মোঃ আবুজর গিফারী
বাংলাদেশে গনমাধ্যমের স্বাধীনতা সবসময়ই বিতর্কিত বিষয় ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগে এবং পরে এই স্বাধীনতার বাস্তবতা কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তার উপর আমাদের অবশ্যই একটু বিশেষ নজর দেয়া জরুরি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের অবস্থা ছিল কঠিন ও সংকুচিত। পতিত হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে সরকার সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা কঠোরভাবে দমন করেছে বলে অভিযোগ ছিল। বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০২৪ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০ টি দেশের মধ্যে ১৬৫ তম, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।
পতিত সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) এর আইনের অপব্যবহারের ফলে বহু সাংবাদিক গ্রেফতার ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই আইনের অপপ্রয়োগের নিন্দা জানিয়ে আসছিল বহুবার।
তৎকালীন সময় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার ছিলো হাসিনার ফ্যাসিজম কায়েমের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। সরকারবিরোধী সংবাদ প্রকাশের কারণে বহু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকার পতন ঘটে এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এতে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এলেও, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়।
সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল: নতুন সরকারের অধীনে ১৬৭ জন সাংবাদিকের সরকারি অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করা হয়, যা মিডিয়ার স্বাধীনতার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা হয়। ফলে তারা সরকারি ইভেন্ট ও মন্ত্রণালয়ে প্রবেশের সুযোগ হারায়। এ ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে তথ্য অধিদপ্তর থেকে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড প্রদান একটি চলমান প্রক্রিয়া। সম্প্রতি নীতিমালা অনুযায়ী যাচাই-বাছাইয়ের পর অধিদপ্তর থেকে কিছুসংখ্যক অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। মূলত কার্ড বাতিলের কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন কার্ড নবায়ন না করা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কোটার অতিরিক্ত কার্ড গ্রহণ, অপসাংবাদিকতা, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল, ফৌজদারি মামলার আসামী, বিভিন্ন কারণে গ্রেপ্তার ও কারা অন্তরীণ, অপেশাদার ব্যক্তির রাজনৈতিক বিবেচনায় কার্ড গ্রহণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাচার ও প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডের অপব্যবহার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতিবাচক ভূমিকা ও উসকানি, ফ্যাসিবাদের ঘনিষ্ঠ দোসর ও গুজব রটনা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে। তথ্য অধিদপ্তর সাংবাদিকদের বাতিল করা অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সংবাদমাধ্যমের ওপর নতুন বিধিনিষেধ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরও, কিছু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ এসেছে। এডিটর্স কাউন্সিল ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে।
নতুন সরকারের প্রতিশ্রুতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিলেও, বাস্তবে এখনো কিছু বিধিনিষেধ কার্যকর রয়েছে। নতুন সরকার যদি সত্যিকার অর্থে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে আইনি কাঠামোর সংস্কার ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বর্তমানে আমরা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপস্থিতি লক্ষ্য করতে পারি। অভ্যুত্থান পূর্ববর্তী সময় দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি সরকার কখনোই মূলধারা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করতে সম্মত ছিলো না। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর জন্য দেশব্যাপী ধর্ষন, গুম, খুন, ডাকাতিসহ বিভিন্ন ঘটনা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করতে বাধা সৃষ্টি করতো। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এসব বিশেষ অনেকটা নমনীয়তা লক্ষ্য করা যায়, যা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ।