বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গি হয়ে যুক্তরাজ্য সফরে গিয়েছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যে যাবার আগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকা দ্যা ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিকদের দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, বিগত সরকার আমলে যেসব ধনকুবেরের বিরুদ্ধে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটে নেবার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তাদের মধ্যে যাদের মামলাগুলো তুলনামূলকভাবে কম গুরুতর সে মামলাগুলোর ক্ষেত্রে আর্থিক সমঝোতা ‘অন্যতম বিকল্প’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আসলে কী বলতে চেয়েছেন বা বলেছেন তা এখনই স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। কারণ বিষয়টি পুরোপুরি খোলাসা করে বলা হয়নি। তবে তিনি যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তা আলোচনার দাবি রাখে। কারণ বিগত সরকার আমলে দেশের যেসব উদ্যোক্তা গোষ্ঠী নানা প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছেন তারা অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং সব সময়ই সরকারের কাছাকাছি থাকেন। ফলে সরকার পরিবর্তন হলেও এদের কোনো কিছু হয় না। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের অন্যরকম আস্থা রয়েছে। এ সরকার মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনের ফসল। সমাজে সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ হবে সে লক্ষ্যেই সরকার কাজ করে যাবেন এটাই প্রত্যাশিত। বিগত সরকার আমলের আর্থিক দুর্নীতি, বিশেষ করে অর্থ পাচারের তথ্যানুসন্ধানের জন্য শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ঠিক সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বক্তব্য শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। তাহলে কি অতীতের মতোই আবারো মানুষ আশাহত হতে চলেছে? আর্থিক দুর্বৃত্তদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়া ঠিক হবে না।

হাজারো ছাত্র-জনতার আত্মদানের বিনিময়ে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে অর্জিত হয়েছে বিজয়। ছাত্র-জনতা যে আন্দোলন করেছিল তার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু শুধু সরকার পরিবর্তন ছিল না। কারণ যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতা প্রত্যাশি তারা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারেনি। ছাত্ররা তাদের জীবনের বিনিময়ে আন্দোলন করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্যদূরীকরণ। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সুবিধা সংস্কার এবং পর্যায়ক্রমে তা সরকার পরিবর্তনের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। একসময় সরকারের পতন ঘটে। সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এ সরকারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার ব্যবস্থা কায়েমের পথ উন্মুক্ত করা। একই সঙ্গে সমাজে যেসব দুর্নীতি এবং বৈষম্য রয়েছে তা দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

বিগত সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছিল। সম্ভবত কোনো মানুষই অস্বীকার করবে না যে, বিগত সরকার আমলে অবকাঠামোগত খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। অজ পাড়াগাঁ পর্যন্ত পাকা রাস্তা এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ উন্নয়ন কিসের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে? প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছে। বিগত সরকারের নীতি ছিল ‘অধিক উন্নতি অধিক দুর্নীতি।’ আমরা অবশ্যই উন্নয়ন প্রত্যাশা করি কিন্তু সে উন্নয়ন হতে হবে টেকসই এবং ব্যয়সাশ্রয়ী। উন্নয়নের নামে জনগণের আমানতকৃত অর্থ লুটপাট করা হবে এটা কেউই প্রত্যাশা করে না। কিছু কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে যেগুলোর আবশ্যকতা আদৌ ছিল না। এসব প্রকল্প থেকে যে রিটার্ন আসবে বলে প্রচার করা হয়েছিল তার সামান্যতম রিটার্ন আসছে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল যা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের অনুকূলে ছিল না।

সরকার সমর্থক ১১টি ব্যবসায়িকগোষ্ঠী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ব্যাপক অর্থ লোপাটের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বিভিন্নভাবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতূল্য ২৮ লাখকোটি টাকা পাচার করা হয়েছে বলে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এটাই শেষ নয়। অত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। কারণ যারা দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন তাদের সবাই অর্থ বিদেশে পাচার করতে পারেননি। সরকারি সমর্থনপ্রাপ্ত দুর্বৃত্তগোষ্ঠী প্রকল্পে ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে অর্থ লোপাট করেছেন। বিগত সরকার আমলে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রকল্পে অর্থায়নের পরিবর্তে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বিদেশি ঋণ গ্রহণ করার সুবিধা হচ্ছে এতে জবাবদিহিতা কম এবং মানুষ দুর্নীতির বিষয়টি ঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে না। বিদেশি ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে কমিশন গ্রহণ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। আর আর্থিক লেনদেন বিদেশে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। বিগত সরকার আমলে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। বাংলাদেশের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনো বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। তবে যেভাবে বর্ধিত মাত্রায় বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ শঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। আর মাত্র কয়েক বছর পরই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে যখন নতুন ঋণ গ্রহণ করে ইতিমধ্যে গৃহীত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ঋণগ্রস্ত দেশের কোনো আত্মমর্যাদা থাকে না। তাই ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

