॥ ড. মো. নূরুল আমিন ॥
গত ১৯ জুলাই রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশ রাজনৈতিক এক চমক সৃষ্টি করেছে। এ চমক সমাবেশে গণমানুষের উপস্থিতি, মঞ্চ ও ময়দানে শৃঙ্খলার অনুশীলন, সংযম, পারস্পরিক সহযোগিতার দৃষ্টান্ত, খাদ্য ও পানীয় বিতরণের পরিবর্তে নিজকে নিজে সাহায্য করার অনন্য দৃষ্টান্ত, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নীরব উপস্থিতি ও অভূতপূর্ব গাছাড়া ভাব যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
ষাটের দশক থেকে এ উদ্যানে অনুষ্ঠিত অনেকগুলো ইভেন্টের সাক্ষী হবার সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে ক্ষমতার কাড়াকাড়ির অংশ হিসেবে পূর্বপাকিস্তান পরিষদে আওয়ামী লীগেরই পিতা কর্তৃক আওয়ামী লীগ দলীয় ডেপুটি স্পীকার চাঁদপুরের শাহেদ আলীকে হত্যার জের ধরে জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারির পর ১৯৬০ সালে রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠানের আগে আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। তখন এ মাঠেই একটি বৃহৎ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন এর নাম ছিল রমনা রেসকোর্স ময়দান। এখানে নিয়মিত ঘোড়দৌড় অনুষ্ঠিত হতো। এরপর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের এখানে একটি বৃহৎ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে প্রচুর জনসমাগম হলেও রমনা কালিবাড়ী নিয়ে মাঠের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছিল খালি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে এখানেই ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানী কারাগার থেকে ফিরে এসে এখানে নৌকা প্রতীকের ওপর ইন্দিরা মঞ্চ স্থাপন করেন এবং পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে এর নামকরণ করেন।
১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে শেখ মুজিব সরকার ও আওয়ামী লীগের দুর্নীতি ও দুঃশাসনে যখন দেশের মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত তখন এ ময়দানে ভাসানী ন্যাপের উদ্যোগে একটি বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তার আকারও অত বড় ছিল না। রেসকোর্স মাঠ বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আয়তন ৯৫ একর। রূপান্তর করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪১,৩৮,২০০ বর্গফুট, মঞ্চ এবং অন্যান্য কমন ফ্যাসিলিটির জন্য ব্যবহৃত স্পেস-এর পরিমাণ ১০ শতাংশ ধরলে ৪,১৩,৮২০ বর্গফুট হয় এবং মোট আয়তন থেকে এটা বাদ দিলে ৩৭,২৪,৩০০ বর্গফুট নিট পাওয়া যায়। মাঠে একজন শ্রোতার জন্য তর্কের খাতিরে যদি ৩ বর্গফুট জায়গা লাগে তাহলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১২ লাখ ৪০ হাজার লোক। জামায়াতের সমাবেশে আগত জনতা সোহরাওয়ার্দী ছাড়িয়ে এক দিকে মৎস্য ভবন, প্রেস ক্লাব, পুরানা পল্টন, বিজয় সরণি, দৈনিক বাংলার মোড়, রমনা গ্রীন, কাকরাইল অন্যদিকে বাংলা মোটর, কাওরান বাজার পার হয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত বিশাল এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এ জনতার মিছিল বা অবস্থান কোথাও যানজটের সৃষ্টি করেনি। এটা আমার নিজের চোখের দেখা, নির্বিঘেœ আমি গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছি। জামায়াতের ভলেন্টিয়ার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাউকে কোথাও কোনও প্রকার বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হতে দেখা যায়নি। আমি যা বলতে চাচ্ছিলাম তা হচ্ছে মহাসমাবেশে উপস্থিত দর্শক শ্রোতার সংখ্যা। সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ এই সংখ্যা ৪০ লাখ বলেছেন। আমার ধারণা, মাঠে এবং মাঠের বাইরে উভয় মিলে এ সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৫ লাখ হতে পারে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ৭ দফা দাবিতে এ মহাসমাবেশটির আয়োজন করেছিল। দাবিগুলো হচ্ছে : ১. পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন, ২. লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, ৩. গণহত্যার বিচার, ৪. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, ৫. জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বাস্তবায়ন, ৬. এক কোটিরও বেশি প্রবাসী ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, ৭. অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, এ সাতটি দাবির প্রত্যেকটিই গণদাবি, জামায়াতের দলীয় দাবি নয়। দেশের সচেতন প্রায় ৪৫ লাখ লোক দূরদূরান্ত থেকে নিজ ব্যয়ে সম্মেলনে যোগ দিয়ে এ দাবিগুলোর প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছে। এছাড়াও ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত মজলিশ, লেবার পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি ও নূরুল হক নূর-এর দলসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দল উপরোক্ত দাবিগুলোর প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এ সমাবেশ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এবং সমাগত শ্রোতাম-লীর উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছেন। টেলিভিশন চ্যানেলসমূহ এ সমাবেশের কার্যক্রম লাইভ ব্রডকাস্ট করেছে। এছাড়াও সামাজিকমাধ্যম; বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব, লিঙ্কডইন, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ও ইনস্টগ্রামের মাধ্যমে মহাসমাবেশের কার্যক্রম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আগের দিনগুলোতে আবহাওয়া বিরূপ থাকলেও সমাবেশের দিন তা ছিল খুবই অনুকূল। বৃষ্টিবাদল ছিল না, তবে গরমের তীব্রতা ছিল। সমাবেশের সাফল্য; বিশেষ করে লাখ লাখ লোকের এখানে সম্পৃক্ত করা, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোকে একমঞ্চে এনে বসানো, শহীদ ও নির্যাতিত পরিবারগুলোকে এনে তাদের সম্মানিত করা ও তাদের কথা শোনার ব্যবস্থা করা এই কৃতিত্ব আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান ও তার নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মীবৃন্দের। ডা. শফিকুর রহমান শুধু জামায়াতের আমীর নন, তিনি ইতোমধ্যে দেশের আপামরজনতার হৃদয়ের স্পন্দনে পরিণত হয়েছেন। প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট বিপর্যয় যেটাই হোক না কেন বিপদগ্রস্ত মানুষের দুয়ারে ডা. শফিক ত্রাণ নিয়ে হাজির হবেনই। মারাত্মক করোনা রোগে আক্রান্ত অবস্থায় পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবদের অনেককেই যখন ভয়ে কাছে ঘেঁষতে দেখা যায়নি ডা. শফিক এবং তার সেক্রেটারি নজরুল ভাইকে আমি আমার শিয়রে দেখতে পেয়েছি। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দু’দিনের মাথায় তিনি আমার বাসায় গিয়ে হাজির। তাদেরকে ভুলা যায় না, অবজ্ঞা করা যায় না, এজন্যই তাকে কেউ কেউ বলেন মানবতার ফেরিওয়ালা, তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক জগতে হ্যামিলনের বংশীবাদক নামে পরিচিত, তিনি জামায়াতের শ্রদ্ধেয় আমীর, ইতিহাস সৃষ্টি করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।
সমাবেশের শেষ পর্যায়ে সভাপতির সমাপনী বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি দু’বার পড়ে যান। সারাদেশে এমনকি বিদেশেও দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। আল্লাহর রহমতে তিনি সহকর্মীদের সহযোগিতায় বসে সেই সমাপনী বক্তব্য দিয়েছেন এবং বুলন্দ কণ্ঠে আল্লাহু আকবার ধ্বনী উচ্চারণ করেন। শেষ বক্তব্যে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরেকটি লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন এবং জনগণকে ঘুষ, চাঁদাবাজি, গুম, খুন ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছেন।
দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, অবিচার, ব্যভিচার ও দুঃশাসন, ফ্যাসিবাদ কিভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এবং করছি। জামায়াত এবং সমমনা দলগুলোর উচিত ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে-ময়দানে ছড়িয়ে পড়া এবং মানুষকে সংঘবদ্ধ করে আগামী দিনে দেশে সৎ, যোগ্য ও ধর্মভীরু লোকের শাসন কায়েমে উদ্বুদ্ধ করা এবং ডা. শফিকের হাতকে মজবুত করা। ডা. শফিক ৬৭ বছর অতিক্রম করছেন। তিনি সংগঠন ও দেশের জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মঞ্চে তার পড়ে যাওয়াকে ওয়ার্নিং হিসেবে গ্রহণ করে তার জন্য যেমন দোয়া করা দরকার; তেমনি পারিবারিক ও সাংগঠনিকভাবে তার স্বাস্থ্য, সময়মতো খাওয়া-দাওয়ার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখাও প্রয়োজন।
আরেকটি কথা, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত জামায়াত নেতা-কর্মীদের গ্রামগঞ্জে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে মানুষের দুয়ারে হাজির থাকা এবং তাদের সুখ-দুঃখের ভাগী হওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি। এটা আমীরে জামায়াতের জীবন থেকে শিক্ষা যা সকলের জন্য অনুকরণীয়।