রোহিঙ্গা সংকট ক্রমেই জটিল হতে জটিলতর হচ্ছে। দীর্ঘ আট বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নানাবিধ চটকদার কথা বলা হলেও বাস্তবে এসবের কোন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়নি বরং সমস্যা যে তিমিরে ছিলো সে তিমিরেই রয়ে গেছে। ফলে পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ। সর্বোপরি বাংলাদেশও বিষয়টি নিয়ে বড় ধরনের জটিলতার মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতার অভাব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিমুখী নীতির কারণে এর কোন সমাধানের পথনির্দেশনা এখনো তৈরি করা যায়নি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের হিসেব অনুযায়ী, ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে বাঁচতে প্রায় ৬ লাখ ৫৫ হাজার থেকে ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন কক্সবাজারে সব মিলিয়ে অন্তত ২২ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস রয়েছে। এছাড়া ভারতের হায়দ্রাবাদের অবস্থানরত রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ফলে মিয়ানমারের মতো তারাও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৩ তম অধিবেশনে জানানো হয়, বাংলাদেশে ১.১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলিতে রোহিঙ্গাদের উপচে পড়া ভিড় রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোয় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। শরণার্থীদের পরিষেবা, শিক্ষা, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং সঠিক স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে। তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সংক্রামক রোগ সংক্রমণেও ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি ও স্যানিটেশন, দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক সুরক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রয়োজনীয়তা মোকাবেলায় আর্থিক সহায়তায় প্রায় অর্ধ বিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছে। ১ মার্চ ২০১৯ এ বাংলাদেশ ঘোষণা করে যে, তারা আর নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণ করবে না। আগস্ট ২০১৮-এর একটি সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে ২৫ আগস্ট ২০১৭ ‘নিধনযজ্ঞ’ শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা ২৪ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কমপক্ষে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ১ লাখ ১৬ হাজার রোহিঙ্গাকে মারধর করা হয়েছিল এবং ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৩৬ হাজার রোহিঙ্গার বাড়ীঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
মূলত, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের একটি মুসলিম সংখ্যালঘু জাতি, যাদেরকে মিয়ানমারি বৌদ্ধরা বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে হিসেবে গণ্য করেন। রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে এবং বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমার সরকারকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে বাস করতে শুরু করে। অধিকাংশ শরণার্থী টেকনাফ-কক্সবাজার হাইওয়ে বরাবর অবস্থিত নাফ নদীর সমান্তরালে বাস করে।
অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্বারা এলাকাটির পর্যটন প্রত্যাশা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শরণার্থীদের নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়া এবং কক্সবাজারে ২০১২ রামু সহিংসতার জন্যও দোষারূপ করা হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ডিসেম্বর ২০১৬-এর একটি প্রতিবেদনে বলেছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ধর্ষণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং রোহিঙ্গাদের বাসভবন দখলে তত্ত্বাবধান করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শরণার্থীরা আদিবাসী জনগোষ্ঠী সরিয়ে দিচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমাদের জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদের মত জনবহুল দেশের জন্য বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ফলে বাংলাদেশ শুরু থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনের জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। সে ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম সময়সীমা ঠিক করা হয়েছিল। সে সময় রোহিঙ্গারা রাজি না হওয়ায় কাউকেই রাখাইনে পাঠানো যায়নি। মিয়ানমার সরকার সম্প্রতি প্রত্যাবাসনের জন্য ১ হাজার ৩৩ পরিবারের ৩ হাজার ৫৪০ জনের নামের তালিকা পাঠায়। বর্তমানে প্রত্যাবাসনের চেস্টা চললেও রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং তারা ৫ দফা দাবি সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করেছে। তাদের এসব দাবি খুবই যৌক্তিক বলেই মনে করছে অভিজ্ঞমহল। দফাগুলো হচ্ছে, রোহিঙ্গারা আরাকানের (রাখাইন) স্থায়ী বাসিন্দা; তাই রোহিঙ্গাদের ‘স্থানীয়’ স্বীকৃতি দিয়ে সংসদে আইন পাস করতে হবে, আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও পরিচয়পত্র দিতে হবে, রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে; কেড়ে নেওয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে, আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং মিয়ানমারের স্থানীয় আদালতের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অপরাধীদের বিচার করতে হবে।
অবশ্য রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ইতিহাস নতুন নয়। নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা এ জনগোষ্ঠী গত চার দশকে বহুবার বাংলাদেশে আশ্রয় খুঁজেছে। ১৯৭৮ সালে প্রথম বড় আকারে রোহিঙ্গা আগমন ঘটে। এরপর ১৯৯১-৯২ সালে আসে আরও একটি ঢেউ। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর সংঘটিত মানবিক বিপর্যয় ছিল পূর্ববর্তী সব সংকটকে ছাপিয়ে যাওয়া এক ভয়াবহ অধ্যায়। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। যা বিশ্বের অন্যতম দ্রুততম শরণার্থী আগমনের উদাহরণ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধন’ বা সরাসরি ‘গণহত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
পূর্বে আশ্রিত ৩ লাখসহ বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩২টি শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে আনুমানিক ১২ লাখ রোহিঙ্গা। একটি স্বল্প পরিসর এলাকায় এত বিশাল জনগোষ্ঠীর চাপ বহন করছে একটি উন্নয়নশীল দেশ। শিবিরবাসীরা প্রতিদিনই খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার অভাব এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। যৌন সহিংসতা, পাচার ও শিশুশ্রমের মতো সমস্যা তাদের বাস্তবতা। অনেক শিশু জন্মের পর থেকে শিবিরেই বেড়ে উঠছে। তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি সম্পর্কে কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতাই নেই।
রোহিঙ্গা আগমনের শুরুর দিকে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণ বিপদাপন্ন এ জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতি ও মানবিক সহায়তা প্রদান করেছিল। তবে সময়ের ব্যবধানে সে সহানুভূতির স্থান দখল করেছে উদ্বেগ, ক্লান্তি এবং ক্ষোভ। এর পেছনে রয়েছে বাস্তব ও দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব। স্থানীয় শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ, সরকারি ও বেসরকারি সাহায্যের একচেটিয়া প্রবাহ এবং অবকাঠামোগত চাপ স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রায় সংকট সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হয়েছে পরিবেশ।
আশ্রয় শিবির স্থাপনের জন্য হাজার হাজার হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছে এবং বহু বন্যপ্রাণী তাদের আবাসস্থল হারিয়েছে। পাশাপাশি, কৃষি ও মৎস্য খাতে রোহিঙ্গা আগমনের নেতিবাচক প্রভাব স্থানীয় অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। অনেক কৃষক ও জেলে তাদের পেশা থেকে বিতাড়িত হয়েছে, যা জীবিকা সংকটের নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এখানেই শেষ নয় বরং রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক পাচার এবং মানব পাচারের মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এ অপরাধচক্রে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাÑউভয় পক্ষের কিছু দুর্বৃত্ত জড়িত থাকায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো শিবিরে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সক্রিয়তা ও প্রভাব। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং অন্যান্য সংগঠন একদিকে রোহিঙ্গাদের মাঝে ভীতি সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে শিবিরগুলো ক্রমশ অপরাধ-নিয়ন্ত্রিত ও রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে।
রোহিঙ্গা সংকটের সূচনালগ্নে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো বিপুল পরিমাণে সহায়তা প্রদান করেছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এ সহায়তার পরিমাণ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চাহিদার তুলনায় মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ অর্থায়ন মিলছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সহায়তা সংস্থা USAID- সহ অন্যান্য প্রধান দাতাগোষ্ঠীর তহবিল সংকোচনের ফলে খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অন্যান্য মৌলিক সেবায় ব্যাঘাত ঘটছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। যার ফলে রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রার মানের মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটেছে এবং তা এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আমাদের দেশ একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। নিজস্ব অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশটি সংগ্রাম করছে। এর মাঝে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। প্রতি বছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে শরণার্থীদের জন্য, যা দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন খাত থেকে সরিয়ে দিতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়নে যে অর্থ ব্যয় হতো, তা এখন রোহিঙ্গা সংকটে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
রোহিঙ্গা সংকট কেবল মানবিক ইস্যু নয়; এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে মিয়ানমার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চাপ এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে তাদের ভেটো ক্ষমতার কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের নানা সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশেষত গাজার চলমান মানবিক বিপর্যয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে ক্রমেই ছিটকে পড়ছে।
সম্মানজনক ও স্বেচ্ছাকৃত প্রত্যাবাসন যেকোনো প্রেক্ষাপটে সর্বোত্তম সমাধান। কিন্তু যেহেতু এর সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং স্থানীয়ভাবে একীভূতকরণও সম্ভব নয়Ñএমন অবস্থায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কেবল মানবিক সহানুভূতি যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও বহুমাত্রিক পরিকল্পনা। প্রথমত, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাখাইন রাজ্যে তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক পুনর্বাসন (তৃতীয় কোনো দেশে) হতে পারে একটি বাস্তবসম্মত বিকল্প। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ স্বল্প পরিসরে রোহিঙ্গা গ্রহণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সীমিত। এ উদ্যোগকে আরও সম্প্রসারণ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমন্বয় প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে।
মূলত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিমুখী নীতিই রোহিঙ্গা সংকটের একটি বড় ধরনের অন্তরায়। মিয়ানমারের খনিজ সম্পদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের যে ব্যাপক আগ্রহ ও কৌশলগত তৎপরতা, তার ক্ষুদ্র একটি অংশও যদি ভাগ্যাহত রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকটে বরাদ্দ করা হতো, তাহলে তাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন এতদিনে দুঃসাধ্য হতো না, বরং তা খুবই বাস্তবতা হতে পারত। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের নামে বিশ্বমঞ্চে যত উচ্চকণ্ঠ বক্তৃতা শোনা যায়, তার বাস্তব প্রয়োগ দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনুপস্থিত। মূলত, এ দ্বিমুখী আচরণ কেবল মানবিক মূল্যবোধকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে নি, বরং এটি মানবতার নামেই এক গভীর কলঙ্কচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এখনই সময় এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উচিত সমান দৃষ্টিভঙ্গি, ন্যায়ভিত্তিক সহানুভূতি এবং কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করা।
রোহিঙ্গা সংকটের আট বছর পার হলেও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এখন পর্যন্ত নেই। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন আরও জটিল ও সহিংস হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি সহনশীলতাও এখন চাপের মুখে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যদি দ্রুত ও কার্যকর আন্তর্জাতিক উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল ও বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে। শিবিরে জন্ম নেওয়া এবং সেখানেই বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের রোহিঙ্গাদের মধ্যে জমে ওঠা হতাশা, ক্ষোভ ও ভবিষ্যৎহীনতা চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, যা সমাজ ও নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও দৃঢ়, সমন্বিত ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মানবিক সহায়তার পাশাপাশি মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ জোরদার করতে হবে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শুধু প্রতীকী না হয়ে কার্যকর হতে হবে। যাতে মিয়ানমার সরকার নাগরিক অধিকার পুনর্বহাল ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পথ প্রশস্ত করতে বাধ্য হয়। আসলে বাংলাদেশের ওপর এককভাবে এ সংকটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। আঞ্চলিক শক্তিগুলো বিশেষ করে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে। একইসঙ্গে, মুসলিম বিশ্বের ধনী দেশগুলোকেও মানবিক ও কূটনৈতিকভাবে দৃশ্যমান এবং অর্থপূর্ণ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু সহানুভূতি নয়Ñপ্রয়োজন বাস্তবসম্মত, সমন্বিত ও টেকসই কৌশল।
রোহিঙ্গা সংকটের আট বছর পূর্ণ হওয়ার এ সন্ধিক্ষণে স্পষ্টভাবে বলতে হয়Ñমানবিকতার এ কঠিন পরীক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায় ব্যর্থ হয়েছে। একটি জাতিগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টাকে রোধ করা তো দূরের কথা, বরং মৌলিক অধিকার থেকেও তাদের দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ সীমিত সম্পদ ও অবকাঠামো নিয়ে তার সক্ষমতার অতিরিক্ত মানবিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট কোনো একক দেশের সমস্যা নয়Ñ এটি একটি বৈশ্বিক মানবিক ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মাঝে মধ্যেই আশার বাণী শোনা গেলেও দীর্ঘ ৮ এর কোন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়নি। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একজন শরণার্থীকে সে দেশে ফেরৎ পাঠানো সম্ভব হয়নি বরং পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। নানা ছলছুঁতায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সবকিছু পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে। প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক সমর্থনের বাংলাদেশও কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ এখন নিশ্চিত গন্তব্যেই রয়ে গেছে এবং চলমান সংকট ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতরই হয়েছে।
এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্বিচারিতা বন্ধ করে খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মূলত, এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নয় বরং এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। তাই এ সমস্যার সমাধান হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবেই। আর রোহিঙ্গা পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা দিয়ে স্বদেশে ফেরৎ পাঠানোই এ সংকটের প্রকৃত সমাধান। আর এ জটিলতা নিরসন শুধু বাংলাদেশের নয় বরং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের।