DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

হাফেজা আসমা খাতুন : জীবন ও কর্ম

বলছিলাম সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয়া পার্লামেন্টারিয়ান হাফেজা আসমা খাতুনের কথা। যিনি একজন রত্নগর্ভা মা।

Printed Edition
Default Image - DS

নূরুন্নাহার নীরু

বলছিলাম সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয়া পার্লামেন্টারিয়ান হাফেজা আসমা খাতুনের কথা। যিনি একজন রত্নগর্ভা মা। স্বনামধন্য সন্তানদের বটচ্ছায়া। বাংলাদেশে ইসলামী সংগীত জগতের শিল্পী ও একসময়ে বিটিভির সংবাদ পাঠক সাইফুল্লাহ মানসুরের স্নেহময়ী আম্মা গত ২০ জানুয়ারি ’২৫ নব্বই বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন তিনি। চলে গেছেন এক বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে। মহান আল্লাহ নিয়ে নেন তাঁকে নিজ সান্নিধ্যে। মনে পড়ে সূরা আল ইমরানের ৮৫ নং আয়াত, প্রত্যেক ব্যক্তি গ্রহণ করবে মউতের স্বাদ। ঠিক এ নিয়মে তিনিও চলে গেছেন সত্যি। কিন্তু যে পরিমাণ কর্ম রেখে গেছেন এ ক্ষণভঙ্গুর জীবনে তা জানা যুগ পরম্পরায় দাবি রাখে। ৭০-এর দশক, ৮০-এর দশক, ৯০-এর দশক, অতঃপর জিরো দশক পর্যন্ত যারাই তার সান্নিধ্য পেয়েছেন তাদের সবার কাছেই তিনি এক ইতিহাস, এক ঐতিহ্য।

ঠিক এ কথাটিই যেন বললেন মোহতারামা শামসুন্নাহার নিজামী তার বক্তব্যে। যিনি একাধারে হাফেজা আসমা খালাম্মা পরবর্তী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগীয় সেক্রেটারি, তৎকালীন আমীরে জামায়াত শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী এবং কন্ঠ যোদ্ধা সাইফুল্লাহ মানসুরের শাশুড়ি।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারী ’২৫ ছিল বাংলাদেশ মহিলা জামায়াত আয়োজিত মরহুমাকে নিয়ে এক স্মরণ সভা। সভাটি এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নির প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী সঞ্চালনায় ভরপুর হয়ে উঠেছিল। অনুষ্ঠানটিতে ছোট ছোট করে হলেও মনের আবেগ প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন দেশ-বিদেশে অবস্থিত বোনরাসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরাও। উদ্বোধনী কথা রেখেছিলেন বাংলাদেশ মহিলা জামায়াতের বর্তমান সেক্রেটারি নূরুন্নেছা সিদ্দিকা।

খালাম্মার দেখানো আদর্শ ও উপদেশে উজ্জীবিত জিনাত অবশেষে লন্ডনের বুকে একটি ইসলামীক সাপ্লিমেন্টারী স্কুল দিয়ে বসেন। বলা যায় লন্ডনে ১৫ বছর ধরে প্রথম মুসলিম মহিলা মুহতারামা জিনাত সিদ্দিকা হাফেজা আসমা খাতুনের অনুপ্রেরণায় ঢাবির ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী হয়েও তাঁর মেধা ও যোগ্যতাকে পুরোপুরি ইসলামের জন্য সঁপে দিয়েছেন। সেদিনের ভাষণে তাই সে বলেছিল : “আমি কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে। তাই প্রতিনিয়ত তার রূহের মাগফেরাত কামনা করে যাচ্ছি।” আহ্ কত বড় প্রাপ্তি। এ সদকায়ে জারিয়ার অংশীদার স্বয়ং হাফেজাও। এরকম তাঁর দেখানো ও শেখানো পথে কতজন যে উজ্জীবিত হয়ে আছে যার সওয়াব তিনিও পেয়ে যাচ্ছেন।

সেদিনের সে আলোচনার মধ্যে প্রধান যে বিষয়গুলো বেরিয়ে এসেছে তা হচ্ছে : তিনি ছিলেন খুব পরিপাটি, ছিলেন নিয়মানুগ জীবনের অনুসারী, মিষ্টভাষী, অতিথিপরায়ণ, পরোপকারী, ঠাণ্ডা অথচ তেজস্বী, সদা হাস্যোজ্জ্বল অথচ দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারীনি এবং মঙ্গলাকাঙ্খী।

মূলত আমার চোখে ছিলেন তিনি একটা পাঠশালা। একেবারে ভিন্ন স্রোতধারা থেকে আসা আমি যখন ইসলামের সৌন্দর্যে মোহিত তখন আমাকে আরো এগিয়ে নিতে, গতিশীল করতে এ মহীয়সীর অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে আমাকে যখন ওনারই পরম প্রিয় পছন্দের অত্যন্ত দীনি জজবায় উজ্জীবিত ব্যক্তির সাথে জুড়িয়ে দেন পবিত্র বিয়ের মাধ্যমে তখন আমার আব্বাও একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিলেন।

আমাকে অকপটে প্রশ্ন করে যখন বুঝলেন নাহ্ নিজ মেয়েটির জীবনের মোড় ঘুরে গেছে এক অনরুদ্ধ জ্ঞানের দিকে যার পথিকৃৎ হতে পারে এমন পাত্রই, তখন আর বাধা কোথায়? বিয়ে পড়ালেন স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসায় খালাম্মার স্বামী হাফেজ ফয়েজ মোহাম্মদ। কিন্তু খালাম্মা বিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত হয়ে থাকেননি। সদাই আমাদের খোঁজ রাখা, আমাদের সন্তানাদি থেকে সাংসারিক অবস্থা জানাসহ প্রাণভরে দোয়া করার কাজটিও করে গেছেন পরম প্রিয়জনের মতই।

“আমার স্মৃতিকথা” নামে লিখিত তাঁর বইটি পড়ে অনেক জানা-অজানা বিষয় মনে পড়ে গেল আমার। মরহুমার মোট বই বেরিয়েছিল ১৭টি। “আমার স্মৃতিকথা” তার সর্বশেষ লিখিত বই যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি মাইলফলক। তিনি যে ১৭টি বই লিখে গেছেন নারীদের উদ্দেশ্যে। জান্নাত, আখেরাত, ইসলাম, রাজনীতি, আন্দোলন, পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে নারীদের করণীয় অত্যন্ত সাবলীলভাবে পরিবেশিত। এমনকি নারীদের সাজগোজ পারিপাট্যতার মাধ্যমে নিজেকে দায়ী ইল্লাল্লাহ হিসেবে তুলে ধরা, সুন্দর ও আকর্ষণীয় ভাষায় কথা বলা, মানুষকে দিনের দিকে আকৃষ্ট করতে প্রভাবিত করা, তার কাছ থেকে এ প্রাপ্তি শুধু আমিই নই, স্মৃতিচারণকালে বোঝা গেল আরো অনেকেই এভাবে ঋণী হয়ে আছেন তাঁর কাছে।

তিনি তার স্মৃতি কথায় লিখেছেন, “১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসন লাভ করে। বিধি অনুযায়ী জামায়াতের ১৮ জন এমপি দু’জন মহিলা এমপি সংসদে নিতে পারবে। তখন জামায়াতে ইসলামী সংগঠন থেকে দু’জন মহিলা এমপি মনোনীত করে সংসদে পাঠায়। একজন ছিলাম আমি আরেক জন ঢাকা মহানগরী সেক্রেটারি রাশিদা খাতুন। জামায়াতে ইসলামী মহিলা বিভাগের দুজন মহিলা এমপি পার্লামেন্টে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছি। উল্লেখ্য যে, আমাকে একদিকে পার্লামেন্টে এমপির দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর মহিলা সেক্রেটারি হিসেবে অপর দিকে সফর, সংগঠনের বিভিন্ন প্রোগ্রামে যোগদানও করতে হয়েছে সমান তালে। আল্লাহ পাক করিয়েছেন। পার্লামেন্টে আমি আমার যেসব প্রস্তাব পাশ করিয়েছি তার সুফল আজও দেশবাসী ভোগ করছে। আমার প্রস্তাবগুলো ছিল:

১। ঢাকা মাওয়া সংযোগ রাস্তা। এ রাস্তাটির প্রস্তাব আমিই পার্লামেন্টে উত্থাপন করেছিলাম এবং প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে পাশ হয়েছিল।

২। আমি ৭১-এর বিধিতে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম রাত বারোটার পর মাইকে গান, বাজনা, যাত্রা গান, পীর ফকিরের গান বাজানো সব বন্ধ করতে হবে। যেহেতু ইত্যাদি আওয়াজে ঘুমানোতে বিঘ্ন ঘটে যেখানে অনেক রোগী, শিশু, বৃদ্ধ এবং পরীক্ষার্থীদের ক্ষতি হতে পারে। এ প্রস্তাবটিও সংসদে পাশ হয় যার সুফল আজও জনগণ ভোগ করছে।

৩। ১৯৯১ সালে আমার প্রস্তাব পাশের আগে সব সময় দিনের বেলা শহর পরিচ্ছনের কাজ করা হতো। এতে যাত্রীবাহী বাস-কারের পাশাপাশি ময়লা আবর্জনাবাহী গাড়ি চলাচল করতো, জ্যাম লাগলে যাত্রীবাহী বাস কারের সাথে ময়লা আবর্জনার গাড়ি ও পাশে দাঁড়িয়ে থাকাতে চরম দুর্গন্ধের ভোগান্তি পোহাতে হত। ফলে প্রস্তাব উত্থাপন করলাম রাত বারোটার পর থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত শহরের ময়লা আবর্জনা সরানোর কাজ শেষ করতে হবে। আল্লাহ চাহেত এ প্রস্তাবটিও পাশ হয়। এর সুফলও ভোগ করছে জনগণ।” ( ৮৫-৮৬ পৃঃ)

স্মৃতিকথার ঐ বইতে খালাম্মা তাঁর দেশ-বিদেশের সফর, দাওয়াত, সংগঠন ইত্যাদির অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন নিখুঁতভাবে। এর পাশাপাশি কবে কোথায় কী বক্তব্য রেখেছিলেন তাও তুলে ধরেছেন অত্যন্ত চৌকসভাবে। সত্যিই অসাধারণ ধীশক্তি সম্পন্না, চতুর্মুখী গুণে গুণান্বিতা এই মহীয়সী গরীয়সী রমনী। হাফেজা হিসেবে ছোটকাল থেকেই আল-কুরআনকে শুধু বুকেই নয় মুখেও বহন করে রেখে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বদর্পকন্ঠে। এবং আশা করি এ রশ্মির রোশনাই প্রজ্জ্বলিত থাকবে প্রজন্ম পরাম্পরায়। আমিন।

মোদ্দাকথা সবার কাছে তিনি এক অনাবিল সবুজ স্মৃতি। যা ওই সীমাবদ্ধ অনুষ্ঠানে বা এ সীমিত পরিসরে বলে বা লিখে শেষ করার নয়। আমরা তাঁর জাগতিক জীবনের সকল গোনাহখাতা মাফ চেয়ে তাঁর রূহের শান্তি কামনা করছি প্রত্যহ। তাঁর রেখে যাওয়া অগণিত ভক্তকর্মী তথা রূহানী সন্তানরাই হোক তাঁর সদকায়ে জারিয়া। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? তাঁর সুর ধরেই বলছি: মৃত্যুতো সবারই আছে। কবরেতো সবাইকেই যেতে হবে! কিন্তু সে কী রেখে গেল জমিনের উপরে সেটিই বিবেচ্য বিষয়! আল্লাহু আকবার! লেখিকা : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা।