আসিফ আরসালান
গত শুক্রবার ছিল ৭ নভেম্বর, সিপাহী জনতার ৫০তম বিপ্লব দিবস। ঠিক ৫০ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশে সিপাহী জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। সেদিন ছিলো শুক্রবার। আর আশ্চর্যজনকভাবে এবারের ৭ নভেম্বরও পড়েছিল শুক্রবারেই। ৭ নভেম্বরের যে ঐতিহাসিক তাৎপর্য, ৭ নভেম্বর যে বাংলাদেশের আদর্শিক দিক দর্শন সেটি এবার যত বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার প্রয়োজন ছিলো সেটি হয়নি। একটি কারণ সম্ভবত এ যে, সরকারি ঘোষণা মোতাবেক আর ৩ মাস পরে জাতীয় সংসদের নির্বাচন। তাই রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে হয়তো এ দিবসটি সে রকম ঘটা করে উদযাপনের সময় পাননি। ৭ নভেম্বর নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকার কিছু নিবন্ধের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু বিপ্লব ও সংহতি দিবস সম্পর্কে এখনকার প্রজন্মকে যত তথ্য জানানোর প্রয়োজন ছিলো সেটি হয়নি। এটি করার কথা ছিলো বিএনপির। কারণ ৭ নভেম্বর বিপ্লবে বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত মানুষ অংশ গ্রহণ করলেও এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিলো জেনারেল জিয়াউর রহমানের। জিয়াউর রহমানের হাত দিয়েই অতঃপর গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষের প্রত্যাশা ছিলো, বিএনপি এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ জুলাই বিপ্লবের পর নতুন করে ৭ নভেম্বরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সবিস্তারে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরবে।
এটা এবার হয়নি। ৫০ বছর আগে যখন সিপাহী জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিপ্লব করে তখনকার পটভূমি এবং জনতার স্বতস্ফূর্ত অংশ গ্রহণের কারণ বিএনপি কোনো দিনই সিরিয়াসলি তুলে ধরেনি। আগেই বলেছি ঘটনাটি ঘটেছে আজ থেকে ৫০ বছর আগে। স্বাভাবিকভাবেই আজ যাদের বয়স ৫৫, এমনকি ৬০ তাদের পক্ষেও এ দিবস সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলেরই কর্তব্য জনগণকে এমন ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা জনগণের কাছে বিশদভাবে তুলে ধরা। বিগত ৫০ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ ছিলো ২০ বছর ক্ষমতায়। জেনারেল এরশাদ ছিলেন ১০ বছর ক্ষমতায়। বিএনপি ছিলো বিভিন্ন মেয়াদে মোট ১৬ বা ১৭ বছর। এ ১৬/১৭ বছরে পত্র-পত্রিকায় ছোট আকারে বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত নিবন্ধ ছাড়া ৭ নভেম্বরের ওপর বিএনপির তেমন গবেষণা মূলক বই পত্র, ম্যাগাজিন, শর্ট ফিল্ম ইত্যাদি চোখে পড়ে না।
৭ নভেম্বরের ওপরে কিছুটা গবেষণা এবং কিছুটা অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি বিপন্ন-বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম যে, এব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তথ্য পাওয়া যায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযমের বিভিন্ন লেখালেখিতে। অধ্যাপক গোলাম আযমের ধারাবাহিক গ্রন্থ ‘জীবনে যা দেখলাম’ পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমার কাছে এ অমূল্য গ্রন্থের ৪টি খণ্ড রয়েছে। এগুলি হলো, প্রথম খণ্ড, তৃতীয় খণ্ড, ৪র্থ খণ্ড এবং ষষ্ঠ খণ্ড।
এর মধ্যে প্রথম খণ্ড তিনি নিজ হাতে আমাকে প্রদান করেছেন। লিখেছেন, ‘বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব মোবায়েদুর রহমানকে।’ এর পর তিনি নিজ হাতে সই করেছেন , ‘আযম, ২০-০৪-০২।’ তৃতীয় খণ্ডে লিখেছেন, “জনাব মোবায়েদুর রহমানকে, ‘আযম ১০-০৯-০৫”। চতুর্থ খণ্ডেও একই লেখা। ষষ্ঠ খন্ডে কোনো কিছু লেখা নাই। দেখা যাচ্ছে যে, ২য় এবং ৫ম খণ্ড আমার কাছে নেই। অর্থাৎ যে কোনো কারণে হোক, আমার কাছে নাই। ষষ্ঠ খণ্ডের পর আর কোনো খণ্ড বেরিয়েছে কিনা সেটিও আমার জানা নেই।
