DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

‘মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না’

আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন পবিত্র কুরআন মজিদে মুমিনদের অনেক মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মুমিনদেরকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদেরকে চিরস্থায়ী জান্নাত দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

Printed Edition

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন পবিত্র কুরআন মজিদে মুমিনদের অনেক মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মুমিনদেরকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদেরকে চিরস্থায়ী জান্নাত দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। পাশাপাশি তিনি তাঁর এ প্রিয় বান্দাদের জন্য কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্যও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আসলে মুমিনের মর্যাদা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের উপরই একান্তভাবে নির্ভর করে।

ঈমানদারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন আল কুরআনে বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তার মধ্যে একটি হলো মুসলিম হওয়া। আল্লাহ বলেন-“হে মু’মিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর যেভাবে তাঁকে ভয় করা উচিত। আর তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে মৃত্যুবরণ করোনা। আর তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে (আল কুরআনকে) আঁকড়ে ধরো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন (দলাদলিতে লিপ্ত) হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালবাসার সঞ্চার করলেন, অতঃপর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেল। আর তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বয়ান করেন, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১০২-১০৩)

মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন মুমিন বা ঈমানদারদের নির্দেশ দিচ্ছেন মুসলিম হওয়ার জন্য। সুতরাং ‘আমার ঈমান আছে’-এই আত্মতৃপ্তি নিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। মুসলিম শব্দের অর্থ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা, আল্লাহর হুকুম বা ইচ্ছার নিকট নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেয়া। অর্থাৎ একজন মানুষ যখন আল্লাহকে নিজের সৃষ্টিকর্তা, মালিক, প্রতিপালক, অভাব পূরণকারী, সর্বশক্তিমান প্রভু এবং উপাসনা, ভক্তি ও কর্তৃত্ব লাভের একমাত্র অধিকারী বলে আন্তরিক বিশ্বাস ও প্রকাশ্য মৌখিক স্বীকৃতির মাধ্যমে ঈমানের ঘোষণা দেয়, তখন তার ঈমানের অনিবার্য দাবি হয়ে ওঠে নিজের স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করে আল্লাহ’র নিকট আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দেয়া, তাগুত ও প্রবৃত্তির দাসত্বকে প্রত্যাখ্যান করে স্বেচ্ছায় আল্লাহর ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পণ করা, নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ’র হুকুমের নিকট সোপর্দ করে দেয়া। এর মাধমেই ঈমানের দাবিতে কে কতটা সত্যবাদী তা প্রমাণিত হয় এবং ঈমান পূর্ণতা লাভ করে। মূলত মুসলিম হওয়া মানে বিশ্বাসকে কাজে পরিণত করা। এ কারণেই ফকীহগণ বলেন, ঈমান হল আন্তরিক বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং বাস্তবে আমল করা।

উপরে বর্ণিত আয়াতে আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করার কথা বলা হয়েছে। সাধারণভাবে আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করার মানে হচ্ছে তিনি যা আদেশ করেছেন তা যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে মেনে চলা (যেমন: নামায, রোজা, হজ¦, যাকাতসহ এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, সতর্ক থাকা বা পরহেজ করা। এছাড়া বিশেষ কোন নির্দেশনা দেয়ার আগের বা পরের আয়াতেও আল্লাহ তাঁকে ভয় করার কথা বলে থাকেন বান্দাকে হুঁশিয়ার বা সতর্ক করার জন্য, যাতে নির্দেশনাটির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়। এখানে আল্লাহকে ভয় করতে বলার পর কয়েকটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে, ‘মুসলিম’ না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ অর্থাৎ-মুসলিম হওয়ার বিষয়টাকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে নিতে হবে, এ ব্যাপারে কোন শৈথিল্য দেখানো চলবে না। মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করার ব্যাপারে চরম সতর্ক করা হয়েছে। তাই আমাদেরকে সব সময় আল্লাহ’র আনুগত্যের মধ্যে থাকতে হবে। আমাদের মৃত্যু যেন এমন অবস্থায় না হয় যখন আমরা থাকব কুফরির হালতে, আল্লাহর অবাধ্য ও নাফরমানির হালতে (আল্লাহ মাফ করুন); তাহলে আমরা চরম ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হব। কেউ যদি নাফরমানির হালতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, তখন তার তওবা আল্লাহ কবুল করবেন না। আল্লাহ বলেন: ‘‘আর তাদের জন্য ক্ষমা নেই, যারা ঐ পর্যন্ত পাপ করতে থাকে যখন তাদের কারো নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়; আর তখন বলে: নিশ্চয়ই আমি এখন তাওবা করছি’’। (সূরা নিসা : ১৮) তবে অসাবধানতাবশত, ভুলবশত কেউ যদি কোন গুনাহ করে ফেলে এবং সম্বিত ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ বলেন- “অবশ্যই আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করবেন যারা ভুলবশতঃ মন্দকাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে, এরাই হলো সে সব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন’’। (সূরা নিসা: ১৭)

এরপর যে নির্দেশনাগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো: ১) আল্লাহ’র কালাম আল কুরআনকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরা; ২) দলাদলিতে লিপ্ত না হওয়া ৩) মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ সমুন্নত রাখা।

মুসলিম হওয়ার আদেশ দেয়ার পর আল্লাহ এই তিনটি মূলনীতি মেনে চলার নির্দেশনা দিলেন। মূলত এসব মূলনীতির উপর মুসলিম থাকা একান্তভাবে নির্ভর করে।

হযরত যিয়াদ বিন লুবাইদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন একটা বিষয় উল্লেখ করেন এবং বলেন, “ওটা এমন সময় ঘটবে যখন দ্বীনের ইলম বিদায় নেবে।” আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, ইলম কিভাবে চলে যাবে? আমরা আল কুরআন পড়ছি এবং আমাদের সন্তানদের তা শিখাচ্ছি। তারা আবার তাদের সন্তানদেরকে শিখাবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাকে মদীনার প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের একজন বলে মনে করতাম। তুমি কি দেখছো না ইয়াহুদী এবং নাছারাগণ তাওরাত এবং ইঞ্জিল পড়ছে অথচ ঐগুলোর শিক্ষার আলোকে কাজ করছে না?”

অর্থাৎ, আমরা যদি আল্লাহ’র কালাম আল কুরআনের শিক্ষা অনুসারে কাজ না করি তাহলে আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে দ্বীনের জ্ঞান তুলে নেবেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের অনুসরণ করবে দুনিয়ার জীবনে সে পথভ্রষ্ট হবে না। আখিরাতেও সে ভাগ্যাহত হবে না।” অতঃপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ- যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে দুনিয়ার জীবনে সে পথভ্রষ্ট হবে না। আখিরাতেও ভাগ্যাহত হবে না।”-[সূরা ত্বা-হা: ১৬৩]-মিশকাত

প্রথমত, আল কুরআন হলো ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস ও মুসলিম ঐক্যের মূল সূত্র। জ্ঞানের এই মূল উৎস থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই মুসলিম উম্মাহ’র চিন্তা- চেতনায় জাহেলিয়াত দানা বাঁধতে থাকে। একই সাথে বাড়তে থাকে অনৈক্য, হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি।

বস্তুত, মানুষ যখন আল্লাহর কালামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায় তখন মনগড়া ধারণা কল্পনাকেই তার পথ প্রদর্শক বানিয় নেয়। আর আন্দাজ-অনুমান ও মনগড়া ধারণা- কল্পনা যখন আল্লাহ’র কালামের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় তখনই মানুষ সিরাতুল মুসতাকিমের সঠিক পথ থেকে ছিটকে পড়ে বহু বিভ্রান্ত মত পথের মরীচিকায় হারিয়ে যায় এবং ঐক্যের মূল সূত্র ছিন্ন হয়ে বিভেদ ও দলাদলিতে লিপ্ত হয়।

এছাড়া বস্তুগত স্বার্থ, লোভ, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভের মোহে পড়েও জেনে শুনেও কিছু মানুষ মুসলমানদের বৃহৎ স্বার্থ ও ঐক্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। মদীনার ইহুদীরা মুহাম্মদ (স.)-কে সত্য নবী জানা সত্ত্বেও শুধুমাত্র গোষ্ঠীয় অহমিকার কারণে তাঁকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। এমনকি তাদের মধ্যে আসমানি কিতাব বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও শুধু বৈষয়িক স্বার্থ ও আধিপত্য লাভের জন্য তারা বহু দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের দৃষ্টান্ত দিয়ে আল্লাহ মুসলিমদের সতর্ক করে বলেছেন- “আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর। আর তাদের জন্যই রয়েছে কঠোর আযাব।” (আলে ইমরান: ১০৫)

জাহেলিয়াতের যুগে আরবের অধিবাসীরা ছিল শত গোত্রে বিভক্ত এবং তাদের মধ্যে গোত্রীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধ লেগেই থাকতো। বিশেষ করে মদীনার প্রধান দুই গোত্র আউস ও খাজরাজের মধ্যে ভয়াবহ দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগেই থাকতো যা তাদেরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র আল্লাহ’র রাসূলের নেতৃত্বে কুরআনের শিক্ষা ও আদর্শের আলোকে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে সমাজ ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কারণেই তারা সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। যত দিন মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ ছিল ততদিন তারাই ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সভ্যতা ও চরিত্রে পৃথিবীর সেরা। ততদিন তারাই বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, মানব জাতিকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন এবং অন্যায় ও ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন। তখন মুসলিম উম্মাহ সত্যিকার অর্থেই ছিলেন মানবতার কাণ্ডারি। একদিকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য মক্কার মুসলমানরা যেভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশে নিজেদের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি ও স্বজনদের ছেড়ে মদিনায় হিজরত করে ত্যাগ ও কুরবানির অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন; তেমনি মদিনার মুসলিমরাও মক্কার মুহাজির ভাইদেরকে নিজেদের বাড়ি-ঘরে আশ্রয় দিয়ে, সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে উদারতার অতুলনীয় নজির স্থাপন করেছিলেন।