॥ ইবরাহীম খলিল ॥

চরম উত্তেজনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চলছে। বলা হচ্ছে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য টেবিলটকে বসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যেও কিন্তু বাকযুদ্ধ থেমে নেই দেশ দুটি’র মধ্যে। যুদ্ধবিরতি নিয়ে ভারত পাকিস্তানের সমঝোতার পর দুই দেশেই জনমনে স্বস্তি ফিরছে। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত মানুষের মধ্যে আপাতত আতংকের ইতি ঘটেছে। যুদ্ধাবস্থার কয়েকটা দিন তাদের বাঙ্কারে অতিবাহিত করতে হয়েছে। যারা বাসা বাড়িতে ছিল তারাও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন কাটিয়েছে। কারো ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিল না। ট্রেন ও বাস চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এমনকি রাত ৮টা থেকে বিদ্যুৎ পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হতো। তবে এখন সেখানকার মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরেছে। শিশুরা মনখোলাভাবে খেলাধুলা করতে পারছে। সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোর মানুষ তাদের ব্যবসা বাণিজ্যে ফিরতে শুরু করেছে। ট্রেন বাস চলাচল আবারো শুরু হয়েছে। মানুষ একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে পারছে নির্বিঘœভাবে। তবে পাল্টাপাল্টি হামলা থামলেও থামেনি দুই দেশের মধ্যকার বাকযুদ্ধ। এছাড়া সংঘাত নিয়ে চলছে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি দাবিও।

দুই পক্ষই শান্তি রক্ষায় আন্তঃসংশ্লিষ্ট যোগাযোগ চালিয়ে যাবে বলে নিশ্চিত করেছে। এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত বন্ধে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের ৩২টি বিমানবন্দর খুলে দিয়েছে ভারত। এগুলোর মধ্যে শ্রীনগর, জম্মু, চন্ডীগড়, অমৃতসর, জয়সলমির, যোধপুর, জামনগর ভুজসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর রয়েছে। পাকিস্তানও তাদের আকাশ সীমা উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, একজন নারীর সিঁদুর মুছে ফেলার মূল্য কতটা চড়া হতে পারে তা সশস্ত্র বাহিনীর পদক্ষেপে নিশ্চিত হয়েছে। এছাড়া কোনও ধরনের পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইল সহ্য করা হবে না বলেও হুমকি দিয়েছেন তিনি। মোদি বলেন, আর সন্ত্রাসবাদীদের চোখরাঙানি সহ্য করবে না ভারত। পাকিস্তানকে যদি বাঁচতে হয় ওদের সন্ত্রাসের পরিকাঠামো নির্মূল করতে হবে। ‘টেরর’ ও ‘টক’ (সন্ত্রাস এবং আলোচনা) একসঙ্গে চলতে পারে না। পানি এবং রক্ত একই সঙ্গে বইতে পারে না। তিনি আরও বলেন, বিশ্বে বড় বড় সন্ত্রাসবাদী হামলা একই সুতোয় বাঁধা। তাই ভারতের হামলায় সন্ত্রাসবাদের ‘হেড কোয়ার্টার’ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান হতাশ। ওরা নিরাশায়। এই অবস্থায় ওরা আরও একটা ভুল করেছে। ভারতের সঙ্গ দেওয়ার বদলে ভারতের উপরেই হামলা করল!

তিন দিনে পাকিস্তানকে যা করা হয়েছে, তা ওরা ভাবতেই পারেনি। এখন তারা বাঁচার রাস্তা খুঁজছে। দেশে দেশে ঘুরছে। খারাপভাবে হেরে যাওয়ার পরে ১০ মে পাকিস্তানী সেনা আমাদের ডিজিএমও-র দ্বারস্থ হন। তার আগে আমরা পাকিস্তানের মাটিতে থাকা সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছি।

অন্যদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আসন্ন আলোচনায় ‘পানি সমস্যা’ সমাধান না হলে দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ বিরতি হুমকির মুখে পড়তে পারে। তিনি বলেন, পানি সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতা ‘একটি যুদ্ধ ঘোষণা করার সমান’ হবে।

সাক্ষাৎকারে ইসহাক দার আরও বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কোনো ইচ্ছা নেই পাকিস্তানের। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ৭ মে ভারতের বিনা উসকানিতে চালানো সীমান্ত আক্রমণের জবাবে ইসলামাবাদ কেবল আত্মরক্ষার্থেই পাল্টা হামলা চালিয়েছে। দার বলেন, সাম্প্রতিক উত্তেজনার মধ্যে ভারত একতরফা চুক্তি স্থগিত করেছে, যা আরও বিপজ্জনকভাবে যুদ্ধবিরতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, পাকিস্তানের অবস্থান খুব পরিষ্কার। ভারতকে এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করতে হবে। তা না হলে দার সতর্ক করে বলেন, এটি যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য হবে।

দার ভারতের সামরিক অভিযানকে ‘একটি যুদ্ধ’ এবং ‘কাশ্মীর অঞ্চলে নিজের আধিপত্য কায়েমের একটি কল্পনাপ্রসূত চেষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করেন। তবে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘পারমাণবিক বিকল্প কখনোই আলোচনার টেবিলে ছিল না। তিনি আরও বলেন, ‘এমন সময় আসে যখন আপনাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমরা খুব নিশ্চিত ছিলাম যে আমাদের প্রচলিত সামরিক ক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী আকাশে এবং স্থলে আমরা তাদের পরাজিত করতে পারবো। তিনি আরও বলেন, ভারতীয়রা আকাশে যা দেখেছে, তা তারা ভুলবে না। তারা দেখতে পেরেছে যে ক্ষয়ক্ষতি কতটা ভয়াবহ ছিল।

যুদ্ধ নিয়ে ভারতীয় সেনার ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনস লেফটোন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই, বিমানবাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অফ এয়ার অপারেশনস এয়ার মার্শাল একে ভারতী এবং নৌবাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অফ নেভাল অপারেশনস ভাইস অ্যাডমিরাল এএন প্রমোদ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের তথ্য দেন।

তারা দাবি করেছেন, অপারেশন সিঁদুরের ফলে ৩৫ থেকে ৪০ জন পাকিস্তানী সেনা মারা গেছেন। পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে। চাকলালা, রফিকি, সরগোদা, জাকোকাবাদ, ভুলারির মতো অনেকগুলো সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ করা হয়েছে। ভারতের নৌবাহিনী করাচিতে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। তারা সেইমতো পজিশন নিয়েছিল। লেফটেন্যান্ট জেনারেল ঘাই জানিয়েছেন, নয়টি জঙ্গী ঘাঁটিতে হামলা করা হয়েছিল। তার ফলে ইউসূফ আজহার, আব্দুল মালিক রউফ এবং মুদস্সর আহমেদসহ একশর বেশি জঙ্গী মারা গেছে। মৃত জঙ্গীদের মধ্যে আইসি ৮১৪ অপহরণ এবং পুলওয়ামা হামলায় জড়িত জঙ্গীও রয়েছে।

তারা জানিয়েছেন, ভারতের লক্ষ্য ছিল জঙ্গীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো। পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুর, মুরিদকে, মুজাফফরাবাদের জঙ্গী ঘাঁটিতে আক্রমণ করে সেগুলোকে বিধ্বস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তান ৮ ও ৯ মে -তে ভারতের সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা করার চেষ্টা করে। শ্রীনগর থেকে নালিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ড্রোন, পাইলটহীন বিমান দিয়ে হামলা করতে চেয়েছিল। ভারতের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সেগুলোর মোকাবিলা করে এবং তা ব্যর্থ করে দেয়। পাকিস্তানের বেশ কিছু যুদ্ধবিমান ভারতীয় সীমান্তে ঢোকার আগে গুলী করে নামানো হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।

ভাইস অ্যাডমিরাল এএন প্রমোদ বলেছেন, পেহেলগামের ঘটনার পরে ভারতীয় নৌবাহিনীর ডুবোজাহাজ, রণতরী, বিমানসহ সমস্ত বিভাগকে সমুদ্রে মোতায়েন করা হয়েছিল। নৌবাহিনী ৯৬ ঘণ্টার মধ্যে আরব সাগরে বেশ কিছু জায়গায় কৌশলগত অবস্থান নেয়। তারা করাচিসহ পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করার জায়গায় ছিল। পাকিস্তান পুরোপুরি রক্ষণাত্মক অবস্থান নেয়। সেনাকর্তারা জানিয়েছেন, পাঁচজন ভারতীয় সেনা সংঘাতে মারা গেছেন। ভারতের রাফাল যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে, তারা বলেছেন, লড়াইয়ে কিছু ক্ষতি হয়ে থাকে। যেহেতু সংঘর্ষ এখনো সম্পূর্ণভাবে থামেনি, তাই এই বিষয়ে এখনই তথ্য প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে সব পাইলট নিরাপদে দেশে ফিরে এসেছেন বলে তারা জানিয়েছেন।

পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল, পাবলিক রিলেশনস এয়ার ভাইস মার্শাল আওরঙ্গজেব আহমেদ, নৌবাহিনীর ন্যাভাল স্টাফ(অপারেশন) ডেপুটি চিফ ভাইস অ্যাডমিরাল রাজা রাব নওয়াজ এবং পাকিস্তান সেনার প্রধান মুখপাত্র লেফটোন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ভারত পাকিস্তানের আকাশসীমা লংঘন করার পর তারা অপারেশন ‘বুনইয়ানুম মারসুস’ শুরু করেন। ভারতের ২৬টি সামরিক টার্গেট লক্ষ্য করে হামলা করা হয়। এই টার্গেটের মধ্যে ছিল সুরাতগড়, সিরসা, আদমপুর, ভুজ, নালিয়া, ভাতিন্দা, বারনালা, হালওয়ারা, অবন্তীপুর, শ্রীনগর, জম্মু, মামুন, আম্বালা, উধমপুর ও পাঠানকোট। প্রতিটি জায়গায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাদের দাবি, ব্রক্ষ্মস ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভারত পাকিস্তানে হামলা করেছিল। সেই ফেসিলিটি ধ্বংস করা হয়েছে।

পাকিস্তানের সেনাকর্তাদের দাবি, তাদের নৌবাহিনী মুম্বাইয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। তারা জানিয়েছেন, পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতির অনুরোধ করেনি। পাকিস্তান খুবই সংযত ও পরিণতভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে।

ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে আশাপাশের দেশগুলো। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে আমদানি রফতানির মধ্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। জনজীবনে এক ধরনের অস্বস্তি দেখা দেয়। এদিকে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চললেও বাকযুদ্ধ এবং দুই দেশের উত্তপ্ত হুমকি বিনিময় কারো জন্যই স্বস্তির আভাস দেয় না। বরং অস্বস্তির জায়গাটা আরও বাড়িয়ে তুলে। আমরা চাই দুই পরমাণু শক্তির দেশ আলোচনার টেবিলে বসেই আলাপ আলোচনা করুক। উত্তেজনার মাত্রাটা কমে আসুক। আসন্ন ইস্যুগুলোর একটা যৌক্তিক সমাধান হউক। দীর্ঘ দিনের শত্রুতা শত্রুতা খেলা বন্ধ হউক। লেখক : সাংবাদিক।