মোহাম্মদ শাকিল আহমেদ

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের মতে আঠারো বছর বয়স মাথা নোয়াবার নয়। আঠারো বছর বয়স বলতে কবি শুধু আঠারো বছর বয়সকে বুঝাননি, বুঝিয়েছেন তারুণ্যকে, তরুণদের অসাধ্য সাধন করাকে, তরুণদের নৈতিকতাকে। বাংলাদেশ যুব উন্নয়ন নীতিমালা ও জাতিসংঘের তরুণের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সকে তরুণ বলা হয়। মানুষের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় এ তরুণ বয়স। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭.৮২ শতাংশ তরুণ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ কোটি ৫৯ লাখ তরুণ। কিন্তু এ বিশাল সংখ্যক তরুণ বাংলাদেশ থাকলেও তারা সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের আঠারো বছর বয়সকে ধারণ করতে পারেনি। সবকিছু জয় করার পরিবর্তে অনেক কিছু থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছে। এ বয়সে অসাধ্য সাধন না করে সাধ্যের মধ্যে থাকা অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলছে। জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে। আসক্ত হচ্ছে নানাবিধ নেশায়। প্রতিবছর তৈরি হচ্ছে লক্ষাধিক বেকার, যা পরিবার এবং সমাজের উপর তৈরি করছে অতিরিক্ত চাপ। এরজন্য দায়ী শুধু যে তরুণ সমাজ, তা কিন্তু নয়। সমানভাবে দায়ী আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সিস্টেম।

প্রথমে পারিবারিক সিস্টেম নিয়ে আলোচনা করা যাক। একজন মানুষের জীবনে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তার পরিবার। মানুষ তার জীবনের মৌলিক শিক্ষা পরিবার থেকে গ্রহণ করে। পরবর্তীতে যা তার ব্যক্তিত্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখে। লক্ষ করলে দেখা যায় তরুণদের অবক্ষয়ের সুচনা তার পরিবার থেকে ঘটে। অধিকাংশ পরিবার তরুণদের নৈতিকতা শিক্ষাদানে ব্যর্থ হয়। এর কারণ, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নৈতিকতার অভাব, অন্তকোন্দল, সন্তানদের প্রতি অতি আদুরে মনোভাব এবং ধর্মীয় শিক্ষা দান না করা। এমতাবস্থায় প্রতিটি পরিবারের উচিত সন্তানকে গঠনমূলকভাবে বড় করে তোলা। যা সন্তানের মধ্যে নৈতিকতার সঞ্চারণ করবে। এতে সন্তান ভবিষ্যতে একজন নীতিবান ও সচেতন নাগরিক হবে। আর নীতিবান ও সচেতন নাগরিক নিশ্চয় দেশ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর।

দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে সামাজিক সিস্টেমের কথা : সমাজের দিকে তাকালেই তরুণদের নৈতিকতা অবক্ষয়ের জন্য যে সমাজিক সিস্টেম অনেকাংশেই দায়ী তা স্পষ্ট লক্ষ করা যায়। সামাজিক সিস্টেমের মধ্যে অন্যতম দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষা কেন্দ্রিক অর্থাৎ পড়া, পরীক্ষা দেয়া এবং সার্টিফিকেট গ্রহণ করা। যেখানে নৈতিকতা অর্জনের কোন সুযোগ নেই। ফলে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা তরুণদের মধ্যে নৈতিকতার সঞ্চার করতে পারছে না। এছাড়াও নানাবিধ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মিডিয়া তরুণদের নৈতিকতা অবক্ষয়ে চরম প্রভাব ফেলছে। গবেষণা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ২৮ শতাংশ তরুণ ইন্টারনেটে আসক্ত। ফলে তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে নানাবিধ অশালীন ভিডিও বা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে। যা তাদের নৈতিকতা অবক্ষয়ের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে। এমতাবস্থায় তরুনদের ইন্টারনেট ব্যাবহারে সচেতন হতে হবে এবং এ-ই বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

তৃতীয় আসে অর্থনৈতিক সিস্টেম : তরুণদের নৈতিকতা নির্ধারণে অর্থনৈতিক সিস্টেম অনেকাংশে দায়ী। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সিস্টেম যে ভঙ্গুর প্রকৃতির তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার উপর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর তথ্য মতে ২৬ লক্ষ বেকারের চাপ এবং সাম্প্রতিক ক্ষমতার পালাবদল, এসব মিলে বর্তমানে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুব ভালো নয়। যার প্রভাব তরুণ প্রজন্মের উপর পরেছে। দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে সরকার তরুণদের কর্মসংস্থান এবং শিক্ষাদানে তেমন বরাদ্দ দিতে পারছে না। ফলে অধিকাংশ তরুণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি, ছিনতাই বা চাঁদাবাজি করে নিজের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করছে। নানারকম নেশায় আসক্ত হচ্ছে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় মাদকাসক্ত তরুণদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ বেকার। সুতরাং বলা যায় দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি তরুণদের নৈতিকতা অবক্ষয়ের পাশাপাশি দেশকে অস্থিতিশীল করছে। তাই তরুণ প্রজন্মের নৈতিকতা রক্ষায় দেশের অর্থনীতির অমূল পরিবর্তন জরুরি। এক্ষেত্রে বেকার তরুণদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে বেকারের সংখ্যা হ্রাসের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।

সর্বশেষ প্রশাসনিক সিস্টেমকে এজন্য দায়ি করা যায় : লক্ষ্য করলে দেখা যায় বাংলাদেশের মাদকাসক্তের মধ্যে ৮০ শতাংশ তরুণ যায় মধ্যে ৬০ শতাংশ তরুণ নানাবিধ অপরাধের সাথে জড়িত। অর্থাৎ তরুণদের অপরাধের শুরুটা হয় মাদকের হাত ধরে। আর এই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কারার দায়িত্ব প্রশাসনের। সুতরাং বলা যায় প্রশাসনের দুর্বলতার ফলে তরুণরা মাদকাসক্ত হচ্ছে, যা তাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটিয়ে অন্যান্য অপরাধে জড়িয়ে ফেলছে। এছাড়া অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় অপরাধী কর্তৃক অপরাধের প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পায় এবং প্রশাসন যদি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে না পারে তবে অপরাধ দমানো সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের প্রশাসনিক সিস্টেম দুর্বল থাকায় অপরাধীরা বারংবার অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে দিন দিন অপরাধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তরুণেরাও এর বাহিরে নয়। ফলে প্রশাসনিক দুর্বলতা তরুণদের নৈতিকতার অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। এমতাবস্থায় প্রশাসনের উচিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করা এবং নানাবিধ অপরাধের সাথে জড়িত তরুণদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া। এতে তরুণদের নৈতিকতা রক্ষার পাশাপাশি দেশের অস্থিরতা নিরসন হবে। যা আমাদের একটি সুন্দর ও নৈতিকতা সমন্বিত তরুণ প্রজন্ম উপহার দিবে।

সর্বপরি তরুণরা একটি দেশের হৃদস্পন্দন। তরুণ সমাজ থেমে গেলে থেমে যাবে দেশ। বন্ধ হয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি। পথ হারাবে দেশের মানুষ। তাই তরুণদের সদাসর্বদা জাগ্রত রাখার বিকল্প নেই। আর তরুণদের জাগ্রত রাখার অন্যতম উপায় নৈতিক শিক্ষা। যে নৈতিকতার আয়নায় তরুণরা নিজেকে দেখে জাগ্রত হতে পারবে। এজন্য আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক সিস্টেমর পরিবর্তন জরুরি।

লেখক : শিক্ষার্থী ঢাকা কলেজ।