নূরুন্নাহার নীরু

ইদানীং আরবী দিনপঞ্জিকা তৈরি নিয়ে দাবি উঠছে। কথা হচ্ছে, আমি মনে করি বিষয়টা গুরুত্বের সাথে নেয়া দরকার বিদগ্ধজনদের। কারণ আমরা দেখছি এবং মেনেও চলছি আরবী বছরের বিভিন্ন দিন, মাস, সময়কে মুসলিম জীবনে ধারণ করতে। ছোট বেলায় দেখতাম মা-বাবা কত যত্ন করে রাখতেন একটি আরবী পঞ্জিকা পেলে। আরবী মাস প্রধানত, হিজরী সন গণনার সাথে সম্পৃক্ত।

হযরত আবু বকর (রা:) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সা:) তার বিদায় হজের ভাষণে বলেন, জামানা ঘুরে ঘুরে নিজের মূল অবস্থায় এসে গেছে। বছরের বারটি মাস হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে চারটি সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন মাস। ক্রমিক ভাবে রয়েছে তিনটি।”

সুরা তওবার ৩৬নং আয়াতে আল্লাহ মহান বলছেন: “আল্লাহর কাছে আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিক থেকে গণনার মাস ১২টি। এর মধ্যে ০৪টি পবিত্র মাস। যা হারাম বলে গণ্য। এটাই প্রতিষ্ঠিত বিধান।” হারাম বলতে নিষিদ্ধ ও পবিত্র দুটোই বুঝায়। হাদীসের আলোকে এ হারাম মাসগুলো হলো: যুলক্কাদা, যুলহাজ্জা, মহাররম ও জমাদিউসসানি ও শাবানের মাঝে “রজ্জব” (রজব)।

আরবীতে ১২ মাসেরই পৃথক পৃথক পূর্ণঅর্থ রয়েছে এবং রয়েছে কিছু তাৎপর্যও। মুসলিমদের জীবনে এ বারোটি মাসেরই বেশ কিছু চর্চাও লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে যারা ধর্মভীরু, যারা ধর্মীয় বিধিবিধানগুলো সঠিকভাবে পালন করতে উদ্বুদ্ধ। আরবী মাসগুলো যেহেতু চান্দ্রমাসের হিসেবে পরিলক্ষিত এবং রাসূল (সা:)-এর মদীনায় হিজরতের পর থেকে হিসেবে পরিগণিত সেমতেই মাসগুলোরও চর্চা হয়ে থাকে। যেমন :

১। মহররম : এটি হলো চান্দ্রমাসের হিসেব অনুযায়ী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। “মুহররম” শব্দের অর্থ পবিত্র বা সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকেই মাসটি পবিত্র হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। মহররম মাস ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। যেহেতু এর সাথে জড়িত আছে “আশুরা।” আশুরা অর্থ দশম। এ মাসের ১০ তারিখই হচ্ছে বিশেষভাবে মর্যাদাসম্পন্ন আশুরা। এদিনে রোজা রাখার গুরুত্ব অপরিসীম।

২। সফর : সফর শব্দের অর্থ ফাঁকা বা শূন্য এ মাসে আরবরা যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ভ্রমণে কাটিয়ে দিতে বেরিয়ে পড়তো সেজন্য তাদের ঘর ফাঁকা হয়ে থাকতো বলেই বলতো “সাফার আল মাকানা”।

৩। রবিউল আউয়াল : রবি অর্থ বসন্ত, আর আউয়াল অর্থ প্রথম। মানে বসন্তের প্রথম মাস। এ মাসে আরবরা বাড়িতেই অবস্থান করত, এর জন্য বলা হত ইরতাবা’আ। এ মাসেই বিশ্ব নেতা রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর জন্ম ও ওফাত হয়েছে এবং দিবস ছিল সোমবার। এমন কি মদিনায়ও হিজরত করে এ মাসেই তিনি পৌঁছেছেন। ফলে এ মাসটির ঐতিহাসিক মাহাত্ম্য অনেক। বলা যায় মুসলিম সমাজে বরিউল আউয়াল পালন করা হয় মহাসমারোহে। যার জন্য সফর মাস থেকেই তার প্রস্তুতি চলতে থাকে।

৪। রবিউস সানি : এর অর্থ বসন্তের দ্বিতীয় মাস। এটি আগের মাসের ধারাবাহিকতা হিসেবে এসেছে। এ সময়ে আরবরা বাড়িতেই অবস্থান করতো বসন্তের দ্বিতীয় মাস হিসাবে। তাই একে রবিউল আখিরও বলা হয়।

৫। জমাদিউল উলা বা আউয়াল : জুমাদা অর্থ জমে যাওয়া বা হিম হওয়া। এ মাসে আরব অঞ্চলে শীতকাল থাকতো, পানি জমে যেত। তাই এর এরূপ নামকরণ। এটি শীতকালীন মাসগুলোর প্রথম।

৬। জমাদিউস সানিয়া : এর অর্থ শীতের দ্বিতীয় মাস। এটিও পূর্ববর্তী মাসের ধারাবাহিক জনিত নাম।একে জমাদিওল আখির ও বলা হয়।

বলা যায় রবিউসসানি থেকে জমাদিউসসানি পর্যন্ত তেমন কোন বিশেষ দিবস না থাকলেও বিশ্বনবী (সা:)-এর উপর আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এমনকি প্রতিযোগীতার ধারাবাহিকতা চলতে থাকে ক্রমান্বয়ে এ দীর্ঘ সময় ধরে। অর্থাৎ সচেতন মুসলিমরা এ মাসগুলোতেও ইসলামী সংস্কৃতির চর্চায় নিবিষ্ট থাকে।

৭। রজব : এ শব্দটির অর্থ হচ্ছে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা। এটি তারজিব শব্দ থেকে গৃহীত। এ মাসটিও চারটে হারাম মাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। মূলত মুসলমানদের হাজ্জ ও ওমরা নিরাপদে পালনের সুবিধার্থে এ মাসকেও পবিত্র ও হারাম মাস গুলোর সাথে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। এর পবিত্রতা রক্ষার্থেই কোন মুসলিম এ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ বা রক্তপাতে লিপ্ত হতে পারে না। উপরুন্তু মহানবী (সা:) ঘোষণা দিয়েছেন, “তোমরা রজব থেকে রমজানের প্রস্তুতি নাও।” বলা যায় রমজানের দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার জন্য এটি হচ্ছে মানসিক প্রস্তুতির মাস। এ মাসের ২৭তাং মেরাজ সংঘটিত হয়।

৮। শাবান : শাবান শব্দটি ‘শাআব’ ধাতু থেকে এসেছে যার অর্থ বিছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়া। এ মাসে আরবরা বিভিন্ন দিকে যুদ্ধ ও লুটপাট করে রসদ সংগ্রহে ছড়িয়ে পড়তো। কিন্তু মহানবী (সা:) এসে একে রমজান মাসের প্রস্তুতি হিসাবে ইসলামী সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। এ মাসেই রয়েছে ১৫ শাবান যা শবে বরাত নামে জাতির কাছে তাৎপর্যময়। এ মাস এলে রাসূল (সা:) রমজানের জন্য আরো বিশেষভাবে প্রস্তুতি নিতে নফল রোজা রাখায় উৎসাহিত করতেন।

৯। রমজান : এটি রমজ ধাতু থেকে এসেছে। এর অর্থ জ্বলন্ত তাপ বা দহন। অত্যধিক গরমের জন্যই এ মাস টার নাম রমজান বা রামাদান। যা বান্দার গোনাহ কে দগ্ধ করে পাপ মুক্ত করে। এ মাসটি হচ্ছে মুসলিমদের জন্য সিয়াম সাধনার মাস। যার অর্থ বিরত থাকা অর্থাৎ এটি সংযম শীলতার মাস। ইসলামী সংস্কৃতিতে এটি মুসলিমদের জন্য একটি আত্মশুদ্ধির মাস, প্রশিক্ষণের মাস। এ মাসেই কুরআন নাজিল হয়েছে যা অত্যন্ত বরকত ময়। এ মাসের শেষ দশ দিনকে মাগফেরাত ও নাজাতের দিবস বলা হয় এবং বেজোড় রাত গুলোতে কদর অন্বেষণের জন্য তাকিদ দিয়েছেন রাসূল (সা:)।

১০। শাওয়াল : এ শব্দটি ‘শাওল’ ধাতু থেকে এসেছে যার অর্থ উপরে ওঠা বা হালকা হয়ে যাওয়া। বলা হয় এ মাসে উটনীর দুধ কমে যেত বলে এ নাম করণ হয়েছিল। তবে ইসলামের ইতিহাসে এই মাসটি একটি মহান মাস এই কারণে যে এর প্রথম দিনেই হচ্ছে ঈদুল ফিতর যা তৎকালীন নওরোজ ও মেহেরজান নামক দুটি উৎসবের পরিবর্তে মুসলিমদের জন্য নির্ধারিত আন্দদিবস। ফিতর অর্থ খোলা বা উন্মুক্ত হওয়া। দীর্ঘ একমাস রমজানে সিয়াম সাধনার পর এ দিনটিতে বিশ্ব মুসলিম ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করে থাকে। রমজানের পর আরো ছয়টি রোজা রাখার হুকুমও এ মাসেই যা অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহণ করে থাকে মুসলিম সমাজে।

