প্রযুক্তি মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসা ও বিনোদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির জুড়ি নেই। প্রযুক্তি আমাদের জীবনধারণ সহজ ও আধুনিক করেছে। এটা যেমন সত্য, তেমনিভাবে এর অতি নির্ভরতা আমাদের জীবনবোধকে বিষিয়ে তুলছে। এ বিষয়টিও অস্বীকার করা যায় না। প্রযুক্তি নিজে খারাপ নয়, খারাপ হলো এর অপব্যহার। যখন প্রযুক্তি ছিল না, তখনও কিছু মানুষের জীবনে আসক্তি ছিল- তবে তা ছিল সীমিত, নিয়ন্ত্রিত এবং বাস্তবতার সীমানার মধ্যে। মানুষ তখন ঢালাওভাবে কোনো কিছুর মোহে গা ভাসিয়ে দিত না। সে সময়ে প্রযুক্তি মানুষের বিকল্প ছিল না; মানুষই ছিল মানুষের আশ্রয়। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। মানুষ নিজেই নিজের বিকল্প খুঁজে নিয়েছে- প্রযুক্তির ভেতর। আজ প্রযুক্তির ব্যবহার এমন এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে অনেকে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন। মানুষ যেন ধীরে ধীরে নিজের তৈরি যন্ত্রের দাসে পরিণত হচ্ছে। মোবাইল ছাড়া কেউ কেউ চলতে পারছে না। সময়ের কোনো মূল্য নেই। ঘুমের আগে কিংবা ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল দেখার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, যা একপ্রকার আসক্তি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ কোনো না কোনোভাবে ডিজিটাল আসক্তির শিকার। এর প্রভাব শুধু মানসিক নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও ভয়াবহ। একটি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী- দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫৬ শতাংশ। বর্তমানে ১৯ কোটিরও বেশি মানুষ মোবাইল সিম ব্যবহার করছেন। অথচ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ৬ষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি একাধিক সিম ব্যবহার করছেন- এটি স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান। (সূত্র: অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ [অ্যামটব]।
মোবাইল ফোন জীবনের অংশ হয়ে যাওয়া অপরাধ তা কিন্তু নয়! তবে যতটা না দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘বেপরোয়া’ ব্যবহার উদ্বেগজনক। এমন একটা সময় ছিল নকিয়ার বাটন ফোন পাওয়া ছিল সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্ত এখন সময় বদলেছে- এখন সবার হাতেই ঝলমল করছে স্মার্টফোন। শিশুরাও এর বাইরে নয়। তাদের ছোট্ট হাতে এ ডিভাইসগুলো যেন নতুন খেলনা। কিন্তু খেলনার ভেতরে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক নেশা। শিক্ষা, আচরণ, ঘুম, এমনকি মানসিক বিকাশ-সবকিছুতেই স্মার্টফোন আসক্তি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাবা-মায়ের অজান্তে শিশুরা ডিজিটাল জগতের অন্ধকারে পা বাড়াচ্ছে। কিন্তু প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। নোংরা জিনিসের সাথে পরিচিত হয়ে পড়ছে। কিন্তু এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে এ ‘স্মার্টফোন যুগ’ একদিন আমাদের সন্তানদের শৈশব গ্রাস করে ফেলবে। অথচ আমরা প্রায়ই বলি ‘‘ আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’’। কিন্ত সে ভবিষ্যৎ আমাদের চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্মার্টফোনের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে তাদের সুন্দর জীবন। তারা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। পরিবার থেকে শিক্ষা পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা প্রায় অনুপস্থিত। অথচ পরিবার হলো শিশুর প্রথম ও সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ। পরিবারে যা শেখানো হয়, তার প্রভাব পড়ে বিদ্যালয়ে; কিন্তু বিদ্যালয়ে যা শেখানো হয়, তার প্রতিফলন পরিবারে ততটা দেখা যায় না। যদি পরিবার ও বিদ্যালয়ে নৈতিক, সামাজিক, মানবিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো জাগ্রত থাকতো, তাহলে ‘কিশোর গ্যাং’ নামের ভয়ঙ্কর বাস্তবতা আমাদের সমাজে জন্ম নিত না। এক কথায়, পরিবার ও বিদ্যালয়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাবই শিশু-কিশোরদের পথভ্রষ্ট করে দিচ্ছে। আজকের শিশুরা অতিমাত্রায় মোবাইল ফোনে গেম খেলা, গান শোনা, কাটুন দেখা কিংবা ভিডিও দেখার আসক্ত হয়ে পড়েছে। অনেকেই রাত গভীর পর্যন্ত মোবাইল স্ক্রিনে ডুবে থাকে। অবাক করার বিষয় হলো-শুধু শিশুরাই নয়, তাদের মা-বাবারাও যেন একই আসক্তিতে ভুগছেন। তারা রাত জেগে মোবাইল ফোনে সময় কাটান,ফলে তাদের জীবনে ভোরের স্নিদ্ধ বাতাসও আর জোটে না।
মোবাইল ফোন ব্যবহার কোনো অপরাধ নয়Ñ এ কথা ¯পষ্টভাবেই বলা দরকার। প্রযুক্তি নিজে অপরাধী নয়, বরং আমাদের ব্যবহারের ধরনই নির্ধারণ করে তা আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ হবে। তবে দু:খ হয়, যখন দেখি মা-বাবা সময়ের অভাবের অজুহাতে সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন। যেন একটি যন্ত্রই হয়ে ওঠে সন্তানের সঙ্গী। কিন্তু বাবা-মায়ের দায়িত্ব কেবল সন্তানকে খাওয়ানো কিংবা স্কুলে পাঠানো নয়; বরং তার সঙ্গে সময় কাটানো, কথা বলা, মনোযোগ দিয়ে শোনা। কারণ সময়ই সবচেয়ে বড় ভালোবাসা, আর মনোযোগই সন্তানের মানসিক বিকাশের মূলে থাকা পুষ্টি। আজ এমনও দেখা যায়, অনেক শিশু এখনো স্পষ্ট করে কথা বলতে শেখেনি, অথচ স্মার্টফোন ব্যবহার রপ্ত করে ফেলেছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই চোখ মুছতে মুছতে ফোন খোঁজে। ফোন না পেলে অভিমান করে, রাগ করে, কাঁদে, এমনকি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। সারাদিন, সারারাত যেন এ এক যন্ত্রে তারা বন্দি। শুধু শিশুরাই নয়, কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও এখন স্মার্টফোনের নেশায় পড়ালেখা থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। করোকালীন সময়ে অনলাইনে ক্লাসের প্রয়োজনীয়তার অজুহাতে অনেক অভিভাবক বাধ্য হয়েই সন্তানের হাতে ‘স্মার্টফোন’ তুলে দেন। কিন্তু তারপর থেকে যেন তা ফেরত নেওয়া আর সম্ভব হয়নি। মোবাইল ফোনে গুগল সার্চ করলে সবসময় ভালো বিষয় আসে না। মাঝেমধ্যে এমন অশালীন ও বিকৃত কনটেন্ট ভেসে আসে, যা একটি শিশুর চরিত্র ও চিন্তাকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। এখন এমন সময় এসেছেÑ একজন শিশু খাবার ছাড়া থাকতে পারে, কিন্তু মোবাইল ছাড়া এক মুর্হূতও থাকতে পারে না। অভিভাবকরা সন্তানের এ আসক্তি থেকে মুক্তি দিতে মরিয়া চেষ্টা করছেন, কিন্তু ইউটিউব, পাবজি, ফ্রি ফায়ার, ফেসবুক, টিকটকসহ অসংখ্য অ্যাপ্লিকেশন যেন সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছে। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ মানসিক ও শারীরিক সমস্যা-দুশিন্তা, হতাশা, হীনম্মন্যতা, মাথাব্যথা, ঘুমের ঘাটতি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি হ্রাস, এমনকি মুখে অরুচি ও স্বার্থপর মানসিকতার প্রবণতা পর্যন্ত বাড়ছে, যা খুবই বেদনাদায়ক।
ডিজিটাল আসক্তি শুধু সময়ের অপচয় ঘটায় না, এটি ধীরে ধীরে মানুষকে মানসিকভাবে শূন্য করে তোলে। শিশুরা এখন বাইরের খেলাধুলা ভুলে গেছে; পারিবারিক সময়, হাসি-আনন্দ, গল্প-সবই হারিয়ে যাচ্ছে স্ক্রিনের আলোয়। বাবা-মা ব্যস্ত মোবাইলে, সন্তানও একই পথে। ফলে পারিবারিক বন্ধন দিন দিন দুর্বল হচ্ছে, কথোপকথনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, আর পরিবারের উষ্ণ সম্পর্ক ঠাণ্ডা হয়ে পড়ছে নিঃশব্দে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রভাব আরও ভয়াবহ। অনলাইন ক্লাস বা শিক্ষামূলক কনটেন্ট দেখার নামে তারা বেশিরভাগ সময় কাটায় ইউটিউব, টিকটক বা গেমিং অ্যাপে। মনোযোগ হারিয়ে যাচ্ছে, পড়াশোনায় আগ্রহ কমছে, এমনকি পরীক্ষাভিত্তিক জ্ঞানেও তারা পিছিয়ে পড়ছে। ডিজিটাল আসক্তির ফলাফল শুধু শিক্ষায় নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেও গভীর প্রভাব ফেলছে। বাড়ছে মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, হতাশা ও আত্মসম্মানবোধের সংকট। অনেকেই ভার্চুয়াল দুনিয়ার লাইক, কমেন্ট ও ফলোয়ারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলো হারিয়ে যাচ্ছে অনলাইন বন্ধুত্বের ভিড়ে, যার ফলে জম্ম নিচ্ছে এক নিঃসঙ্গ সমাজ। শারীরিক দিক থেকেও ক্ষতি কম নয়। চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা, ঘাড় ও পিঠে ব্যথা, স্থুলতা এবং ঘুমের ব্যাঘাত এখন সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার তাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব- এটাই বাস্তবতা। পরিবার, বিদ্যালয় ও সমাজ-সব স্তরেই সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সন্তানকে শুধু ফোন নয়, দিতে হবে ভালোবাসা, গল্প, খেলাধুলার সঙ্গ এবং একান্ত সময়। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা, সময় ভাগাভাগি, একসঙ্গে বসে কথা বলা- এখন সময়ের দাবি। শিশুদের হাতে অতিরিক্ত মোবাইল না দেওয়া, নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা এবং তাদের বিকল্প সৃজনশীল কাজে যুক্ত করা-এসবই হতে পারে কার্যকর পদক্ষেপ। বিদ্যালয় ও কলেজে ‘‘ডিজিটাল সচেতনতা শিক্ষা” চালু করা যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির সুফল গ্রহণ করতে শেখে, কিন্তু এর ফাঁদে না পড়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে- প্রযুক্তি কোনো শত্রু নয়, বরং সঠিক ব্যবহারে এটি মানবকল্যাণের শক্তিশালী হাতিয়ার। তাই আমাদের শিখতে হবে প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে, প্রযুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হতে। প্রতিদিন কিছু সময় রাখি ‘নেট মুক্ত সময়’ হিসেবে; বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলি, বাস্তব জীবনের বন্ধুত্ব ও কথোপথনে ফিরে যাই। ডিজিটাল আসক্তি আজ নীরবে আমাদের সমাজ, পরিবার ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে গ্রাস করছে। যদি এখনই আমরা সচেতন না হই, একদিন মানবিক অনুভূতি, চিন্তা ও সামাজিক সম্পর্কগুলো হারিয়ে যাবে ভার্চুয়াল জগতের কোলাহলে। মোবাইল বা ইন্টারনেট নয়, মানুষই হোক মানুষের আসল সঙ্গীÑ এই উপলব্ধিটুকু ফিরে আসলে পারলে প্রযুক্তি হবে উন্নয়নের হাতিয়ার, ধ্বংসের নয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক।