কলাম
দলবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে
বিতর্কিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছেন। ২০১৪, ২০২৮ এবং ২০২৪ সালের বিতর্কিত এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় যারা বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে ৩৩ জনকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) করা হয়েছে।
Printed Edition
বিতর্কিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছেন। ২০১৪, ২০২৮ এবং ২০২৪ সালের বিতর্কিত এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় যারা বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে ৩৩ জনকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) করা হয়েছে। ওএসডি করার অর্থ হচ্ছে তারা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বা বিভাগে সংযুক্ত থাকবেন। তারা বেতন-ভাতা পাবেন কিন্তু কোনো কাজে যুক্ত হতে পারবেন না। একজন কর্মজীবী মানুষের বেকার বসে থাকার মতো কঠিন শাস্তি আর কিছু আছে বলে মনে হয় না। তারা কাজ করতে পারবেন না একই সঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের রাস্তাও বন্ধ থাকবে। পরবর্তীতে বিভাগীয় তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একজন তরুণ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে যারা বিভিন্ন জেলায় পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও তদন্তপূর্বক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এসব দলবাজ এবং অসৎ কর্মকর্তাদের বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে জাতিকে বিরাট মাশুল দিতে হয়েছে। এদের কর্মকা-ের মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর দলটি যদি হয় আওয়ামী লীগের মতো তাহলে তো কথায় নেই। ১৯৭৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অধীনে যতগুলো জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনোটিই গ্রহণযোগ্য ছিল না। ২০১৪, ২০২৮ এবং ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তার প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করেছে। তাদের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এক সময় আওয়ামী লীগ জিকির তুলেছিল, গণতন্ত্র নাকি উন্নয়ন। এর মাধ্যমে তারা বুঝাতে চেয়েছিল উন্নয়ন চাইলে গণতন্ত্রের প্রশ্নে ছাড় দিতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতে উন্নয়ন কেমন হয়েছে তাও দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এটা দুর্নীতির আংশিক চিত্র মাত্র। কারণ আওয়ামী লীগের নামে যারা দুর্নীতি করেছে বিপুল অর্থ-বিত্ত অর্জন করেছে তাদের সবাই তো আর বিদেশে পাচার করতে পারেনি। দেশেও দুর্নীতিকৃত অনেক অর্থ বিভিন্নভাবে রয়ে গেছে। একশ্রেণির মানুষ আছে যারা দুর্নীতি করার জন্যই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। রাজনীতির মাধ্যমে যদি বিত্ত কমানোর সুযোগ না থাকতো তাহলে অনেকেই রাজনীতি না করে অন্য কোনো পেশায় চলে যেতো। কিন্তু এখন রাজনীতি কিছু মানুষের জন্য অল্প সময়ে অকল্পনীয় বিত্ত অর্জনের পন্থায় পরিণত হয়েছে। আগে রাজনীতিকে বলা হতো জনসেবা। আর এখন বলা হয় পেশা। পেশা কখনোই মুনাফা ছাড়া হতে পারে না। যারা বিগত সরকার আমলে দুর্নীতি এবং অন্যায় কর্মের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিপর্যস্ত করেছে তাদের সাবাইকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। বিগত সরকার আমলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনীতি চর্চার উর্বর ভূমিতে পরিণত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু পরিষদ বা এ ধরনের আরো নানা সংগঠনের নামে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে কলুষিত করে ফেলা হয়েছে।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, নির্দিষ্ট ভূখ-, জনসংখ্যা এবং সরকার এই চারটি আবশ্যিক উপকরণের সমন্বয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। উপকরণগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং কোন একটি ব্যতীত আধুনিক এবং পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না। যে চারটি উপকরণের সমন্বয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয় তার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল এবং একমাত্র পরিবর্তনশীল উপকরণ হচ্ছে সরকার। সরকার দেশের মালিক নন, দেশের জনগণের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত আমানতদার মাত্র। সরকার আসবে সরকার যাবে কিন্তু রাষ্ট্রের অন্য তিনটি উপকরণ অপরিবর্তনীয় থাকবে। সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকবে কি থাকবে না তা নির্ভর করে সাধারণ মানুষের চাওয়ার উপর। কোন কারণে দেশের নাগরিকরা যদি সরকারের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন হয় তাহলে নির্বাচনের মাধ্যমে তারা শক্তিশালী সরকারকেও পরিবর্তিত করতে পারে। রাষ্ট্রের মধ্যে সরকারের কোন নিজস্ব সম্পত্তি নেই। সরকার শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পদের পাহারাদার মাত্র। আমরা কথায় কথায় বলি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কিন্তু এটা কোনভাবেই ঠিক নয়। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাদের আখ্যায়িত করা হয় তা আসলে রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান। যারা এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তারা সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী নন, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা বা কর্মচারী মাত্র।
প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর মূল দায়িত্ব হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি অনুগত হয়ে তাদের আদেশ-নির্দেশ মেনে চলা। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যদি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয় তার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারী প্রথাগতভাবে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন। দ্বিমত প্রকাশের নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। কিন্তু তারপরও যদি নির্দেশটি মানতে বলা হয় তাহলে তিনি তা মানতে বাধ্য। একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি ক্ষমতাসীন সরকারের নির্দেশ মানতে সম্মত না হন তাহলে সেটা ‘অবাধ্যতা’ হিসেবে গণ্য হতে পারে যা শস্তিযোগ্য অপরাধের পর্যায়ে পড়বে। যিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হবেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ পছন্দ করতে পারেন কিন্তু প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় তিনি ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশ করতে পারবেন না। সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণের কোন সুযোগ তার নেই।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিটি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিভিন্ন ব্যানারে সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত হবার প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে এরা যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকেন তার মতাদর্শের অনুসরণে রাজনৈতিক কর্মকা-ে চালাতে থাকেন। ১৯৯০ সালে প্রচ- গণআন্দোলনের মুখে সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতন ঘটলে ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার গঠন করে। সে সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে সীমিত পরিসরে জিয়া পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু পরিষদের আবির্ভাব ঘটে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী জিয়া পরিষদ এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের নামে পালাক্রমে প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরে রাজনৈতিক কর্মকা- চালিয়ে যান। তবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জিয়া পরিষদ বা বঙ্গবন্ধু পরিষদের কার্যক্রম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবার পর সরকারি প্ররোচনায় প্রতিটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অফিসে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়। তারা বিপুল বিক্রমে প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরে সরকার দলীয় রাজনৈতিক কর্মকা- চালাতে থাকে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সরকার দলীয় সমর্থনে যদি প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরে দলীয় রাজনীতি চর্চা করা হয় তাহলে তাদের নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু বিরোধীদলের সমর্থনে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে রাজনীতি চর্চা করলে নিশ্চিতভাবেই চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটবে। এক যাত্রায় দুই ফল কেনো?
যারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অফিসে বঙ্গবন্ধু পরিষদ অথবা জিয়া পরিষদের নামে রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করেন তারা পছন্দনীয় রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করেন। দল ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে এদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা নিশ্চুপ হয়ে থাকেন। অর্থাৎ এরা মধুলোভী। যারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অফিসে কর্মরত অবস্থায় দলীয় রাজনীতি চর্চা করেন তাদের সুকর্মের কারণে পছন্দনীয় দল ক্ষমতায় আসে না। অর্থাৎ নিজস্ব মতাদর্শের রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য তাদের সামান্যতম কোন কৃতিত্ব নেই। কিন্তু দল ক্ষমতায় থাকাকালীন এদের নানামুখী অপকর্মের কারণে দলীয় জনপ্রিয়তা ক্ষুণœ হয়। নিজস্ব পছন্দনীয় রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে থাকলে এরা রাজনীতি চর্চা করেন না। কারণ তাহলে চাকরি হারানোর ভয় আছে। কাজেই বলা যায়, যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা অবস্থায় দলীয় রাজনীতি চর্চা করেন তারা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের শুভাকাঙ্খী নন। তারা সুযোগ সন্ধানী মাত্র। আরো সুস্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় দলীয় রাজনীতি চর্চা করেন তাদের একটি বড় অংশই অতীত অপকর্ম বা কৃত দুর্নীতি থেকে বাঁচার জন্য অথবা নতুন করে দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলার জন্যই প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরে দলীয় রাজনীতি চর্চা করেন।
বিগত সাড়ে ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং এর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দেশটিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছিল। তারা মনে করতেন দেশ শাসন করার অধিকার একমাত্র তাদেরই আছে। অন্য কারো রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার নেই। তারা ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাজিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের হাতে নির্বাচন কখনোই নিরাপদ নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বিতর্কিত এবং এক তরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাদের আমলে। এক সময় যে আওয়ামীল লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে জানমালের ক্ষতিসাধন করেছিল সে দলটিই নির্লজ্জের মতো কোর্টের দোহাই দিয়ে জনপ্রিয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছিল।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করতেন দেশটি তার নিজস্ব সম্পত্তি। তিনি কথায় কথায় বলতেন তার বারা দেশ স্বাধীন করেছে। ভাবখানা এমন যেন দেশ স্বাধীন করার পেছনে অন্য কারো অবদান ছিল না। শেখ পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠজনদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্বে নিযুক্ত করে দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদে দলীয় সমর্থক ও আত্মীয়-স্বজনদের বসিয়ে দুর্নীতির স্বর্ণ দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। বিতর্কিত এবং চরম দুর্নীতিবাজ আত্মীয়-স্বজনকে বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আসীন রেখে দুর্নীতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পালন করেন শেখ পরিবারের একজন আত্মীয়। আওয়ামী লীগ স্বপ্ন দেখতো তারা ২০৪১ সাল পর্যন্ত একটানা ক্ষমতায় থাকবেন। কেউ যদি ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যান তাহলে তার কর্মকা-ের দায়বদ্ধতা থাকে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে বলেছিলেন তার বাসার পিয়নও নাকি ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সাবেক ডিজি’র গাড়ি চালন আবদুল মালেক হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। পিএসসি’র গাড়ি চালক আবেদ আলি প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। প্রতিটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছিল। বিগত সরকারে সে সুবিধাভোগীরা কিন্তু এখনো বিভিন্ন দায়িত্বে রয়ে গেছে। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু বাকশাল কার্যকর হবার আগেই ১৫ আগষ্ট মর্মান্তিকভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন সাধিত হয়। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ শাসনে বিকল্প বাকশালী প্রশাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছিলেন। বর্তমানে এমন একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না যেখানে দলীয়করণ, আত্মীয়করণের মাধ্যমে শীর্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
ভবিষ্যতে আর কেউ যাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত অবস্থায় দলীয় রাজনীতি চর্চা করতে না পারেন তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। আমলা এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের দলীয় রাজনীতি থেকে বিরত রাখার জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার। পরিষ্কার বার্তা দিতে হবে কেউ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত অবস্থায় কোনো দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারবেন না। যদি রাজনীতি চর্চা করতে হয় তাহলে চাকরি ত্যাগ করেই তা করতে হবে। আমাদের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শাহাদাৎবরণের পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে থাকে। এই সুযোগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মচারীরা কর্মবিরতি শুরু করে। প্রেসিডেন্ট এক নির্দেশ বলে ৮ হাজার ব্যাংক কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেছিলেন। তার সে বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ফলে ব্যাংকিং সেক্টরে স্বস্তি ফিরে আসে। তারপর হাজারো সমস্যা দেখা দিলেও ব্যাংক কর্মচারীরা আর কখনোই কর্মবিরতি পালনের মতো দুঃসাহস দেখায় নি।
বর্তমানে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্থবিরতা এবং মন্থর গতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এটা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। বিগত সরকারের আমলে যারা প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরে থেকে দলীয় রাজনীতি চর্চা করেছেন তারাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিব্রত করার জন্য প্রশাসনকে মন্থর করে রেখেছে। বিগত সরকারের আমলে সৃষ্ট দলীয়করণ থেকে মুক্ত করা না গেলে কোনোভাবেই প্রশাসনে গতি ফিরে আসবে না। যারা বিগত সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু পরিষদের নামে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি চর্চা করেছেন তাদের চাকরিচ্যুত করা যেতে পারে। যারা ইতিমধ্যেই অবসরে গিয়েছেন তাদের অবসরকালীন সুবিধা বাতিল করা যেতে পারে। কোনো অজুহাতেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি চর্চাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না।
লেখক : সাবেক ব্যাংকার।