প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ
আমরা আমাদের বিবেককে জাগ্রত করি। অন্যায়-অশ্লীল কাজ থেকে দূরে থাকি। মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ে সোচ্চার হই। অসহায় নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করি। সৃষ্টির সেবায় স্রষ্টার সন্তোষ অর্জন করি। সুকৃতির মাধ্যমেই আমরা আমাদের শুদ্ধ চেতনার বিকাশ ঘটাই।
সুবহে সাদিকে জাগ্রত হই : সুবহে সাদিকের স্নিগ্ধ শীতল হাওয়ায় ফজর সালাত আদায় করে আমরা আমাদের হৃদয়কে প্রশান্তিতে ভরে দেই। লাভ করি জান্নাতের কলকল ধ্বনিতে মুখরিত দুধ ও মধুর নহরধারা। সালাতে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে শুদ্ধ জীবনচেতনায় নিজেকে ঋদ্ধ করি।
আল্লাহ তা’আলার অসীম করুণা : আলহামদুলিল্লাহ। আজও আবার ফজরের আগে ঘুম থেকে জেগে উঠতে পেরেছি। এখনো বেঁচে আছি। এটি আল্লাহ তাআলার অসীম করুণা। এ সময় আমার আপনার মতো হাজারো মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
আসুন! মৃত্যুর আগেই আমরা অতীত জীবনের পাপরাশি ক্ষমা চেয়ে সৎ ও মানবিক কাজে নিবেদিত হই। আল্লাহ তা’আলার সন্তোষ অর্জন করি। অনন্তকালে সুখী জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে ধরনা দেই! শুদ্ধ জীবনের বিকাশ ঘটাই।
শুদ্ধতম মুসলিম হই : নিজেকে মুসলিম পরিচয় দিয়ে কী লাভ, যদি আমি সব সময় আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত থাকি? জীবনবিধান আল-কুরআনের আলোকে নিজের জীবন ও পরিবারকে সাজাতে যদি না পারি তাহলে কী মূল্য আছে আমার এ মুসলিম পরিচয়ের? শুদ্ধতম মুসলিম হওয়াই প্রতিটি মানুষের অনিবার্য দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনেই দুনিয়া-আখিরাতের সাফল্য নিশ্চিত।
জান্নাত-জাহান্নামের স্বরূপ : জান্নাত পরিবেষ্টিত আছে দুঃখ-কষ্ট-বেদনা দ্বারা। এগুলো সহ্য করার বিনিময়ে জান্নাত পাওয়া যাবে। জাহান্নাম পরিবেষ্টিত আছে লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা দ্বারা। এগুলোতে নিমজ্জিত হলে জাহান্নাম অবধারিত। দুনিয়া ও আখিরাতে চিরসুখের জীবনের জন্য আমরা শুদ্ধচারিতায় আল্লাহর যাবতীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই ।
আমরা কেন পৃথিবীতে এলাম : পশু-পাখির কোনো সামাজিকতা নেই, দায়-দায়িত্ব নেই, দুনিয়া-আখিরাতে কোনো হিসেব-নিকেশ নেই। শুধু পেট ভরে খেতে পারলেই এরা খুশি, সন্তুষ্ট। আমরা মানুষরা কি কেবল খাওয়া-দাওয়া ও ফূর্তি করার জন্যই পৃথিবীতে এসেছি? আমাদের সামাজিক দায়িত্ব আছে, পৃথিবীকে সুন্দর রাখার, পৃথিবীর মানুষগুলোকে শান্তি ও নিরাপদে রাখার দায়িত্ব আমাদের আছে। মানুষের দুঃখে দুঃখী হয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আমাদের আছে। শুধু নিজের সুখের ভাবনা ভাবলে আমরা শুদ্ধ ও সফল মানুষ হিসেবে গণ্য হবো না। আমাদেরকে আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন অন্যায়ের প্রতিরোধ করে মানুষের কল্যাণ সাধন করার জন্য।
সুখী হওয়ার উপায় : সুখী হওয়ার মোক্ষম উপায় অল্পে তুষ্টি। অন্যের পাহাড় সমান সুখের দিকে না তাকানো। নিজের যা আছে তার ওপর সন্তুষ্ট থেকে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়া। আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। এটি শুদ্ধ চেতন মনেরই বহিঃপ্রকাশ।
শুদ্ধ চেতনার মাহাত্ম্য : কেউ ভুল করলে ক্ষমা করে দিন। আপনি ভুল করলে ক্ষমা চেয়ে নিন। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হঠাৎ দম ফুরিয়ে গেলে সেই সুযোগ আর পাবেন না। এটি শুদ্ধ চেতনার মাহাত্ম্য।
অনন্ত জীবনের শান্তি : মৃত্যু আমাদের জন্য অবধারিত। তাহলে আমরা কী আখিরাতের অনন্ত জীবনে শান্তিতে থাকার উদ্দেশে সব পাপ কাজ ছেড়ে নামায, রোযা ও মানবককল্যাণের মতো ভালো ভালো কাজগুলো করে শুদ্ধ চেতনাকে শাণিত করছি!
অনন্ত জীবনের বাসস্থান : মানুষের অনন্ত জীবনের বাসস্থান হবে দু’ ধরনের ঃ
সৎকর্মশীল পুণ্যবানদের জন্য হবে- চিরশান্তিময় স্থান জান্নাত। আর অসৎকর্মশীল পাপীষ্ঠদের জন্য হবে- চির যন্ত্রণাময় স্থান জাহান্নাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা : নিশ্চয়ই যারা ইমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে জান্নাতুল ফিরদাউস। তারা হবে সেখানকার মেহমান। অনন্তকাল তারা সেখানে অবস্থান করবে। সে আরামদায়ক স্থান থেকে তারা কোনোদিন বের হতে চাইবে না। -সুরা কাহাফ-১০৭-১০৮।
অনন্তর যে ব্যক্তি আল্লাহদ্রোহী হয়েছে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে; নিশ্চয়ই তার চিরস্থায়ী ঠিকানা হবে জাহান্নাম।—-সুরা নাযিয়াত-৩৭-৩৯
আল্লাহর বাণীর আলোকে একজন মুমিনের দু’ জাহানে মুক্তি পাওয়ার শুদ্ধ চেতনা জাগ্রত হোক।
এক ফোঁটা অনুতপ্ত চোখের পানি : যার মন আল্লাহর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসতে চায়, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য সব ধরনের বাধাকে সহজ করে দেন। তার হৃদয়ে ঢেলে দেন প্রশান্তির অমীয় সুধা। তখন বান্দাহ আল্লাহর গুণে (দয়া, ভালোবাসা, ন্যায়পরায়ণতা) রাঙিয়ে নেয় নিজের আটপৌরে জীবন।
আল্লাহর সন্তোষ পাওয়ায় জন্য খুববেশি আয়োজনের দরকার হয় না। দরকার হয় অন্যায় থেকে ফিরে আসার খালেছ তাওবা আর একফোঁটা অনুতপ্ত চোখের পানি শুদ্ধতম চেতনায়।
মানবিক কারণেই বৈবাহিক জীবন : অনেক ছেলে-মেয়ে বৈবাহিক জীবন গ্রহণ না করে নিঃসঙ্গ জীবন ভালোবাসে। এতে করে এরা এক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বয়সের ভারে বা কোনো রোগে আক্রান্ত হলে তাদের আন্তরিকভাবে কেউ দেখার থাকে না। বিশেষ করে মেয়েদের বেলায় তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ফলে জীবনকে মূল্যহীন মনে করে তাদেরকে আত্মহননের পথও বেছে নিতে দেখা যায়।
সার্বজনীন জীবন বিধান ইসলাম মানবিক কারণেই বৈবাহিক জীবনকে উৎসাহিত করেছে শুদ্ধতম জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।
বিয়ের আগে পর্দা লংঘন করে নারী-পুরুষের অবৈধ প্রেম : আমাদের সমাজে বিয়ের আগে নারী-পুরুষের প্রেম ও খোলাখুলি মেলামেশা লক্ষ্য করা যায়। যা অনেক ক্ষেত্রে সমূহ বিপদ টেনে আনে। এমন অবৈধ প্রেম খুব কমই বিয়ে-শাদী পর্যন্ত পৌঁছায়। ফলে নারী-পুরুষ তার চরিত্রের পবিত্রতা হারায়। তাদের মধ্যে ঘৃণা ও বিকৃত মানসিকতা তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে এরা বিবাহিত জীবনে তাদের বৈধ স্বামী বা স্ত্রীকে পবিত্র চরিত্র ও প্রেম উপহার দিতে ব্যর্থ হয়। দিনে দিনে তাদের মধ্যে আস্থা, ভালোবাসার পরিবর্তে অবিশ্বাস, সন্দেহপ্রবণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাদের পরিবারে জাহান্নামের আগুন জ্বলতে থাকে। এ জন্য ইসলামি শরী’আ নারী-পুরুষের ওপর পর্দাকে আবশ্যিক বিধান করেছে। ইসলামের এ বৈজ্ঞানিক ও মানবিক বিধান মেনে শুদ্ধ জীবন উপভোগ করা যায়।
পর্দা লংঘনের নির্মম পরিণতির দৃষ্টান্ত : পর্দা পালন নারী-পুরুষের ইজ্জত-সম্ভ্রম ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বিপরীতে পর্দা লঙ্ঘন পুরুষ ও নারীকে জীবন নাশের মতো নির্মমতায় নিমজ্জিত করে।
সত্য কথা বলতে কী, আমরা ইসলামের বিজ্ঞানভিত্তিক, স্বাভাবিক-সুন্দর, মানবিক জীবন বিধানকে মানি না বলে এমন অনেক ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হই! সময় থাকতে আমাদের সচেতন হয়ে শুদ্ধ জীবন চর্চা করা উচিত বলে মনে করি।
ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন বিধান মনে না করার অজ্ঞতা : আমাদের দেশে তথাকথিত পশ্চিমা সভ্যতার ধ্বজাধারী মুসলমান নামের বুদ্ধিজীবীরা অজ্ঞতা বা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসহীনতার কারণে ইসলামকে অন্য ধর্মের মতো নিছক কিছু পূজা-অর্চনার মতো মনে করে। তাদের মতে ধর্ম পালন একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, কেউ ইচ্ছে করলে ধর্মীয় উপাসনা করতে পারে, আবার নাও করতে পারে। ইসলাম যে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক কুটনীতিতেও যে ইসলামের যুগোপযোগী সমাধান আছে, তা তারা স্বেচ্ছায় বা নাস্তিক্যতাবাদী মগজ ধোলাইয়ের কারণে অস্বীকার করে যায়। এ জন্য তারা ধর্মহীন শিক্ষা, সংস্কৃতি চালু, পুরুষের মতো নারীর সমঅধিকার, সমকামিতা ও পতিতাদের যৌনকর্মী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতির মতো ইসলামবিরোধী হীন সংস্কারের দাবি তুলছে। মুসলিম নামধারী এমন নাস্তিক্যবাদী নারী-পুরুষের তাওবা করে প্রকৃত কল্যাণধর্মী ইসলামের চর্চা ও বিশ্বাসকে ধারণ করা অত্যাবশ্যক শুদ্ধ ও মানবিক চিন্তার অধিকারী হওয়ার জন্য ।
শোনো পৃথিবীর মানুষেরা : আল্লাহর গযবে পুরো পৃথিবী এখন ধ্বংসোম্মুখ। এ পৃথিবীর মানুষেরা যদি মহাপরাক্রমশীল আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর আনুগত্য মেনে নেয়, কোনো পরাশক্তির তাবেদারি না করে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ব্যক্তি ও সমাজ পরিচালনার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়, সারা বিশ্বের মুসলিম শাসনগণ যদি আল্লাহর বিধান আল কুরআন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তাহলে নিশ্চিতই আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত হবে এবং রাসূল মুহাম্মাদ (সা:)-এর মদিনায় ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মতো সকল মানুষের মুক্তির জন্য একটি নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও কবি