ইসরাইলের অভ্যন্তরে ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের নজিরবিহীন এক আক্রমণের দ্বিতীয় বার্ষিকী চলে গেল ৭ অক্টোবর। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের আকস্মিক, সুসমন্বিত এবং নজিরবিহীন হামলা শুধু ইসরাইলকেই নয়, পুরো বিশ্বকেই হতভম্ব করেছিল। হামলায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রায় দেড় হাজার ইসরাইলি নিহত, ২৫১ জনকে জিম্মি করে ধরে আনা হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল ইসরাইলী সেনা। ইসরাইলের ৭০ বছরের ইতিহাসে এত অধিক সংখ্যক সেনা নিহত হয়নি। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে খ্যাত ইসরাইলী বাহিনী।
এরপর অবশ্য গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের নারকীয় প্রতিশোধমূলক অভিযান শুরু হয়। পাল্টা হামলা হিসেবে এবং আটক জিম্মিদের উদ্ধারের বাহানায় তারা নারকীয় হামলা শুরু করে। যা এখনো চলমান। ক্রমাগত বোমা হামলায় গাজা এখন ধ্বংসস্তূপ। ২৩ লাখ বাসিন্দা অধ্যুষিত গাজায় দু’বছরে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে ইসরাইল। এ লেখা যখন লিখছি তখন গাজা যুদ্ধ বন্ধে মিসরে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হচ্ছে। বলা হচ্ছে যুদ্ধ বিরতির দ্বারপ্রান্তে তারা। তা হলে সেটা হবে শান্তি স্থাপনে একটি বড় পদক্ষেপ। হামাস কেন আক্রমণ চালালো আর তা থেকে কী অর্জন সে আলোচনাও হচ্ছে।
যেভাবে শুরু ৭ তারিখের হামাসের আক্রমণ : ইসরাইলের বিরুদ্ধে অন্তত ৫,০০০ টি ক্ষেপণাস্ত্রের রকেট ব্যারেজ ও ভূখণ্ডে পরিবহনে উপযোগী যানবাহনসহ অনুপ্রবেশের মাধ্যমে খুব ভোরে হামলা শুরু হয়েছিল। ফিলিস্তিনী যোদ্ধারাও ইসরাইলী বেষ্টনী ভেদ করে গাজা সীমান্ত অতিক্রম করে এবং কাছাকাছি ইসরাইলীয় জনবসতি ও সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করে। অন্তত ৩ হাজার রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। দীর্ঘ দু’বছর ধরে প্রস্তুতি চালিয়ে হামাস এ নজির বিহীন হামলা চালায়। হামাসের ঊর্ধ্বতন সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ এ হামলার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি হামাসের সশস্ত্র শাখা শহীদ ইজ্জুদ্দীন আল-কস্সাম ব্রিগেডের প্রধান ছিলেন। গত বছর ১৩ জুলাই ইসরাইলী হামলায় তিনি নিহত হন। তবে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয় ৫ মাস পর।
হামলার প্রথম ২৪ ঘণ্টায় হামাস সামরিকভাবে এক ধরনের “সাইকোলজিক্যাল বিজয়” অর্জন করেছিল। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছিল। হামাসের যোদ্ধারা ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে একাধিক বসতি দখল করে ফেলে, সীমান্তের ইলেকট্রনিক নিরাপত্তা প্রাচীর ধ্বংস করে দেয় এবং কয়েকশ’ জিম্মি ধরে নিয়ে যায় যা ইসরাইলি প্রতিরক্ষার ইতিহাসে নজিরবিহীন। ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে “অজেয় নিরাপত্তা বলয়” নিয়ে গর্ব করত। সে মিথ একদিনেই ভেঙে পড়ে। যা হামাসের স্মরণকালের সবচেয়ে বড় অর্জন।
হামাসের অর্জন কী? ইসরাইলের অভ্যন্তরে নজিরবিহীন আক্রমণ চালিয়ে হামাস কী অর্জন করতে চেয়েছিল সেটা নিয়ে নানা আলোচনা চলমান। কারো কারো মতে হামাসের এ সাময়িক জয় দ্রুত পরিণত হয় এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডিতে। বিপুল সংখ্যক গাজাবাসী নিহত হওয়া, স্থাপনা হাসপাতাল ধ্বংস হওয়া এবং দুর্ভিক্ষাবস্থা তৈরি হওয়াকে তারা উল্লেখ করতে চাইছেন। তবে হামাস তা মানতে রাজি নয়। কোন কোন বিশ্লেষক বলেছেন, ইসরাইল বিগত সময় ধরে হাসামকে কোনঠাসা করে এবং ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষকে অসলো চুক্তি মোতাবেক সবকিছু না করে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব কার্যত মুছে ফেলতে চেয়েছিল। আর চাপা পড়ে গিয়েছিল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিষয়টি। হামাস ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল, হত্যার শিকার হচ্ছিল গাজাবাসী, যা কোনভাবেই থামছিল না। অন্যদিকে ইসরাইলী জেলখানা ভরে যাচ্ছিল ফিলিস্তিনীদের দিয়ে। হামাস এ অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিল।
৭ অক্টোবরের হামাসের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল মূলত কয়েকটি- ১. ইসরাইলকে গাজার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে বাধ্য করা, ২. ফিলিস্তিনী প্রশ্নটিকে আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা, ৩. অভ্যন্তরীণ ফিলিস্তিনী রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং ৪. সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ইসরাইলি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা বিশ্বকে দেখানো। হামাস মনে করেছিল, ২০০৮, ২০১৪ কিংবা ২০২১ সালের সংঘাতের তুলনায় এবার এমন এক আঘাত দিতে হবে যা ইসরাইলের অহংকারে ফাটল ধরাবে। বাস্তবে তাই হয়েছিল।
ফিলিস্তিন বিষয়টি আবার আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দে ফিরে এসেছে। বিভিন্ন দেশ, বিশ্বশক্তি বিষয়টিকে নতুন করে উপলদ্ধি করতে শুরু করেছে। ইসরাইলী ধ্বংসকাণ্ডের বিরুদ্ধে ইসরাইলের পরম বন্ধু খোদ আমেরিকায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে, গাজাবাসীর প্রতি জনসমর্থন বেড়েছে। একই অবস্থা দেখা গেছে বৃটেনে ও অন্যান্য দেশে । সেখানে বড় বড় বিক্ষোভ হয়েছে। ইসরাইল যে যুদ্ধাপরাধ করছে তা প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামী বিশ্বে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি ও সমর্থন বেড়েছে। কিছু আরব দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছিল তাতে ভাটা পড়েছে।
বিশ্লেষকেরাও বলেছেন, এ হামলার ফলে ফিলিস্তিনী ইস্যু আবারও বিশ্বমঞ্চে ফিরে এসেছে, এটি হামাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সাফল্য। বহু বছর ধরে আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিন প্রশ্ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল; ৭ অক্টোবরের পর সে নীরবতা ভাঙে। ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে মুসলিম বিশ্বে বিক্ষোভ, মানবিক সহানুভূতি এবং ইসরাইলের নীতি পুনর্মূল্যায়নের দাবি জোরালো হয়েছে যে কথা আগেই বলেছি।
ফিলিস্তিনের পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে গঠনের বিষয়টি আবার গুরুত্ব লাভ করেছে। ফান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া পর্তুগাল সেপ্টেম্বর মাসে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। মার্চ মাসে মেক্সিকো স্বীকৃতি দিয়েছে। গাজায় দু’বছর ধরে চলমান ইসরাইলের গণহত্যার মধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে এসব শক্তিধর দেশের স্বীকৃতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এ স্বীকৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। এক ভিডিও বার্তায় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বক্তব্যের শুরুতে স্টারমার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান বীভৎসতার মুখে আমরা শান্তির সম্ভাবনা এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করছি। এর অর্থ হলো একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইসরাইল রাষ্ট্রের পাশাপাশি একটি কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, এ মুহূর্তে যার কোনোটিই আমাদের কাছে নেই।’ তিনি বলেন, ‘এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় হয়েছে। শান্তি ও দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান পুনরুজ্জীবিত করার আশায় আজ আমি এ মহান দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছি, যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।’ ১৯৪৮ সালে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠায় এই বৃটেনের বড় ভূমিকা ছিল। একশো বছরেরও বেশি সময় আগে বেলফোর ঘোষণায় ছিল এক বৃটিশমন্ত্রীর ইন্ধন, যাতে ইসরাইল ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। বর্তমান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর এই স্বীকৃতি তা থেকে সরে আসার ইঙ্গিত ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ।
গাজার মানুষকে বাঁচাতে বিভিন্ন সময় ফ্লোটিলা ত্রাণ বহর গেছে। সুমুদ ফ্লোটিলা বিশাল বহর নিয়ে গেলেও তাতে হামলা করে প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে ইসরাইল। এ ত্রাণ রহরের মধ্য দিয়ে গাজাবাসীর প্রতি মানুষের ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে। এর প্রতীকী মূল্য রয়েছে। গাজায় সামরিক অভিযান চালানোর জন্য গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এছাড়াও ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলাও দায়ের করা হয়েছে। রণাঙ্গনে ইসরাইলের ক্ষতিও কম নয়। গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী ১ হাজারেরও বেশি সেনাকে হারিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ৭ অক্টোবরের হামলা হামাসকে বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করেছে। মৃত্যু ও ধ্বংসের মাধ্যমে তাদের অনেক কিছু হারিয়েছে, কিন্তু মনোবল এখনো অটুট। হামাস প্রতিরোধের প্রতীক হতে পেরেছে।
ইসরাইল একা হয়ে পড়েছে : হামাসের হামলার জবাবে গাজায় ইসরাইল শুরু করে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস বোমাবর্ষণ। দু’বছরে নিহত ৬৬ হাজারের বেশি মানুষ। যদিও ইসরাইলের নাগরিকরা এসবের চেয়ে জিম্মি মুক্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে মিছিল সমাবেশ করেছে নিয়মিত। যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহু তাতে কান দেয়নি। প্রায় সম্পূর্ণ গাজা নগর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, হাসপাতাল, স্কুল, এমনকি জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রও রক্ষা পায়নি। হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বের বড় অংশ নিহত বা আত্মগোপনে । তবে এত কিছু করার পরও হামাসকে পরাস্ত করা যায় নি। বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ইসরাইল। আল জাজিরার এক বিশ্লেষক ৭ অক্টোবর লিখেছেন- আন্তর্জাতিকভাবে ইসরাইল যুক্তিসঙ্গতভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ সমর্থনের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল, কারণ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এমনকি জার্মানির মতো মিত্ররা গাজায় তার যুদ্ধের নিন্দা করছে। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ ফুঁসে উঠেছে। তার প্রমাণ দেখা গেছে গত মাসে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে। তার ভাষণের সময় দলে দলে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ওয়াক আউট করেছেন। এটা লজ্জা ও ঘৃণার তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা চলমান। হামাস কয়েকটি পর্যায়ে প্রায় ২০০ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে, বিনিময়ে মুক্ত হয়েছে ইসরাইলী জেলে থাকা কয়েক হাজার ফিলিস্তিনী। হামাসের হাতে আটক রয়েছে আরো প্রায় ৫০ জন। তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জন জীবিত। মিসর আলোচনায় যুদ্ধ বিরতি স্বাক্ষরিত হলে তারা মুক্তি পাবে। বিনিময়ে মুক্তি পাবে ইসরাইলী জেলে আটক ফিলিস্তিনীরা। আর হতে পারে গাজা থেকে ইসরাইলী সেনা অপসারণ। স্থায়ী যুদ্ধ বিরতি হলে গাজা পুনর্গঠন হবে, খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী আসবে। দুর্ভিক্ষ অবস্থার অবসান হবে। তবে আলোচনায় ইসরাইল যে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে রেখেছে তার নিষ্পত্তি হতে হবে। ট্রাম্প প্রশাসন কতখানি করবেন সেটাই দেখার বিষয়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।