আমি এ ৪টি খণ্ডের উল্লেখ করলাম একটি বিশেষ কারণে। সেটি হলো, গ্রন্থটির ৪র্থ খণ্ডে ১৭৭ পৃষ্ঠা থেকে পুস্তকটির সমাপ্তি পর্যন্ত, অর্থাৎ ৩২০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত শেখ মুজিবের প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ থেকে শুরু করে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলী পর্যন্ত ৩ বছর ৮ মাসের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। তারমধ্যে ১৭৭ পৃষ্ঠা থেকে ৩১৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মোট ১৪২ পৃষ্ঠায় বিধৃত হয়েছে শেখ মুজিবের পতন থেকে শুরু করে ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়ার উত্থানকাল পর্যন্ত ঘটনাবলীর অনুপুঙ্খ বিবরণ। এ ১৪২ পৃষ্ঠাকে বলা যেতে পারে দিনলিপি বা প্রতিদিনের ঘটনাবলীর ডায়রী।
পরবর্তীকালে আমি খবর পেলাম যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে একই বছরের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটনাবহুল সময়ের ওপর অধ্যাপক সাহেবের একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ খবর পেয়ে আমি ঐ বইটি ক্রয় করি। বইটির নাম, “বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটনাবহুল ৭৫ সাল অগাস্ট ও নভেম্বর বিপ্লব-অধ্যাপক গোলাম আযম”। ১৫২ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটির প্রকাশ কাল ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাস। মূল্য: ৬০ টাকা মাত্র। (তখন অবশ্য এখনকার মতো বইপত্রের এতো দাম ছিলো না)।
আমি জানি না, এ বইটি এখনো বাজারে রয়েছে কিনা। আমি আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরী থেকে এ বইটিসহ অধ্যাপক সাহেবের ‘জীবনে যা দেখলাম’ গ্রন্থের ৪টি খণ্ড (ওপরে যেগুলোর উল্লেখ রয়েছে) ৫ ও ৬ নভেম্বর দু’দিন ধরে নাড়াচাড়া করলাম। দেখলাম, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে ৭ নভেম্বর, এ ২ মাস ২৩ দিনের রুদ্ধশ্বাস মুহুর্তগুলের বস্তুনিষ্ঠ, সঠিক ও অনুপুঙ্খ বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি (অধ্যাপক সাহেব) অন্তুত ৭টি বই পাঠ করেছেন।
এ ৭টি গ্রন্থের নাম অধ্যাপক গোলাম যেভাবে দিয়েছেন সেভাবেই আমি নীচে উল্লেখ করছি :
১. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর : প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মন্ত্রী জনাব আবুল মনসুর আহমদ।
২. রাজনীতির তিনকাল : সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও এরশাদ আমলের প্রধানমন্ত্রী জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী।
৩. জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ : প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও ডেমোক্রেটিক লীগের সভাপতি জনাব অলি আহাদ।
৪. একশ’ বছরের রাজনীতি : দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক ও রাজনৈতিক গবেষক জনাব আবুল আসাদ।
৫. যা দেখেছি, যা বুঝেছি ও যা করেছি : আগস্ট-বিপ্লবের নেতা মেজর (অব) ডালিম।
৬. তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা : লে. কর্নেল (অব) এম এ হামীদ।
৭. আমার দেখা সমাজ ও রাজনীতির তিন কাল : অধুনালুপ্ত ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, প্রখ্যাত এডভোকেট এবং কুষ্টিয়া জেলার সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা জনাব সা’দ আহমদ।
আমার জানামতে বাংলাদেশে আর কোনো লেখক এ ২ মাস ২৩ দিনের ঘটনা পঞ্জি এত নিখুতভাবে বিগত ৫০ বছরে আর কেউ লিখে যাননি। আমি ভাগ্যবান যে, অধ্যাপক গোলাম আযমের ঐ ৪ খণ্ডসহ আলোচ্য গ্রন্থটি পাঠ করতে সমর্থ হয়েছি। আর আমার দুর্ভাগ্য যে, ২য় ও ৫ম খণ্ড পাঠ করার সৌভাগ্য হয়নি, কারণ ঐ দু’টি বই আমার কাছে নেই।
ঘটনাবহুল এ ২ মাস ২৩ দিনের কোনো একটি দিনও যে অধ্যাপক গোলাম আযমের চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি তার দু’একটি নজীর ‘ঘটনাবহুল ৭৫ সাল’ গ্রন্থ থেকে উধৃত করছি।
“২ নভেম্বর দিবাগত রাতে মেজর ডালিম বঙ্গভবনে যেয়ে জানতে পারলেন যে, কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদ প্রেসিডেন্টের সাথে আছেন এবং তার জন্য অপেক্ষা করছেন। সেখান জানা গেলো যে, মেজর হাফিজ ও ক্যাপ্টেন ইকবাল ১ম ইস্ট বেঙ্গলের সবtroops withdraw করে বঙ্গভবন থেকে নিয়ে গেছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে অস্বাভাবিক troops Movement হচ্ছে।
সারারাত মেজর ডালিম ও মেজর নূরের তৎপরতা চললো। প্রথম মেজর হাফিজের সাথে তারা দেখা করলেন। ডালিমের ভাষায়ই শুনুন : “এ কী করলে হাফিজ! শেষ পর্যন্ত অঘটন ঘটিয়েই ছাড়লে? অঘটন বলছো কেন? জিয়া এবং মুশতাকের ঘোড়েল মনের পরিচয় পাবার পরও তারা যে আমাদের উদ্দেশ্যাবলি সম্পর্কে মোটেও আন্তরিক নয় সেটা তোমরা বুঝেও মেনে নিতে পারছো না কেন? Both of them are betraying our cause. উল্টো প্রশ্ন করলো হাফিজ। ওদের বাদ দিয়েই এগুতে হবে। আওয়ামী লীগের গড়া সংসদকেও আর কাল বিলম্ব না করে ভেঙে দিতে হবে। এ সঠিক উদ্যোগে বিশেষ করে তোমার, নূর, পাশা, হুদা, রাশেদ, শাহরিয়ার এর মাধ্যমে সেনাপরিষদের সমর্থন এবং সহযোগিতা পাবো আশা করছি আমরা। আমি জানি ব্রিগেডিয়ার খালেদ সম্পর্কে তোমাদের যুক্তিসঙ্গত reservation আছে; সেগুলোকে আমিও অস্বীকার করছি না, কিন্তু এরপরও ব্রিগেডিয়ার খালেদের চিফ হবার lifelong ambition fulfill করে দিলে জিয়ার তুলনায় তাকে দিয়ে more efficiently কাজ করানো যাবে”। (পৃষ্ঠা ৯৭ ও ৯৮)।
আরেকটি বিবরণ। “এমন সময় সৈনিকদের ভিড় ঠেলে একটি আর্মি ট্রাক শোঁ শোঁ বেগে এগিয়ে এলো। ভেতর থেকে নেমে এলো একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট। স্যালুট দিয়ে আমাকে (লে. কর্নেল হামিদ) জিজ্ঞেস করলো, “স্যার, জেনারেল জিয়া কোথায়? জরুরি ব্যাপার আছে”। বললাম, “কী ব্যাপার আমাকেই বলো।”
সে বললো, “স্যার, খুবই জরুরি, উনাকে বলতে হবে। আমাকে উনার কাছে নিয়ে চলুন প্লিজ।” ঐদিন প্রটোকলের কোনো বালাই ছিলো না। বললাম, “আসো আমার সাথে।” আমি তাকে নিয়ে জিয়ার কামরায় ঢুকলাম, “তাকে বললাম, এ ছেলেটি তোমাকে কিছু বলতে চায়।” লেফটেন্যান্ট তৎক্ষণাৎ জিয়াকে একটি স্মার্ট স্যালুট দিয়ে বললো, “Sir, I have come to present you dead body of Khaled Musharraf, Col. Huda and Hyder, Sir. .” জিয়া অবাক! ব্রিগেডিয়ার খালেদের ডেড্বডি। আমার দিকে তাকিয়ে জিয়া বললেন, “দেখতো হামিদ, কী ব্যাপার!” আমি অফিসারকে সাথে নিয়ে বাইরে দাঁড়ানো কালো ট্রাকের পেছনে গিয়ে উঠলাম। সেখানে দেখি ট্রাকের পাটাতনে খড় চাপা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে তিনটি মৃতদেহ। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার। খালেদের পেটের ভূঁড়ি কিছুটা বেরিয়ে আসছিলো। তাকে পেটের মধ্যে গুলি করা হয়েছিলো, হয়তো বা বেয়নেট চার্জ করা হয়েছিলো। কী করুণ মৃত্যু!” (পৃষ্ঠা ১২৫ ও ১২৬)।
সমগ্র পুস্তকটি এ রকম অসংখ্য তথ্যাবলীতে সমৃদ্ধ। আমার ব্যক্তিগত মতে যারা ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ২ মাস ২৩ দিনের ঘটনাবলি জানতে চান তাদের জন্য এ বইটি অবশ্য পাঠ্য।
আবার বলছি, আমি ভাগ্যবান যে অধ্যাপক গোলাম আযমের জ্ঞানের বিশাল সমুদ্রের তীরে আমি অন্তত পা রাখতে পেরেছি।