১১। জিলকদ : যার অর্থ বসা বা স্থির হওয়া। এ মাসটি আল কুরআনে বর্ণিত সে চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে প্রথম মাস। এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য হচ্ছে, এ মাসেই পবিত্র হজ্জের জন্য মুসলিমদের প্রস্তুতি এবং যাতায়াতের সুবিধার জন্য পবিত্র মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ রয়েছে। এ মাস থেকেই মুসলমানদের হজ্জে গমনের সাজ সাজ রব পড়ে যায়।

১২। জিলহজ্জ : হজ্জ অর্থ সংকল্প বা ইচ্ছা পোষণ করা। এ মাসেই জীবনে একবার হলেও সামর্থবান মুসলিমের জন্য কাবা ঘর যিয়ারত করা ফরজ হুকুম। যা পালন করতে আরো কিছু আনুষাঙ্গিক হুকুমাদি রয়েছে। এটিই হচ্ছে মুসলিমদের সর্ব বৃহৎ সম্মেলন। এ জন্যই এ মাসকেও যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থেকে পবিত্র মাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং এটিই চাঁদের হিসেবে বছরের শেষ মাস।

এ মাসের প্রথম দশ দিন মুসলিমদের জন্য বিশেষ ইবাদাতের দিন। দশ তারিখকে বলা হয় আরাফা দিবস আর ঐ দিনই হলো বিশ্ব মুসলিমের ঈদুল আযহা পালন উৎসব দিবস। পরের ১১, ১২, ১৩, এই তিনদিনকে ধরা হয় আইয়ামে তাশরীফ যা হজ্জের আনুষাঙ্গিকতা পালনের জন্য বরাদ্দকৃত। এ সময় গুলো ঈদুল আযহা উদযাপনের জন্যও নির্দিষ্ট।

মূলত এ বারোটি মাসের বর্ণিত বিশেষ বিশেষ দিবস ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে পালন করা হয় জুম্মাবার এবং প্রতি মাসেই আইয়ামে বীজ নামে রাখা হয় নফল রোজা চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তাং-এ। এ ছাড়াও সোমবার ও বৃহস্পতিবার দিনগুলোতে নফল রোজা পালন করা হয়ে থাকে।

ইসলামে নফল রোজা রাখার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বাধ্যতামূলক নয়, যেকোনো দিনই নফল রোজা রাখা যায়। তবে, উক্ত দুদিনের নফল রোজা রাখার বিশেষ কিছু ফজিলত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন :

আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা: হাদিসে বর্ণিত আছে যে, প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ দিনে রোজা রাখা পছন্দ করতেন, যাতে তার আমল রোজাদার অবস্থায় আল্লাহর কাছে পেশ হয়।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “সোমবার ও বৃহস্পতিবার (মানুষের) আমল (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। আমি চাই আমার আমল পেশ করার সময় আমি রোজাদার অবস্থায় থাকি।” (তিরমিযী, নাসায়ী)

সুন্নত পালন: যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে এ দিনে রোজা রাখতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন, তাই বৃহস্পতিবার রোজা রাখা একটি সুন্নত হিসেবে গণ্য হয়।

নফল ইবাদতের সওয়াব: অন্যান্য নফল ইবাদতের মতোই, বৃহস্পতিবার নফল রোজা রাখলে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব পাওয়া যায়। এটি আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম।

সুতরাং বলা যায়; প্রতিটি মাসই এবং ঐ মাসগুলোর অন্তর্ভূক্ত কোন কোন দিবসও মুসলিম জীবনে কিছু না কিছু ইতিহাস- ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি বহন করছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে। সেজন্য মুসলমানদের জীবনে বাংলা, ইংরেজির মত আরবি মাসের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। বরং এর মধ্যেই মুসলিম জীবন তথা ইসলামী সংস্কৃতি আবর্তিত। তাই আরবী দিনপঞ্জিকা তৈরি সময়ের দাবি বটে।

লেখক : কবি, লেখক ও সংগঠক।