৭৬ সন) ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল। এটি বাংলার ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। এ দুর্ভিক্ষে বাংলার জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মৃত্যবরণ করেছিল। অনেকের মতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। আর ১৯৪৩ সালের (বাংলা ১৩৫০ সাল) ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশে ঘটেছিল। এ দুর্ভিক্ষে আনুমানিক ৩০ লক্ষ মানুষ অনাহারে বা অপুষ্টিতে মারা গিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবের শাসনামলে দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল ২৭ হাজার, তবে বেসরকারি হিসেবে প্রায় ১ লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল। শুধু নিম্নবিত্ত নয়; মধ্যবিত্তরাও খেয়ে না খেয়ে কোনোভাবে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। বহু মানুষ খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিল। অথচ আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মী, এমপি, মন্ত্রী এবং আমলারা আয়েশী জীবনযাপনে ব্যস্ত ছিল। অবস্থা কতটা ভয়াবহ ছিল তা কবি রফিক আজাদের কবিতায় উঠে এসেছে। তিনি সে সময় লিখেছিলেন-‘‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো।’’ এই দুর্ভিক্ষের দায় আওয়ামী লীগ এড়াতে পারে না। কারণ কারও শাসনামলে যখন কোন দুর্যোগ কিংবা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তখন সেই সরকারকেই তার দায় নিতে হয়।
ইসলাম মানুষকে অপচয় ও অপব্যয় করতে নিষেধ করেছে। অপচয়কে নিরুৎসাহিত এবং মিতব্যয়ীতাকে উৎসাহিত করেছে। অপচয় ও অপব্যয় করলে মানুষের জীবন থেকে বরকত উঠে যায়। ফলে ধন-সম্পদ হ্রাস পায়। খাবার নষ্ট করা শুধু অমানবিকই নয়; বরং এটি গুনাহের কাজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে এরশাদ করেন, ‘তোমরা খাও, পান করো ও অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সুরা আরাফ: আয়াত ৩১) কিন্তু আমরা যদি আমাদের চারপাশে তাকাই, দেখি- শুধু অপচয় আর অপচয়। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে বিয়ের অনুষ্ঠান, হোটেল রেস্তোরাঁ- এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে খাবার নষ্ট হচ্ছে না। বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা অনেকে চোখের ক্ষুধায় অতিরিক্ত খাবার প্লেটে নেই। কিন্তু খেতে পারি না। এমনকি ছোট বাচ্চার প্লেটেও অতিরিক্ত খাবার তুলে দিই। কিন্তু একবারও চিন্তা করি না-বাচ্চাটি খেতে পারবে কি না। খাবার নষ্ট করা অনেকের কাছে সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আধুনিকতার প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে আমরা পুরো খাবারটি শেষ না করেই রেখে উঠে যাই। অথচ ইচ্ছে থাকলে খাবার নষ্ট না করেও পারা যায়। এ সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সহজ একটি উপায় হতে পারে- বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট কিংবা বিয়ের মতো অন্য যে কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত মেহমানদের পরিবেশিত খাবারের সাথে একটি অতিরিক্ত প্লেট দেয়া যেতে পারে, যাতে যা খাওয়া হবে না, তা সেখানে রেখে দেয়া যায়। এ নিয়ম পালন করলে খাবারের অপচয় কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব।
খাবারের অপচয় গ্রামীণ জনপদে ছিল না। কিন্তু এখন আধুনিকতার হাওয়া লেগেছে গ্রামেও। খাবার শেষ করার সে চিরায়ত দৃশ্য আর তেমন দেখা যায় না। তারাও এখন অপচয়ের দিক থেকে পিছিয়ে নেই। গ্রামের মানুষ তথাকথিত আধুনিকতার দিকে ছুটছে। আগের মতো প্লেট চেটেপুটে খায় না। অপচয়কে এখন আর অপচয় মনে হয় না। যেন এটি এক ধরনের বিলাসিতা। একদিকে খাবারের অপচয়ের উৎসব, অন্যদিকে গরিব মানুষেরা একমুঠো ভাতের অপেক্ষায়- এ চিত্র মহান আল্লাহতায়ালার আরশকে নাড়িয়ে দেয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে বছরে পরিবারপ্রতি গড়ে ৬৫ কেজি খাবার অপচয় হয়। আর গৃহস্থালি থেকে প্রতিবছর দেশে মোট খাদ্য অপচয়ের পরিমাণ ১ কোটি ৬ লাখ টন। প্রতিবছর পৃথিবীতে যে পরিমাণ খাবারের অপচয় হয় তা দিয়ে ৮২ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি মাসে ১০ হাজার শিশু খাবারের অভাবে মারা যায়। প্রতিদিন বিশ্বে ৮২ হাজার মানুষ না খেয়ে ঘুমায়। বিশ্বে উৎপাদিত খাবারের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ নষ্ট করে, যার পরিমাণ প্রায় ১৩০ কোটি টন। খাদ্য অপচয় রোধে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, যেমন : বাসাবাড়িতে পরিমাণ মত রান্না করা, খাদ্য সামগ্রী সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা, বিয়েতে বা বুফে সিস্টেমে অপচয় রোধে সচেতনতা, সকল অনুষ্ঠানে প্রয়োজন অনুসারে খাবার পরিবেশন করা, অতিরিক্ত খাবার ছিন্নমূল ও পথশিশুদের মধ্যে বণ্টন করা। আমাদের সবাই মনে রাখতে হবে- খাদ্য অপচয় কোন ফ্যাশন নয়, বরং এটি গর্হিত, অমানবিক এবং গুনাহের কাজ। ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়তে হলে আমাদের সবার উচিত খাবারের অপচয় রোধে সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা। লেখক : প্রাবন্ধিক।