॥ মুহাম্মদ মু’তাছিম বিল্লাহ মাক্কী ॥

রহমত, মাগফিরাত, শাস্তির নিকৃষ্টতম আবাসস্থল জাহান্নামের আযাব থেকে নাজাতের সুমহান বার্তা নিয়ে প্রতিবছর মুসলিম উম্মাহর দুয়ারে হাজির হয় পবিত্রতম মাস রমাদান। যে মাসটি অগণিত মহিমায় উদ্ভাসিত, অজস্র গুণে গুণান্বিত, অসংখ্য কল্যাণে পরিপূর্ণ। রাব্বুল আলামীন এ মাসটিকে হাজারো মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। মুমিনের জীবনে অফুরন্ত সাওয়াব প্রাপ্তি এবং তার মালিকের সন্তুুষ্টি ও নৈকট্য লাভের এক দুর্লভ মৌওসুম এ মাসটি। রমাদান মাসের সীমাহীন মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে কদর রাত বা ভাগ্য গড়ার রজনী প্রাপ্তির সুনিশ্চিত প্রত্যাশায় সর্বোপরি মহান আল্লাহ তা’আলার একান্ত সান্নিধ্য লাভের লক্ষ্যে রমাদানের শেষ দশকে মসজিদে অবস্থান করার এক চকমপ্রদ ও ব্যতিক্রমধর্মী ইসলামী বিধানের নাম ই’তিকাফ। যা মুমিনের ঈমানকে সতেজ, প্রানবন্ত, উদ্দীপ্ত, জীবন্ত ও চাঙ্গা করার এক অনন্য হাতিয়ার।

ই’তিকাফ আরবি শব্দ। আকফুন মূল ধাতু থেকে নির্গত। শাব্দিক অর্থ অবস্থান করা। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর তোমরা মসজিদে অবস্থানরত বা ই’তিকাফরত অবস্থায় তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো না” (সূরা বাকারাহ: ১৮৭) এছাড়াও শাব্দিকভাবে স্থির থাকা, আকড়ে ধরা, কোন স্থানে আটকে পড়া বা আবদ্ধ হয়ে থাকা ইত্যাদি অর্থ হতে পারে। আভিধানিকভাবে কোনো বস্তুকে বাধ্যতামূলকভাবে ধারণ করা কিংবা কোনো বস্তুর ওপর নিজেকে দৃঢ়ভাবে আটকে রাখার নাম ই’তিকাফ। ইসলামী শরিয়ার পরিভাষায় মহান রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে জাগতিক কাজকর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে বিছিন্ন হয়ে ইবাদতের নিয়াতে একটি নির্দিষ্ট সময় মসজিদে পূর্ণাঙ্গ অবস্থানকে ই’তিকাফ বলে। যিনি ই’তিকাফ করেন তাকে মু’তাকিফ বলা হয়।

ই’তিকাফের শ্রেণিভেদ : ই’তিকাফ তিন প্রকার। ক) সুন্নাত ই’তিকাফ, খ) ওয়াজিব ই’তিকাফ ও গ) মুস্তাহাব/ নফল ই’তিকাফ।

ক) সুন্নাত ই’তিকাফ: রমাদানের শেষ দশকের ই’তিকাফ করা সুন্নাত। অর্থাৎ ২০ রমাদানের সূর্যাস্তের আগ মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত মসজিদে ই’তিকাফ করা। আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বণর্নানুসারে নবী কারীম (সা:) ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত রমাদানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন। এ ধরনের ই’তিকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়াহও বলা হয়। মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই ই’তিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে।

খ) ওয়াজিব ই’তিকাফ : নজর বা মান্নতের ই’তিকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এতদিন ই’তিকাফ করবো অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বললো, আমি এতদিন অবশ্যই ই’তিকাফ করবো। যতদিন শর্ত করা হবে ততদিন ই’তিকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব ই’তিকাফের জন্য সিয়াম শর্ত। হাদিসে এসেছে, ওমর (রা:) একদিন রাসূলকে (সা:) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! জাহেলী যুগে আমি মসজিদে হারামে এক রাত ই’তিকাফ করার মান্নত করেছিলাম। রাসূল (সা.) বললেন, তোমার মান্নত পূর্ণ করো। (বুখারী)

গ) মুস্তাহাব/ নফল ই’তিকাফ : সাধারণভাবে রমাদানের শেষ দশক ব্যতীত যেকোনো সময় ই’তিকাফ করা মুস্তাহাব বা নফল। এর কোনো দিন কিংবা সময়ের পরিমাপ নেই। অল্প সময়ের জন্যও ই’তিকাফ হতে পারে।

ই’তিকাফের শর্তাবলী : ১. মুসলিম হওয়া ২. সুস্থ হওয়া (পাগল না হওয়া) ৩. বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া ৪. ই’তিকাফের নিয়ত করা ৫. পবিত্র থাকা ৬. মসজিদে ই’তিকাফ করা (ইমাম মালেক র:-র মতে জামে মসজিদে ই’তিকাফ করা উত্তম। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল র:-র মতে, যে মসজিদে জামাতসহকারে সালাত হয় না, সে মসজিদে ই’তিকাফ জায়েজ নেই)।

নারীদের ই’তিকাফ : পুরুষদের ন্যায় নারীরাও ই’তিকাফ করতে পারে। তারা গৃহকোণে (নামাযের স্থানে) ই’তিকাফ করবে। নারীর ই’তিকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি আবশ্যক। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এসেছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত রমাদানের শেষের দশকে ইতিকাফ করেছেন। এরপর তাঁর স্ত্রীরা ই’তিকাফ করেছেন।

ই’তিকাফকারীর করণীয় : ই’তিকাফকারী বেশি বেশি কিয়াম বা নফল সালাত আদায়, কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর যিকির, তাসবীহ, ইস্তেগফার, দরুদ, দু’আ, ইলম চর্চাসহ মসজিদে থেকে করা সম্ভব এমন সকল ইবাদতই করতে পারবে।

ই’তিকাফকারীর বর্জনীয় : ই’তিকাফ অবস্থায় যা বর্জন করতে হবে: নিরর্থক, বাজে ও অপ্রয়োজনীয় কথা ও কাজ করা, একেবারেই চুপচাপ বসে থাকা, ঝগড়া-ঝাটি করা, গীবত বা পরনিন্দা করা, মালপত্র মসজিদে এনে বেচা-কেনা করা।

ই’তিকাফের শুরু ও শেষের সময় : যে দিন থেকে ই’তিকাফ করার নিয়াত করবে তার পূর্বের দিন সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করবে আর যেদিন থেকে ই’তিকাফ শেষ করার নিয়াত করবে, ঐ দিন সূর্যাস্তের পর মসজিদ থেকে বের হবে। (আল মাবসুত)

রাসূল (সা.) সুন্নাহর অনুসরণে যে ব্যক্তি রমাদানের শেষ দশকে ই’তিকাফের নিয়াত করবে তিনি ২০ রমাদান দিবাগত সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করবে এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখে মসজিদ থেকে বের হবেন। যেমনটি রাসূল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় করেছেন।

ই’তিকাফ ও ভাগ্য গড়ার রজনী : রমাদান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সময় হলো শেষ দশকের রাত। রাসূলুল্লাহ (সা:) রমাদানের প্রথম বিশ রাতে কিয়ামুল্লাইল করার আগে ও পরে কিছু সময় ঘুমাতেন কিন্তু রমাদানের শেষ দশকের রাতে তিনি সারারাত বা প্রায় সারারাত জাগ্রত থেকে কিয়াম ও ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। শুধু কি তাই! তিনি তাঁর পরিবার পরিজনকেও জাগিয়ে দিতেন। তিনি অত্যন্ত উদ্দীপনার সাথে ইবাদতে রত থাকতেন এবং সাংসারিক, পারিবারিক কাজকর্ম বন্ধ করে দিতেন। রমাদানের শেষ দশ রাতের মধ্যেই রয়েছে “লাইলাতুল কদর” বা ভাগ্য গড়ার রজনী। ইমাম বায়হাকী বলেন: ভাগ্য গড়ার রজনী হলো, এ রাতে আল্লাহ পরবর্তী বৎসরে ফিরিশতাগণ মানুষদের জন্য কি কি কর্ম করবেন তা নির্ধারণ করে দেন। আল্লাহ তা’আয়ালা বলেন, লাইলাতুল কদর এক হাজার মাস থেকেও উত্তম ( সূরা কদর: ৩) এ রাতটি আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত। একটি রাতের ইবাদত এক হাজার মাস বা ৮৪ বছর ইবাদতের চেয়েও উত্তম। শুধু তাই নয়, রাসূলের (সা:) ভাষ্যানুসারে এ রাতে কিয়ামুল্লাইল করলে আল্লাহ পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন।

ই’তিকাফ মূলতই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভের জন্যই এ সময়ে ই’তিকাফের গুরুত্ব বেড়ে যায়। প্রিয় নবী (সা:) তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রমাদানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন।

মুসলিম উম্মাহর জন্য রমাদান মাস শ্রেষ্ঠ নেয়ামতের মাস। এমাসের তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদতগুলোর মধ্যে ই’তিকাফ অন্যতম। যার মাধ্যমে সৃষ্টির সাথে ¯্রষ্টার সম্পর্ক হয় সুদৃঢ়, মুনিবের জন্য তাঁর মস্তক হয় অবনত, ঈমান হয় উজ্জীবিত। বিশ^ মানবতার মহান বন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, আল্লাহ’র প্রিয় হাবীব (সা.) নিজে ই’তিকাফ করেছেন এবং সাহাবাদেরকেও তা করার জন্য উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। যদি কখনো তাঁর ই’তিকাফ ছুটে যেতো তবে তিনি ঈদের মাসে তা আদায় করতেন। সুতরাং আমরা বলতে পারি, মুমিন জীবনে তার মালিকের সান্নিধ্য লাভ ও ঈমানকে সজীব-জীবন্ত করার এক অনন্য হাতিয়ার এবং মুখ্যম সুযোগের নাম ই’তিকাফ।

লেখক : অধ্যক্ষ, নিবরাস মাদরাসা।