বিগত সরকারের আমলে দেশে যেসব উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পাদিত হয়েছে তার বেশির ভাগই বিদেশি ঋণনির্ভর। আর এ ঋণের অর্থ যেনতেনো ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যে অর্থ ব্যয় হয় তা অযৌক্তিক এবং অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ মহাসড়ক নির্মাণ ব্যয়ের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যেতে পারে। ভারতে প্রতি কিলোমিটার ফোর লেন মহাসড়ক নির্মাণে ব্যয় হয় ১৪ লাখ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানে ব্যয় হয় ২৯ দশমিক ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। ইন্দোনেশিয়ায় একই মাপের সড়ক নির্মাণ করতে ব্যয় হয় ২১ দশমিক ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, ফিলিপাইনে ব্যয় হয় ১১ দশমিক ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, চীনে ৩৯ লাখ মার্কিন ডলার এবং তুরস্কে ব্যয় হয় ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। আর বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার ফোর লেন মহাসড়ক নির্মাণে ব্যয় হয় ৬৩ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ কাজে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ বেশি থাকে বলে সরকার উৎপাদনশীল খাতের উন্নয়নের পরিবর্তে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতি বেশি মনোযোগী থাকতেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। যদিও কাজটি খুব একটা সহজ নয়। কারণ যে দেশে অর্থপাচার হয়ে যায় সে দেশের সরকার সাধারণত সে অর্থ সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরৎ দিতে চায় না। কোনো কোনো দেশতো আইন করে অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করছে। যেমন মালয়েশিয়া, তুরস্ক। তারা ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের নামে বিদেশি নাগরিকদের অর্থ পাচারে উৎসাহিত করে থাকে। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিয়ে গেলে সে অর্থের কোনো উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় না। এসব দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করে থাকেন। বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ চাইলেই ফেরৎ আনা যাবে না। এ জন্য আইনি প্রক্রিয়া প্রয়োজন। যে দেশে অর্থপাচার হয়ে গেছে সেসব দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। এটা দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। তাই অর্থ পাচার হয়ে যাবার পর তা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করার পরিবর্তে অর্থ যাতে পাচার হতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে উচ্চ হারে শুল্ক প্রদান সাপেক্ষে কালো টাকা সাদা করার সুযোগদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সরকার একদিকে পাচারকৃত কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলবেন আর অন্য দিকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেবেন এটা কোনোভাবেই সমর্থনীয় নয়। ঠিক একইভাবে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। অতীতেও আমরা দেখেছি, কঠোর আইন বাস্তবায়নের পরিবর্তে ধীরে ধীরে আইনের রাস্তা থেকে সরে আসা হয়। যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেছেন তারা সে অর্থ বিদেশে পাচার করুক আথবা দেশে সংরক্ষণ করুক কোনোভাবেই তাদের ছাড় দেয়া যাবে না। যারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে থাকেন তাদের অপরাধের কোনো ক্ষমা হতে পারে না। দায়েরকৃত মামলাগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ নাকি বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে তারা অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জন করে মারাত্মক অন্যায় কাজ করেছেন।

অতীতেও দেখা গেছে, নানা অছিলায় দুর্নীতিবাজদের ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন না এমন ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের সুদ মওকুফের সুবিধা প্রদান করা হয়। নানা কূটযুক্তিতে তাদের ক্লিন ইমেজ তৈরির সুযোগ দেয়া হয়। সেসব দুষ্কৃতকারীদের কোনো শাস্তি ভোগ করতে হয় না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনকালে যারা দুর্নীতিবাজদের এভাবে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে থাকেন তাদেরও বিচার হওয়া উচিত। কারণ যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনগণের সম্পদ সুরক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত। জনগণের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো কাজ তারা করতে পারেন না। এটা করলে তা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবার দাবি রাখে।

প্রয়োজনে আইনি কাঠামো পরিবর্তন করে হলেও এদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আইনের ধারা পরিবর্তন এবং নতুন ধারা সংযোজন করে অবৈধ অর্থ অর্জনকারীদের সমস্ত অর্থ-সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এটা করা হলে তারা আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়বেন। কাউকে যদি আর্থিকভাবে নিঃস্ব করে দেয়া যায় তাহলে তিনি ক্ষমতাহিন হয়ে পড়বেন। আর ক্ষমতাহিন মানুষ দেশ ও সমাজের চোখে নিশ্চিতভাবেই অবহেলিত হয়ে থাকেন। ভবিষ্যতে যারা দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করবেন তারা একবার হলেও ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা চিন্তা করবেন। কেউ যদি বুঝতে পারেন অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করা গেলেও তা ভোগ করা যাবে না তাহলে তার মাঝে অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের প্রবণতা কমে আসতে পারে।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।