আসিফ আরসালান
বৃহস্পতিবার ৯ অক্টোবর সব দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে সন্ধ্যা বেলায় খবর দেয়া হয়েছে যে, জুলাই সনদ স¦াক্ষরিত হবে ১৫ অক্টোবর বুধবার। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।
আজ জাতীয় সংসদ ভবনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কার্যালয়ের সভাকক্ষে কমিশনের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। সভায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের ৫টি বৈঠকে পাওয়া মতামত বিশ্লেষণ করা হয়। বৈঠকে আশা প্রকাশ করা হয়, বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলো থেকে পাওয়া অভিমতগুলো বিশ্লেষণ করে শিগগিরই বাস্তবায়নের উপায় সংক্রান্ত সুপারিশ ও চূড়ান্ত করা জুলাই সনদ সরকারের কাছে জমা দেয়া হবে।
শুধু উপরোক্ত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে একটি কলাম লেখা যায় না। এর আগের দিন অর্থাৎ বুধবার ৮ অক্টোবর বেলা ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ৩২টি রাজনৈতিক দলের সাথে ঐকমত্য কমিশন বৈঠকে বসে। ৮ ঘন্টাব্যাপী বৈঠকের পরেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে পূর্ণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। সেটি হলো জুলাই সনদকে পাকাপোক্ত আইনি ভিত্তি বা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার জন্য দেশে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এটিকে কমিশন একটি বিরাট অগ্রগতি হিসাবে বর্ণনা করেছেন। একটি বিরাট অগ্রগতি তো বটেই। কিন্তু ঐ বৈঠকের ফাঁকেই জামায়াত প্রতিনিধি দলের নেতা ড. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের জানান যে ‘গণভোট নভেম্বরের শেষের দিকেই হওয়া দরকার’।
৮ অক্টোবর বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে দেশের রাজনৈতিক দল গুলোর যে ৮ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয় সে বৈঠকের এক ফাঁকে ড. তাহের সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, আজ অক্টোবরের ৮ তারিখ। অক্টোবরের আরও ২০ দিন আছে। নভেম্বরে যদি আমরা আরও ১৫ দিন ধরি, তাহলে ৩৫ দিন। নভেম্বরের ১৫ থেকে ১৮ তারিখের মধ্যে যদি আপনি গণভোট করে ফেলেন, দেড় মাস এটা ভেরি এনাফ টাইম। নভেম্বরের শেষের দিকে বা ডিসেম্বরের সপ্তাহে যদি আপনি জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন, তাহলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট সময় আছে।’ ঐদিকে বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন যে, তারা চান দেশের জাতীয় নির্বাচন এবং সংস্কার কমিশনের গণভোট একদিনেই অনুষ্ঠিত হোক। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, গণভোটের তারিখ নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় দুটি দলের মধ্যে ব্যবধান রয়েই গেছে। এ ব্যবধান মিটে যাওয়ার কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয়ত, ৮৪টি প্রস্তাব বা সুপারিশের মধ্যে যে ১১টিতে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি রয়েছে সে ডিসেন্ট বা আপত্তি গণভোটের অংশ হবে কীভাবে সেটি এখনো বোধগম্য নয়। নোট অব ডিসেন্টের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, এমন কথা শুনিনি। এ ডিসেন্ট বা আপত্তি নিয়ে কীভাবে গণভোট হবে সেটি বিএনপি এখনো ক্লিয়ার করেনি। জামায়াতের প্রতিনিধি দলের নেতা ড. মোহাম্মদ তাহের সে কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বলেছেন, জামায়াত জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি করে আসছে। যদি গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে উচ্চকক্ষ সৃষ্টির ইস্যুটি তো বাদ পড়ে যায়। জামায়াত তো চায়, নির্বাচনের আগেই সেই ইস্যুটির নিষ্পত্তি হোক। আরো যেটি মূল প্রশ্ন, সেটি অনিষ্পন্নই রয়ে গেলো। জামায়াত তো চাচ্ছে, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন হোক। কিন্তু বিএনপি চাচ্ছে, বর্তমান সংবিধানের ভিত্তিতেই নির্বাচন হোক। এটি একটি মৌলিক বিষয়। ঐকমত্য কমিশনের ৯ অক্টোবরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব প্রশ্ন বা ইস্যু সম্পর্কে কোনো কিছু বলা হয়নি। এর আগে অবশ্য ড. আলী রিয়াজ বলেছিলেন যে, সংস্কার কমিশন ড. ইউনূসকে অর্থাৎ সরকারের নিকট যে ফাইনাল রিপোর্ট ও সুপারিশ পেশ করবে সেটা রাজনৈতিক দল সমূহকে জানানো হবে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, ১৫ অক্টোবর সংস্কার কমিশন এবং রাজনৈতিক দলসমূহের উপস্থিতিতে ড. ইউনূস জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবেন। আমরা ওপরে যে সমস্ত প্রশ্ন উত্থাপন করেছি সেগুলো ড. ইউনূসের স্বাক্ষরের পর জুলাই সনদে সেসব প্রশ্নের উত্তর থাকছে কি না জানা যায়নি। এসব বিস্তারিত না জেনে এসম্পর্কে আর বেশি কিছু লেখা সমীচীন বলে মনে করি না। তাই আজ ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং জাতীয় আকাশ প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করতে চীনের তৈরি ২০ টি জে-১০সি মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০২৭ সাল নাগাদ ৪.৫ প্রজন্মের মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট কেনা প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য খরচসহ মোট ব্যয় হবে ২২০ কোটি ডলার যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২৭৬০ কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ফেসবুক প্রোফাইলে এক স্ট্যাটাসেও সম্প্রতি এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয় চীনের তৈরি ২০ টি জে-১০ সি মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চলতি ২০২৫/২৬ এবং আগামী ২০২৬/২৭ অর্থবছরে এ চুক্তির বাস্তবায়ন আশা করা হচ্ছে। সরাসরি ক্রয় অথবা জি টুজি, অর্থাৎ সরকার টু সরকার পদ্ধতিতে চীন সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এই ক্রয় সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০টি চীনা জে-১০সি জঙ্গী বিমান কেনা হচ্ছে, এমন খবর দিয়েছে ইংরেজি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’। এসব যুদ্ধবিমানের মূল্য ২০৩৫/৩৬ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে পরিশোধ করতে পারবে বাংলাদেশ।
জে-১০সি জঙ্গী বিমান মূলত চীনের বিমান বাহিনীর ব্যবহৃত জে-১০সি এর রপ্তানি সংস্করণ। গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে এ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ফ্রান্সের তৈরি ভারতের একাধিক রাফায়েল যুদ্ধবিমান ধ্বংসের দাবি করেছে পাকিস্তান।
চীনের কাছ থেকে ২০ টি জঙ্গি বিমান কিনতে সম্ভাব্য খরচের একটি হিসাব তৈরি করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। ২০টি জঙ্গী বিমানের মূল্য ১২০ কোটি ডলার যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৪,৭৬০ কোটি টাকা। স্থানীয় ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ যন্ত্রপাতি কেনা পরিবহন খরচে যোগ হবে আরো ৮২ কোটি ডলার বা ১০৮৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে বীমা ও ভ্যাট এজেন্সি কমিশন সহ অন্যান্য খরচ যোগ করলে মোট ব্যয় দাঁড়াবে ২২০ কোটি ডলার বা ২৭৬০ কোটি টাকা।
আলোচ্য ২০টি চীনা জঙ্গী বিমান ক্রয় সংক্রান্ত খবরটি যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে এটিকে যথার্থ সিদ্ধান্ত বলে বিবেচনা করা যায়। কারণ বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে আয়তনে ছোট হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে অনেক বড় একটি দেশ। জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রত্যেকটি শাখা অনেক দূর্বল। ভারত ও পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর কোনো তুলনা করা যায় না। এমনকি প্রতিবেশী বার্মা বা মিয়ানমার, যার জনসংখ্যা মাত্র ৬ কোটি, তাদের সামরিক শক্তিও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।
‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’ অনুযায়ী বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর সক্রিয় জনবল ১ লাখ ৬০ হাজার। বিমান বাহিনীর সক্রিয় জনবল ১৭ হাজার ৪ শত জন। নৌ-বাহিনীর সক্রিয় জনবল ২৫ হাজার ১ শত জন। ট্যাঙ্ক ৩২০টি। জঙ্গী বিমানের সংখ্যা ৪৪টি। এর মধ্যে চীন থেকে সংগ্রহ করা জঙ্গী বিমান এফ-৭ এর সংখ্যা ৩৬টি। এছাড়া রুশ নির্মিত মিগ-২৯ জঙ্গী বিমানের সংখ্যা ৮টি। এর মধ্যে চালু রয়েছে ৪টি। অপর ৪টি মেরামতের জন্য রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে।
এখানে পাঠকদের অবগতির জন্য একটি তথ্য দেয়া দরকার। সেটি হলো, এফ-৭ জঙ্গী বিমান হলো রাশিয়ার মিগ-২১ জঙ্গী বিমানের চীনা ভার্সন। মিগ-২১ এতোই পুরোনো ও সেকেলে যে ভারত চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তার বিমান বহর থেকে সমস্ত মিগ-২১কে অবসরে পাঠিয়েছে। সাধারণ ভাষায় এর অর্থ হলো, এসব বিমানকে ভারতীয় বিমান বাহিনী বাতিল করেছে। আর সেসব বাতিল মাল গুলোই আমাদের বিমান বাহিনীর মেরুদন্ড। মিগ-২৯ ও সেকেলে।
পক্ষান্তরে মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর শক্তি দেখুন। তাদের বহরে রয়েছে, মিগ-২৯ বিমান ৩৩টি। জে-৭ বিমান ২০টি। পাকিস্তান ও চীনের উদ্যোগে নির্মিত জে-১৭ থান্ডার ৭টি। আর রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ বিমান ২টি। মোট ৬২টি জঙ্গী বিমান। বাংলাদেশের ট্যাঙ্কের সংখ্যা যেখানে ৩২০টি সেখানে মিয়ানমারের ট্যাঙ্কের সংখ্যা ৪৪৫টি। অর্থাৎ আমাদের চেয়ে ১২৫টি বেশি।
আজকের লেখায় আমি রাজনীতির প্রসঙ্গ আনতে চাইনি; কিন্তু উপরে প্রদত্ত তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৮ কোটি লোকের দেশ বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ৬ কোটি লোকের দেশ মিয়ানমারের চেয়েও কম। তাহলে শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরে দেশের জন্য কী করেছেন? শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণের কণ্ঠরোধ করেছেন, ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা করেছেন আর আয়নাঘরে বছরের পর বছর শিক্ষিত যোগ্য লোকদেরকে বন্দী করে রেখেছেন। আর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে অর্পণ করেছেন। ভাবখানা এমন যেনো আমাদের সামরিক শক্তির কোনো প্রয়োজন নাই। আমাদের সামরিক শক্তির প্রয়োজন হলে ভারতই সেটির দেখভাল করবে। সামরিক বাহিনীর প্রতি এ উপেক্ষার পটভূমিতে চীন থেকে আধুনিক প্রযুক্তি সজ্জিত ২০টি জে-১০ সি জঙ্গী বিমান কেনার সিদ্ধান্ত সঠিক।