এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া

‘পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ’ পৃথিবীতে সবচাইতে ভারী বস্তু। আর সেটা যদি হয় ছোট ছোট কোমলমতিদের লাশ তাহলে তা বহন করা আরও দুঃসাধ্য’। ছুটির পর যে স্কুল ক্যাম্পাস থাকতো কোলাহলে মুখর তা ভেসে গেল আর্তনাদে। স্কুল ছুটির পর জীবন থেকেও ছুটি নিলো কোমলমতিরা। মুহূর্তেই তারা হয়ে গেলো আকাশের তারা। বিষাদে ছেয়ে গেল আকাশ-বাতাস। এতো শোক সহ্য করা বড়ই কঠিন।

দেশে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে, একের পর এক তাজা প্রাণ চলে যাচ্ছে। কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টেলিভিশনের পর্দা থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে সরগরম থাকে এসব ইস্যুতে। প্রশাসন থেকে নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ, আবার সব চুপচাপ হয়ে যায়। প্রশ্ন উঠে মৃত্যুর মিছিল কোথায় থামলে টনক নড়বে রাষ্ট্রের?’ দুর্ঘটনার ওপর মানুষের হাত নেই। তাই বলে এমন দুর্ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না, যাতে বিদ্যালয়ে পাঠ নিতে যাওয়া শিশুরা ফিরে এল লাশ হয়ে। একটি দুর্ঘটনায় এত বেশি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা বিরল। এ ঘটনায় কেবল স্বজনহারা পরিবার নয়, পুরো বাংলাদেশ শোকাহত।’

রাষ্ট্রসহ আমাদের সকলকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। যাতে আর কোনো শিশু-কিশোর যেন অকালে ঝরে না যায় সে জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রকে। মৃতের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। যারা স্বজন হারিয়েছেন কোনও প্রতিদানই তাদের শোক ভোলাবে না। তবুও সরকারকে শিশু হারানো পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং ঝলসে যাওয়ারা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন রাষ্ট্রকে তাদের পাশে থাকতে হবে। উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্থের ঘটনাটি কিভাবে ঘটল, সরকারকে তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এটি কি নিছক কোন দুঃর্ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র। প্রয়োজনে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।

এ দুর্ঘটনাকে কোনোভাবে শুধু ত্রুটির কারণে ঘটেছে বলে শিশু-কিশোরদের হত্যার দায় সরকার এড়াতে পারবে না। প্রশিক্ষণ বিমানের এ দুর্ঘটনাকে স্মরণকালের ইতিহাসের অন্যতম দুঃখজনক ও ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এ দুঘর্টনা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে ‘বসতিপূর্ণ এলাকায় এমন বিমান চলাচল বা প্রশিক্ষণের যৌক্তিকতা কী থাকতে পারে ? এ দুঘর্টনায় যে ক্ষতি হয়েছে সেগুলো কি আদৌ পূরণযোগ্য?’ শাহাদাত বরণকারী ও আহত শিশু-কিশোরদের বাবা-মা ও পরিবারের পাশাপাশি আমরা সবাই শোকাহত, এ শোকে সান্ত্বানার কোনও ভাষা নেই। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। দুর্ঘটনায় অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। যারা বেঁচে থাকবে তারাও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে বলে চিকিৎসকরা আশা করতে পারছেন না। শিশুরা মরে গেলো, ওদের মা-বাবার চোখের জল কী দিয়ে পূরণ করবে রাষ্ট্র ? যে মায়ের বুক খালি হয়েছে সে মা আজীবন এ কষ্ট বয়ে বেড়াবে।

সরকারকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নিহতদের সঠিক নাম ও তথ্য প্রকাশ করে নিহত প্রতিটি শিক্ষার্থীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, আহতদের যথাযথ চিকিৎসার সব ধরনের সহায়তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে এবং বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো বিমানগুলো বাতিল করে আধুনিক বিমান চালু করতে হবে।’

এ ঘটনার দায় শুধু পাইলট বা প্রশিক্ষক প্রতিষ্ঠানের নয়। এটি রাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থার। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন—কেউই দায় এড়াতে পারে না। কেন স্কুলের ছাদে বিমান পড়লো? নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোথায় ছিল? আগুন লাগার পর উদ্ধার কাজে কতটা প্রস্তুত ছিল ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী? আহতদের চিকিৎসায় কতটা সক্ষমতা দেখিয়েছে হাসপাতালগুলো? এ ঘটনা যেন আগুনে পুড়ে যাওয়া কিছু ভবনের মেরামতে আটকে না যায়। সন্তান হারানো মা-বাবার বুকফাটা আর্তনাদ কি রাষ্ট্র শুনবে? আজ যারা কাঁদছে, আগামীকাল তারা ন্যায়বিচারের জন্য পথে নামবে। এ শোক যদি প্রতিবাদে পরিণত হয়, তাহলে রাষ্ট্রকে তাদের জবাব দিতেই হবে। কারণ যারা হারিয়েছে তারা কেবল সন্তান নয়, নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়েছে। তাই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

বিমান দুঘটনার পর নানা প্রশ্ন উঠেছে। জনমনে দেখা দিয়েছে নানা উদ্বেগ। প্রশ্ন উঠেছে ‎৯ মে, ২০২৪ স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ একটি ট্রেনিং মিশনে প্রাণ হারান। প্লেনটি যান্ত্রিক ত্রুটির শিকার হয়। তিনি শেষ মুহূর্তে জনবহুল এলাকা থেকে প্লেনটি সরিয়ে বড় ক্ষতি ঠেকিয়েছিলেন। ‎কিন্তু, তাওকির ইসলাম আরেকটি ভাঙারি বিমানের যান্ত্রিক ব্যর্থতায় প্রাণ দিলেন। ‎প্রশ্ন একটাই: কতজন মারা গেলে সরকার বা কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারবে এসব প্লেন আর “ট্রেনিং” উপযোগী নয়?

‎বাংলাদেশের আকাশে এখনো সত্তরের দশকের প্লেন উড়ছে, যেগুলো আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে তো নয়ই, প্রশিক্ষণের জন্যও উপযুক্ত নয়। এ প্লেনগুলো পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো ৩০ বছর আগেই রিসাইক্লিং কারখানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ‎বাংলাদেশের একজন পাইলটের জীবন কি এতটাই সস্তা? আপনি যদি নিজের সেনাবাহিনী, এয়ারফোর্সের ভবিষ্যৎ নিয়েই উদাসীন থাকেন, তাহলে কার নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন?

সোমবার উত্তরায় স্কুলভবনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ঘন কালো ধোঁয়া, মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা আর প্রিয়জন হারানো পরিবারের কান্না দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো দেশ। পুরো পরিস্থিতি বুঝে উঠতে সময় লাগছে, কিন্তু একটা কথা সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল: এমন বিপদে কী বলতে হবে বা কী করতে হবে, তার জন্য আমাদের সংস্থাগুলো তৈরি ছিল না। আমরাও নাগরিক হিসেবে তৈরি ছিলাম না, এটা স্পষ্ট। ঘটনার পরেই উপলব্ধি করা গেলে, বাংলাদেশে বিপদ সামলানোর ব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি রয়েছে। আমরা এখন এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে একটা এক্স পোস্ট (টুইট) দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, অথচ বিপদ নিয়ে কথা বলার আমাদের পদ্ধতি এখনো অনেক পুরোনো আমলের। এমন দুঃখজনক ঘটনা বার বার বিভিন্নভাবে গঠলেও আমাদের জাগিয়ে তুলতে পারছে না। বাংলাদেশের এখনই দরকার ভালো পরিকল্পনা করে কথা বলা এবং বিপদ মোকাবেলায় বিভিন্ন কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করা। বিপদ হওয়ার পর তা নিয়ে ভাবলে হবে না, বরং এগুলো দেশ পরিচালনার এবং নাগরিকের দায়িত্বের মূল অংশ হতে হবে।

সময়মতো সুনির্দিষ্ট সরকারি তথ্য প্রদানে সরকার ব্যর্থ হবার কারণেই নানা ভুল তথ্য ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে একটি মহল এবং তারা ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টাও করেছে। জনমনে নানা ধরনের আতংক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে তারা। যাচাই না করা ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। বিদেশি ষড়যন্ত্র, পাইলটের আত্মহত্যা, এমনকি অদ্ভুত সব গুজবও মানুষের মুখে মুখে এখনো ঘুরছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল, ভালো মানুষ আর সুযোগসন্ধানী সবাই মিলে তা ছড়াচ্ছিল। যখন সত্যি খবর দ্রুত পাওয়ার সুযোগ থাকে না, তখন মানুষ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, মানুষ আতঙ্কিত হয়। যখন বিপদ আসে, তখন সবার আগে বিশ্বাস ভেঙে যায় না—তথ্য না থাকলেই বিশ্বাস মরে যায়।

২১ জুলাই বাংলাদেশের জন্য এমন এক অবর্ণনীয় শোক নিয়ে এল, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তরা শাখার দোতলা স্কুল ভবনে আছড়ে পড়া বিমান এখন পর্যন্ত কেড়ে নিল পাইলটসহ অনেকগুলো প্রাণ, যার প্রায় সবাই শিশু। আরও বহু শিশু হাসপাতালের বিছানায় পোড়া শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছে। অনেক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা আমরা দেখেছি। বিগত সরকারগুলোর নানা দমন-পীড়ন আমরা দেখেছি। আমাদের চোখের সামনে কত সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীকে হারিয়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু এমন করে ছোট ছোট শিশুকে আকুতি নিয়ে চলে যেতে দেখিনি।

রাষ্ট্রকে তার জনগণের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে যা করণীয়, তাই করতে হবে। তা বাস্তবায়ন করার জন্য আর বসে থাকার মতো কোনো সময় কারো হাতে নাই।

লেখক : রাজনীতিক কর্মী।