প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ
মূল্যবোধ মানে নীতি-নৈতিকতার প্রতি সচেতনতা। উত্তম চরিত্রের মানুষেরা নীতি-নৈতিকহীন, দুর্নীতিপরায়ণ, মানবতার প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক, অন্যের অধিকার লুণ্ঠনকারী, সন্ত্রাসী হয় না। মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষেরা ন্যায়পরায়ণতা, মানুষের প্রতি দরদ ও কর্মের জবাবদিহিতাকে অন্তরে লালন করে সব সময় অন্যায়-গর্হিত কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকে। মূল্যবোধ মানুষকে আদর্শ মানুষ হতে উদ্বুদ্ধ করে। মূল্যবোধহীনতা আমাদের সমাজকে অধঃপতনের দিকে ধাবিত করছে। আদর্শিক ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণে মানুষকে উন্নত চরিত্র গঠন ও মূল্যবোধ চর্চায় আত্মনিবেদিত হতে হবে।
আল্লাহ তা’আলা মানুষের জীবন ও মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন : “তিনি সে সত্তা, যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে কারা উত্তম কার্য সম্পাদনকারী, তিনি ন্যায়বিচারে মহাপরাক্রমশালী এবং অন্যায় থেকে প্রত্যাবর্তনকারীর প্রতি মহাক্ষমাশীল।” -সূরা-আল মুলক, আয়াত : ২
আল্লাহ তা’আলা রাসূল (সা:) কে পাঠিয়েছেন মানুষের চরিত্রকে পরিশুদ্ধ ও বিবেককে মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলার জন্য। আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা : “তিনি সে সত্তা যিনি মূর্খদের মাঝে রাসূল পাঠিয়েছেন তাদেরকে তাঁর বিধানসমূহ পাঠ করে শোনানোর জন্য, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য এবং তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ ও ভালো-মন্দের বিচক্ষণতা শিক্ষা দেওয়ার জন্য।” -সূরা আল জুমু’আ, আয়াত : ২
চারিত্রিক পরিশুদ্ধতা ও বিবেককে মূল্যবোধে ঋদ্ধ-সমৃদ্ধ করার জন্যই আল্লাহ তা’আলা যুগে যুগে নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। নীতি-নৈতিকতায় পরিশুদ্ধ ও ন্যায়-নীতির মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে রাসূল (সা:) মদিনায় একটি শোষণমুক্ত ইসলামি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেখানে সব ধর্মের ও সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নিরাপদে তাদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার প্রাপ্ত হয়েছিল। আজ সেই নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবে বিশ্বজুড়ে বৈষম্য ও হিংসা-বিদ্বেষে মানবসভ্যতা বিধ্বস্ত হচ্ছে।
১৭৯৯ সালে সংঘটিত ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে সামাজিক মূল্যবোধ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিপ্লবকালীন সময়ে ফরাসী সমাজ ও রাষ্ট্র নীতিহীনতায় নাজুক অবস্থায় পড়েছিল। সামাজিক বৈষম্যের ফলে দেশের মানুষ দরিদ্র কবলিত হয়েছিল। মূল্যবোধের অভাবে সমাজে অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করেছিল। পরবর্তীতে মুক্তিকামী জনতা সৎ নেতৃত্বের ডাকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নীতিহীনতার বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করে মূল্যবোধকে জাগ্রত করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে ১৭৮৯ সালে সূচিত হওয়া বিপ্লব ১৭৯৯ সালে মূল্যবোধের চূড়ান্তমার্গে উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়েছিল। সমসাময়িককালে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনে সত্য-মিথ্যার মূল্যবোধের যথেষ্ট চর্চা শুরু হয়। প্রাচীন ভারতে নানা ধর্মের লোক এক সমাজে পাশাপাশি বসবাস করতো। তাদের মধ্যে হিংসা-দ্বেষ ছিল না। ছিল পরস্পরের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ। এর মূলে ছিল পরমত ও পরধর্মসহিষ্ণুতার সামাজিক মূল্যবোধ।
বাংলায় মুসলিম শাসনামলের মূল্যবোধের অনুশীলন ছিল অবিস্মরণীয়। সুনীতি, সুশিক্ষা, সুবিচার, সহনশীলতা, উদার মানবিকতা ছিল প্রাচীন বাংলার সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি। ফলে মোঘল শাসিত পুরো উপমহাদেশ হয়ে ওঠেছিল মূল্যবোধের বিদ্যাপীঠ। কিন্তু বর্তমান ভারত-বাংলাদেশে মূল্যবোধের চর্চা অনেকটাই উপেক্ষিত ও হতাশাব্যঞ্জক।
তখনকার সমাজের মানুষরা ধনের চাইতে নিজেদের সম্মানটাকে বড় করে দেখতো। বর্তমানে ঠিক এর উল্টোটা পরিদৃশ্যমান হয়। মানুষ বিরামহীন ছুটে চলছে অর্থ-বিত্তের দিকে। বিসর্জন দিচ্ছে সততা ও নৈতিকতা। জড়িয়ে পড়ছে নানা অনৈতিক কর্মযজ্ঞে। হীনস্বার্থে আধিপত্যবাদের লেজুড়বৃত্তি করছে। কুৎসাবৃত্তি ও সন্ত্রাসবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ক্ষমতার মসনদকে ছিনিয়ে নেওয়া জন্য। অথচ সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন, “এ পৃথিবী পরিচালনার উত্তরাধিকারী হবে আল্লাহর সৎকর্মশীল অনুগত গোলামেরা।” -সূরা- আল আম্বিয়া, আয়াত : ১০৫
বাংলাদেশের অনৈতিক কার্যকলাপ স্বৈরাচারী সরকারের আমল থেকে সরকারি-বেসরকসরি প্রতিটি সেক্টরে বিস্তার লাভ করেছে। আমলা ও প্রভাবশালীদের অনেকে দুর্নীতির অভিযোগে কারারুদ্ধ হয়েছেন। দেশের চলমান সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রই নীতিহীনতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সমাজে অবক্ষয়, অশান্তির মূলে রয়েছে মূল্যবোধের অনুপস্থিতি। নীতি ও মূল্যবোধ নয়, অর্থ-বিত্ত দ্বারাই এখন সমাজে মানুষের সম্মান নির্ধারণ হয়। বিষয়টি জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ও আত্মহত্যার শামিল।
প্রভাবশালীদের অনৈতিক বলয়ে পিঞ্জিরাবদ্ধ হয়ে পড়েছে দেশের শুচিবোধ ও মূল্যবোধ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম মনুষ্যত্বের দিক থেকে বিকলাঙ্গ হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধারা দেশপ্রেম ও ইসলামি মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুলে তারা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ‘৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছিল। ঘোষণাপত্রটি ছিল নৈতিক মূল্যবোধে উচ্চকিত এক অসামান্য মূলনীতি। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ইতিহাসে অনন্য এক দলিল। এ ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘ বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করলাম। ‘ মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধে রচিত এ সংবিধান পরবর্তী স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত ছিল। স্বাধীন দেশের গণমানুষের জন্য এটা দুঃখজনক ও অবমাননাকর। তৎকালীন সংবিধানে ঘোষিত উক্ত মূল্যবোধের অবমাননায় আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয় শুরু হয়। শুরু হয় নৈতিক স্খলন।
বাংলাদেশ আজ নানাবিধ অবক্ষয়ে নিমজ্জিত। মাদক, ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলের ব্যবসা এখনও রাতের আঁধারে চলমান। মাদকতার ছোবলে একশ্রেণির যুবসমাজ নানা কুৎসা রটনায় সমাজকে উত্তেজিত করছে। লোকাল এডুকেশন এন্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের মতে, ‘বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ শিশু আছে, যাদেরকে পথশিশু বলা হয়। এদের মধ্যে ১৯% শিশু হিরোইন আসক্ত। ৪০% ধুমপায়ী। ২৮% শিশু ট্যাবলেট আসক্ত। আর ৮% শিশু আছে যারা ইনজেকশনে আসক্ত। দেশ ও জাতির জন্য এ চিত্র ভয়ংকর। এটি মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। আজকের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা পর্নোগ্রাফির ভয়াল নেশায় মত্ত। মধ্যবয়সী নারী-পুরুষও এ মরণ নেশায় নিমজ্জিত। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনে’ র এক জরিপে প্রকাশিত, রাজধানী ঢাকার স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের ৮০% ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। ফলে অপরিণত ও অসংগতিপূর্ণ যৌনাচার সমাজকে কলুষিত করছে, অবক্ষয়ের সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করছে। এতে উঠতি নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে অসততা ও অবহেলা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তারা ধৈর্য, উদারতা ও শিষ্টাচার বিবর্জিত হচ্ছে। কর্তব্য-কর্মে তাদের নান্দনিকতা, নিয়মানুবর্তিতা ও সৃজনশীলতা বিলুপ্ত হয়েছে। মাদকতা ও অশ্লীলতার পাশাপাশি রয়েছে ধর্মবিমুখতা, ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা। ধর্মকে সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে উপেক্ষা করা হয় হীন স্বার্থান্ধতা ও স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করার জন্য।
ধর্মের বিধান যুগ যুগ ধরে মানুষকে নীতিবান, ভারসাম্যপূর্ণ মানবিক মানুষে পরিণত করেছে। ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, রাসূল মুহাম্মাদ (সা:)-এর আগমনকালে আরবের প্রায় সব মানুষ ছিল ইতর, বর্বর, নির্দয়, নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, পাপী, অমানুষ। ইসলামি বিধানের দাওয়াত সম্প্রসারণ, সভ্যতা, সংস্কৃতির অনুশীলনের মাধ্যমে সেই বর্বর মানুষেরা বিশ্বশ্রেষ্ঠ সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিল। শুধু পৃথিবীতে নয়, পরকালের জন্যও তারা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সেরা মানুষের স্বীকৃতি এ পৃথিবীতে পেয়ে গিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা : “তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের কাছে চিরস্থায়ী বসবাসের জন্য বাগিচাসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে দুধ ও মধুর ঝর্ণাধারা প্রবহমান। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে পৃথিবীতে তার পালনকর্তাকে ভয় তার বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করেছে।” -সূরা-আল বাইয়্যেনাহ, আয়াত : ৮
বিশ্বইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, পৃথিবীর সব সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল ধর্মকে কেন্দ্র করে। সেটা পূর্ণতা পেয়েছে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইসলাম ধর্মের বাস্তব অনুশীলনে। তাই মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন ধর্মভিত্তিক শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতির পূর্ণ অনুশীলন ও বাস্তবায়ন। ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত সৎ, যোগ্য নেতৃত্বের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ। বিশ্ব ইসলামি চিন্তাবিদ ও দার্শনিক সাইয়েদ কুতুব শহীদ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে, তাকে সভ্য সমাজ বলে।”
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক।