নাফীজ আহম্মেদ
ফিলিস্তিনের গাজা আজ শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ডের নাম নয়, এটি মানবিক সংকটের এক দুঃসহ প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর মানচিত্রে একটি ছোট্ট অঞ্চল হলেও, গাজা কেবল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য নয়, বিশ্ব মানবতার জন্য এক গভীর বেদনার নাম। এখানে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসা অবিচার, নিপীড়ন ও নির্যাতন আজ একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। গত কয়েক মাসে গাজার মাটিতে ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী কেবল ফিলিস্তিনি জনগণের দুঃখ নয়, বরং মানবাধিকারের উপর এক নির্মম আঘাত।
গাজা আজ যেন এক ‘ওপেন-এয়ার কারাগার’, যেখানে লাখো মানুষ বন্দী। কাঁটাতারের বেড়াজালে ঘেরা এ অঞ্চল থেকে কেউ পালাতে পারেনি। আর বাকি পৃথিবী গাজার মানবিক বিপর্যয়ের কাছে যেন নির্বিকার দর্শক। দারিদ্র্য, বঞ্চনা, খাদ্য ও পানি সংকট এবং চিকিৎসার অভাব-এসব বিষয় গাজার মানুষের জীবনযাত্রাকে অচল করে দিয়েছে। বিশ্বের আধুনিক সভ্যতা আজ যেখানে মহাকাশ অভিযান চালাচ্ছে, সেখানে গাজার শিশু ও নারী বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে। এ সাম্যবিরোধী বাস্তবতা মানবতার জন্য এক চরম লজ্জার বিষয়।
গাজায় বসবাসকারী মানুষেরা প্রতিদিন এক নতুন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। শুধু প্রাণরক্ষাই নয়, তাদের মৌলিক মানবাধিকারও আজ চরম হুমকির মুখে। বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্যসেবা নেই। বাচ্চাদের পড়াশোনা বন্ধ, চিকিৎসা বাধাপ্রাপ্ত। মায়েরা সন্তানদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে না পেয়ে উদ্বিগ্ন। এমন একটি পরিবেশে মানবিক সংকট লুকিয়ে থাকে না, বরং তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এ মানবিক বিপর্যয় শুধু গাজায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি বিশ্বমানবতার বিবেকের প্রশ্ন।
২০২৩ সালের শেষের দিকে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক ইসরাইলি হামলায় গাজার হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু ও নারী। হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রও বোমাবর্ষণের হাত থেকে বাঁচেনি। এ হত্যাকাণ্ডকে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ‘গণহত্যা’ ও ‘নৃশংসতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক শক্তি ও রাষ্ট্রগুলো এখনও গাজার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইসরাইল কথিত ‘আত্মরক্ষার অধিকার’-এর নামে বেসামরিক মানুষের উপর নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম এ সংঘাতকে ‘দু’পক্ষের লড়াই’ হিসেবে দেখায়, যেন দু’পক্ষ সমান শক্তিতে লড়াই করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এক পক্ষ সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে অন্য পক্ষকে নৃশংসভাবে নিধন করছে। এ দ্বিচারিতা মানবিক ন্যায়ের সঙ্গে একেবারেই সাংঘর্ষিক।
বিশেষভাবে, মুসলিম বিশ্বের নীরবতা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। রাজনৈতিক স্বার্থ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক জটিলতার কারণে মুসলিম দেশগুলো স্পষ্ট ও সঠিক ভাষায় ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে পারেনি। অথচ ফিলিস্তিন শুধু আরব বিশ্বের নয়, গোটা মুসলিম উম্মাহর আত্মপরিচয়ের অঙ্গ। যখন মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে, তখন মজলুম শিশু ও নারীদের কান্না আর আমাদের নীরবতা এক হয়ে যায়। এ নীরবতা শুধু ফিলিস্তিন নয়, গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য লজ্জার বিষয়।
ফিলিস্তিনের সংকট শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি ঈমানের পরীক্ষা। ইসলাম শিক্ষা দেয় মজলুমের পাশে দাঁড়ানো ঈমানের অঙ্গ। আল্লাহ তায়ালা সূরা আনফালে বলেন, “আর যদি তারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য প্রার্থনা করে, তবে তোমাদের ওপর তাদের সাহায্য করা ফরজ।” (সূরা আনফাল : ৭২)
আমরা কি সে ফরজ আদায় করছি? শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘দোয়া ফর গাজা’ শেয়ার করলেই কি যথেষ্ট? আমাদের অবশ্যই সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, তথ্য ছড়াতে হবে, জনমত গঠন করতে হবে এবং বাস্তবিক প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানো আজ অতীব জরুরি। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে সাহায্য পাঠানো এবং স্থানীয় উদ্যোগে অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি। ইসরাইলি পণ্যের বয়কট শক্তিশালী প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। যদিও এটি ছোট পদক্ষেপ মনে হতে পারে, বিশ্বব্যাপী বয়কট বড়ো অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বার্তা পাঠায়। একই সঙ্গে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা অপরিহার্য। আল্লাহর রসূল (সা.) বলেছেন, “সব মুসলমান এক দেহের মতো; এক অঙ্গ কষ্ট পেলে সমগ্র দেহ ব্যথিত হয়।” (সহীহ মুসলিম)
বিভক্তি শত্রুর শক্তি, ঐক্যই মুক্তির পথ। মুসলিম উম্মাহ যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, তবে শত্রুর প্রভাব বাড়বে, আর শুধু ফিলিস্তিন নয়, বিশ্বের কোন জায়গা থেকে মজলুমরা মুক্তি পাবে না। আমাদের সচেতন হওয়া দরকার যে গাজা এখন আর দূরের সংকট নয়, এটি আমাদের মানবতা, ঈমান ও নৈতিকতার পরীক্ষা। যারা এ সংকটে চুপ থাকে, তাদের বিরুদ্ধে ইতিহাস কঠোর বিচার করবে। ন্যায়ের পক্ষে না দাঁড়ানো মানে অন্যায়ের অংশীদার হওয়া। অতএব, আমাদের অবহেলা, নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা ফিলিস্তিনের মানুষকে আরও বিপদে ফেলছে।
গাজার শিশুদের চোখে স্বপ্ন ছিল, তারা চেয়েছিল শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বড় হতে। কিন্তু আজ তারা বোমা, যুদ্ধের শব্দ আর মৃত্যুর আতঙ্কের মাঝে আটকা পড়েছে। সারাজীবন যুদ্ধ দেখা এসব শিশুদের মনোজগত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা আমরা বুঝতেই পারি না। তাদের হাসি হারিয়ে গেছে, স্কুল বন্ধ, জীবন থমকে গেছে।
নারীরা, যারা সাধারণত শান্তি ও পরিবারের ভিত্তি, আজ তারা সবচেয়ে বেশি দুর্যোগের মুখোমুখি। গর্ভবতী মা, বয়স্ক নারী, যারা গাজার সংকটে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদের জন্য চিকিৎসা সেবা প্রায় নেই। এসব নারী শুধু পরিবার নয়, মানবতার রক্ষাকবচ হলেও তাদের ওপর অন্যায়ের ছায়া নেমে এসেছে।
ফিলিস্তিনের সংকট আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি জটিল অধ্যায়। তবে মানবাধিকার, মানবিকতা ও ন্যায়ের কথা সর্বত্র শোনা যায়। বড় বড় শক্তি যখন স্বার্থের কারণেই নীরব থাকে, তখন সাধারণ মানুষের জীবন কষ্টে ডুবে যায়। এটি শুধু ফিলিস্তিনের সমস্যা নয়, এটি মানবতার সংকট। আমাদের উচিত বিশ্বজনীন বোধ-বিকাশ করা, যেখানে কোনও জাতি বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর দুর্দশাকে উপেক্ষা করা হয় না। মানবিকতা, সম্মান ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। গাজার মতো সংকটে শুধু সমবেদনা নয়, বাস্তব পদক্ষেপ অপরিহার্য। সামাজিক মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করা, আর্থিক ও সামগ্রিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়াÑ এসবই আজ আমাদের হাতে থাকা শক্তি। পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর উচিত প্রকৃত ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কাজ করা।
গাজা শুধু একটি সংকট নয়, এটি আমাদের ঈমান, মানবতা ও নৈতিকতার এক মহাপরীক্ষা। আজকের আমাদের করণীয়ই আগামী প্রজন্মের ইতিহাস গড়বে। গাজার মাটি থেকে রক্তপাত বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রতিবাদ, সচেতনতা এবং সাহায্য অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের ঐক্য, সচেতনতা ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যদি গাজার নিপীড়িত মানুষের বেদনা লাঘব করতে না পারি, তবে মানবতাকে আমরা হতাশ করব। আমাদের প্রয়াস গাজায় মানবিক বিপর্যয় শেষ করার দিকে নিবদ্ধ হওয়া উচিত। দোয়া ও আবেগের পাশাপাশি বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
আসুন, আমরা গাজার জন্য শুধু দোয়া করবো না, কর্মে অগ্রসর হবো। গাজার মজলুম বোন ও ভাইদের জন্য সচেতনতা গড়ে তুলবো, দুঃস্থদের পাশে দাঁড়াবো এবং একত্রে মানবতার বিজয় নিশ্চিত করব। কারণ গাজা কাঁদছে শুধু বোমার আঘাতে নয়, আমাদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তায়।
গাজা শুধু একটি সংকট নয়, এটি আমাদের ঈমান, মানবতা ও নৈতিকতার এক মহা পরীক্ষা। আজকের আমাদের করণীয়ই আগামী প্রজন্মের ইতিহাস গড়বে। চুপ থাকা মানে অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো। নীরবতা মানে অপরাধে অংশগ্রহণ।
আসুন, আমরা আর নীরব না থেকে আওয়াজ তুলি, আমরা দোয়া করি, আমরা সাহায্য পাঠাই এবং আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। গাজার শিশুদের মুখে আবার হাসি ফিরুক, ফিলিস্তিনের আকাশে যেন একদিন শান্তির রোদ ওঠে। আর আমাদের বিবেক, আমাদের কলম, আমাদের কর্ম-সেই রোদেরই প্রথম আলো হোক।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।