জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন পুলিশের শীর্ষ পদে ছিলেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সারাদেশে পুলিশের গুলীতে নিহত সকল হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে অপরাধের দায় যাদের উপর বর্তায় তাদের মধ্যে অন্যতম চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থাণে গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে তৃতীয় আসামী হলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার অভিযোগ পত্র দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার ৫ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার রয়েছে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে ৮১ জনকে।
গত ১০ জুলাই ৫টি অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ গঠনের সময় ট্রাইব্যুনাল-১ জানতে চান, তাঁর (চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন) বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের দায় তিনি স্বীকার করেন কি না? জবাবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, তিনি দোষ স্বীকার করছেন। আর অপরাধ সংঘটনের বিষয়ে তথ্য দিয়ে তিনি ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করবেন।
সাধারণত অভিযোগ গঠনের সময় আসামী দোষ স্বীকার করলে সেদিনই তাকে সাজা দেয়া হয়। তবে দোষ স্বীকার করায় বিচারক দয়া করে সাজা কমিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এখানে তিনি দোষ স্বীকার করার পাশাপাশি রাজস্বাক্ষী দিতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। এখন প্রশ্ন আসে তিনি রাজস্বাক্ষী হওয়ার কারণে ক্ষমা পেয়ে মুক্তি পেয়ে যাবেন, নাকি কারাগারে থাকবেন? তিনি তো নিজে বাঁচার জন্যও এ কৌশল নিতে পারেন?
অভিযোগ গঠনের দিন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, তাঁকে যে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য কী? তিনি তাঁর দোষ স্বীকার করেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, সে অপরাধের সবকিছু তাঁর জানার কথা। সব তথ্য উদ্ঘাটনে ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালকে সহায়তার মাধ্যমে তিনি ‘অ্যাপ্রুভার’ হতে চেয়েছেন। সে প্রার্থনা ট্রাইব্যুনাল মঞ্জুর করেছেন। সুতরাং চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন পরবর্তী সময়ে এ ট্রাইব্যুনালে সুবিধাজনক সময়ে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনাসহ অপরাধ কাদের মাধ্যমে, কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, সে তথ্য উদ্ঘাটনে সাহায্য করবেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, আইনের ভাষায় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ হয়েছেন। বাংলায় এটিকে ‘রাজসাক্ষী’ বলে। অ্যাপ্রুভার হিসেবে তাঁর আবেদন ছিল। সে হিসেবে তিনি গণ্য হবেন। তিনি এখন কারাগারেই থাকবেন। বক্তব্য গ্রহণের পর তাঁর বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। যেহেতু চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন অ্যাপ্রুভার হয়েছেন, সে কারণে তাঁর নিরাপত্তা-সংকট হতে পারে। এ আশঙ্কায় তাঁর আইনজীবী আবেদন জানিয়েছেন, তাঁকে যেন যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া হয়। সে নিরাপত্তার কারণে ওই দিনই আসামীদের মধ্য থেকে পৃথক করে কারাগারে একক সেলে নেয়া হয়েছে।
সাধারণ অর্থে বলা যায় যে, যে অপরাধী, প্ররোচক বা জড়িত হিসেবে অপরাধের বিষয়ে বা প্রত্যেকসহ অপরাধীর (Accomplice) বিষয়ে তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা সকল ঘটনার সম্পূর্ণ ও সত্য বিবরণ প্রকাশ করবে, এ শর্তে তাকে বিচারক ক্ষমার বা তার সাজা কমিয়ে দিতে পারেন। ফৌজদারী মামলাতে এ সুযোগপ্রাপ্ত অপরাধীকে রাজসাক্ষী (অঢ়ঢ়ৎড়াবৎ) বলা হয়। যদিও সাক্ষ্য আইনে রাজসাক্ষী কথাটি সংজ্ঞায়িত করা নেই। কোনো আসামি রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলে প্রথমে তাকে ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরে কারাগারে রাখা হয় যাতে অন্য কোনো অপরাধী বা ব্যক্তি তাকে প্রভাবিত করতে না পারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ ধারায় রাজসাক্ষীকে ক্ষমা করার বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, “একজন রাজসাক্ষীর (Approver) ক্ষমা ১৫। (১) বিচারের যেকোনো পর্যায়ে, ধারা ৩-এ উল্লেখিত যেকোনো অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা গোপনে জড়িত বলে মনে করা হয় এমন যেকোনো ব্যক্তির সাক্ষ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে, ট্রাইব্যুনাল এ শর্তে তাকে ক্ষমা করতে পারে যে, সে অপরাধের সাথে সম্পর্কিত তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা পরিস্থিতির সম্পূর্ণ এবং সত্য প্রকাশ করবে এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সকল ব্যক্তির কাছে, যারা মূল ব্যক্তি বা সহযোগী হিসেবেই হোক না কেন, অপরাধ সংঘটনে জড়িত।
(২) এ ধারার অধীনে রাজসাক্ষীর জন্য সম্পৃক্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারে সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
(৩) বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যক্তিকে হেফাজতে আটক রাখা হবে।” ট্রাইব্যুনালের আইনের উল্লেখিত ধারায় পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন মুক্তি পাচ্ছেন না। এমন কী ক্ষমা পাওয়ার শর্ত হিসেবেও বেশকিছু বিষয় মানতে হবে।
সাক্ষ্য আইনেও রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যগত মূল্যের বিষয়ে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধী অন্য সহযোগী অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করার উপযুক্ত ব্যক্তি বলে বিবেচিত হতে হবে। দুষ্কমের্র সহযোগীর অসমথির্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেয়া হলে তা বেআইনি বলে গণ্য হবে না। এ ধারা মতে আসামিকে যিনি রাজসাক্ষী হবেন তাকে ক্ষমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে আসামি সাক্ষী হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
অন্যদিকে সাক্ষ্য আইনের ১৪৪ ধারার বিধান মোতাবেক রাজসাক্ষীর একক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে শাস্তি প্রদান করা আইনত যুক্তিসঙ্গত হবে না। কেননা সে অন্যান্য সহযোগী অপরাধীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে। কাজেই রাজসাক্ষীর মতো একজন বিশ্বাসঘাতক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণে আদালত বেশ সতকর্তা অবলম্বন করেন। আর আসামির সংখ্যা বেশি হলে এমনভাবে সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে যাতে প্রত্যেক আসামির পৃথকভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
রাজসাক্ষীর বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭, ৩৩৮ ও ৩৩৯ ধারায় বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। রাজসাক্ষী কে হবেন, রাজসাক্ষীকে ক্ষমা করা ও বিচারপদ্ধতির বিষয় বর্ণনা করা আছে। তাতে বলা হয়েছে, কেবল দায়রা আদালতে বিচারযোগ্য কোনো অপরাধ বা দশ বছর পযর্ন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডণীয় কোনো অপরাধ বা দণ্ডবিধির ২১১ ধারার অধীনে সাত বছর পযর্ন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ বা দণ্ডবিধির ধারা ২১৬ক, ৩৬৯, ৪০১, ৪৩৫ ও ৪৭৭ক-এর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধটির তদন্ত অনুসন্ধান বা বিচারের কোনো পর্যায়ে অপরাধের সহযোগী কোনো ব্যক্তিকে এ শর্তে ক্ষমা করার প্রস্তাব দিতে পারেন যে অপরাধীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগত বিষয়ে সত্য ঘটনা প্রকাশ করলে তাকে ক্ষমা করা যাবে। রাজসাক্ষীর বিবৃতিতে দুটি উপাদান থাকতে হবে যথা ক) সে অপরাধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং খ) অন্যসব আসামির অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বারা সমর্থিত।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৩৯ ধারায় রাজসাক্ষী হিসেবে ক্ষমা প্রাপ্ত ব্যক্তির বিচার সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। যদি রাজসাক্ষী তার ক্ষমার শর্ত ভঙ্গ করে, যেমন মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় বা তথ্য গোপন করে, তাহলে তার ক্ষমা বাতিল হতে পারে এবং তার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
রাজসাক্ষী যদি আগে থেকে জামিনে না থাকে তাহলে তাকে বিচার শেষ না হওয়া পযর্ন্ত কারাগারে আটক রাখতে হবে। কারণ জামিনে থাকা রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রকৃতি অনেকটা দুবর্ল। সহ-অপরাধী বা রাজসাক্ষীর বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে সাজা দান করার ক্ষেত্রে আদালত সবোর্চ্চ সতকর্তা অবলম্বন করে এবং সাবির্কভাবে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আদালত বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করে থাকে।
আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন, ফৌজদারী কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইনের বিধানসমূহ পর্যালোচনা করলে এটিই প্রতিয়মান হয় যে, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জুলাই গণহত্যার অপরাধের দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হলেও বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি পাচ্ছেন না। তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে তার সাক্ষ্য সঠিক এবং সত্য বলে প্রমাণিত হলে আদালত তাকে ক্ষমা করতে পারবেন। যদি তার সাক্ষ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে ক্ষমা না করে আদালত তার বিচারও করতে পারবেন।
লেখক : সাংবাদিক।