অধ্যক্ষ মোঃ শাহাবুদ্দিন
জুলাই ’২৪ বিপ্লব এক বছর পার হয়েছে কিন্তু এখনো বিপ্লবের ফল স্থায়ীরূপ নিতে পারছে না। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য বলেই জনগণ ভাবনায় পরেছে। উপদেষ্টা কর্তৃক গঠিত ৬ টি সংস্কার কমিশন জাতির আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে বলার অপেক্ষা রাখে না। এক্ষেত্রে দেশের সব রাজনৈতিক দল একত্রে মুখোমুখি বসে সব বিষয়ে ঐকমত্যে আসার জন্য জোরালো ভূমিকা রেখে চলছে, এ বিষয়ে বলার তেমন কোন কথা না থাকলেও আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের ক্ষেত্রে যেমন একমুখী গন্তব্য ছিল সংস্কারের ক্ষেত্রে ঐকমত্যে সে অবস্থা লক্ষ্য করা যায়নি। সংস্কার কমিশন ৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। তারা ৩১ জানুয়ারী ২০২৫ তারিখের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করে। মোট সুপারিশ সংখ্যা ছিল ১৬৬। সংবিধান সক-৭০টি, জনপ্রশাসন সক-২৬টি, নির্বাচন সক- ২৭টি, দুদক সক-২৭টি, বিচার বিভাগ সক-২৩টি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ প্রধান উপদেষ্টাকে সভাপতি ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানকে সহসভাপতি এবং অন্যান্য কমিশনের প্রধানদের নিয়ে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
৩৫টি রাজনৈতিক দল ও ২টি জোট (১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট) তাদের মতামত কমিশনের নিকট প্রেরণ করে।
২০ মার্চ-১৯ মে’২৫ পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সাথে কমিশনের ৪৭ টি বৈঠক হয়। পরবর্তীতে গুরুত্ব বিবেচনায় ২০টি বিষয়ে দ্বিতীয় দফায় আরো অনেক কয়টি বৈঠক হয়। এসব বৈঠকের ফলাফলস্বরূপ জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ সর্বসম্মতভাবে প্রণীত হয়। কমিশনের ৬ টি বিষয়ের অধিক সংখ্যক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হলেও এখনো কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট আছে এবং কিছু কিছু বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। যাহোক কমিশনের মেয়াদকাল বৃদ্ধির ফলে আশা করা যায় অবশিষ্ট বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হতে পারে। যদিও জানা যাচ্ছে কোন কোন দল কিছু কিছু বিষয়ে পুণরায় শর্ত শিথিল করতে পারে।
জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষিত হয়েছে। নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে কি না এ বিষয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কতিপয় দলের বক্তব্য দৃশ্যমান বিচার ও সংস্কার এবং জুলাই সনদের আইনী ভিত্তির মাধ্যমে নির্বাচন হতে হবে আবার অন্যান্যরা বলছে যত তারাতাড়ি সম্ভব নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া দরকার এবং জুলই সনদ পরবর্তী সংসদে আইনে রুপান্তরিত করা হবে। এ ক্রোসিং পয়েন্টে জাতি দু’টানা টানির মধ্যে পরেছে। প্রত্যেক পক্ষই স্ব স্ব যুক্তি দিয়ে নিজেদের পক্ষে রায় নেওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত আছে। আইনজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত ও আতীতের ব্যতিক্রমি সরকার গঠনের ইতিহাস উল্লেখ করেও এর সমাধান টানা যাচ্ছে না। এখন উপায় কী? দেশটা কি আবারো একটি সংকটের মুখে পড়বে? কেন তাহলে দু’হাজার প্রাণের কলিজার রক্ত ঝড়ল এবং কেনই বা ত্রিশ হাজারের অধীক প্রাণ পঙ্গুত্ব বরণ করল?
জুলাই সনদের আইনিভিত্তি নিয়ে আমার প্রশ্ন : কোন কোন দল আইনি ভিত্তি পরবর্র্তী সংসদে বলছে আবার কতিপয় দল বলছে আগে আইন ভিত্তি তৎপর সকল কার্যক্রম শুরু করতে অনুমোদিত হবে। কাদের যুক্তি গ্রহণ যোগ্য? প্রথম পক্ষ না দ্বিতীয় পক্ষের? জিজ্ঞিাসা করতে চাই জুলাই সনদ তৈরির প্রয়োজনীয়তা কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে? এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অবৈধভাবে এবং ফ্যাসিজমের মাধ্যমে বিগত সরকার জাতির ঘারে জগদ্দল পাথরের মত চেপেবসেছিল, দীর্ঘ কয়েক বছরের রাজত্বে সংবিধানের প্রায় অর্ধশতকের অধিক ধারা নিজেদের দলীয় স্বার্থে রদবদল করে নিয়েছে। জাতির বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর চেতনার সাথে ঐ সরকারের মনগড়া সংবিধান-সংশোধন সাংঘর্ষিক হওয়ায় তা একান্ত সংশোধন যোগ্য হওয়ায় গণঅভ্যুত্থানের পর সর্ব্বদলীয়ভাবে এগুলি সংশোধন করে তার আইনীভিত্তিক আবশ্যক বলে দাব করছে। তাদের মতে সংস্কারগুলি যদি এখনই আইনিভিত্তি লাভ না করে পুরাতন সংবিধানের আলোকেই আসন্ন নির্বাচন করা হয় তার বৈধতা ও মজবুতি কতটা লাভ করবে? ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর পুরাতন সংবিধান অনুসরণ করলে তো ২০২৯ এ নির্বাচন করত হবে এখন কেন? তাহলে কি শেখ হাসিনা যে দাবি করছেন তিনি বাংলাদেশের এখনও প্রধানমন্ত্রী! এটাকি ঠিক? বলবেন না। প্রশ্ন- কোন্ ক্ষমতা বা আইনের বলে অন্তরবর্তী সরকার গঠন হয়েছে, ৬টি কমিশন কেন ১৬৬টি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলির সাথে ঐকমত্য কমিশন করে জাতির অভিব্যক্তির রূপদানের চেষ্টা করছে? কোন কোন নেতৃবৃন্দ এমনও বলার চেষ্টা করছেন জুলাই সনদের অঙ্গীকার নামা ২নং ও ৪নং ধারার যা বলা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
দেখা যাক এ দুটি ধারায় কি আছে?
অঙ্গীকার-২ : এ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। এমতাবস্থায় আমরা রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ প্রণয়ন করেছি বিধায় এ সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানের অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করব এবং বিদ্যামান সংবিধান বা অন্যকোন আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে এ সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।
(৪) জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর প্রতিটি বিধান প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা প্রয়োজনীয়তা কিম্বা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। জুলাই সনদের আইনিভিত্তি এখন না হলে রাষ্ট্রের যে ৪ মূলনীতি পরিবর্তন করে বর্তমানে সংস্কারের ৭ নং মূলনীতিসমূহ : “সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি উল্লেখ থাকবে”।
এখানে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্র বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ দুটি নীতি বিলুপ্তির পর যে সব নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে সেখানে এ কথা বলা যাবে কিনা আগের সংবিধানে যা থাকুক বা আইনের ধারা যাই থাকুক বর্তমান সংস্কার করা নীতিসমূহ কি আগের নীতি বা আইনের উপর প্রাধান্য পাবে কি না? প্রাধান্য না পেলেতো পূর্বের নীতি সমূহই গ্রহণযোগ্যতা পায়।
বিদ্যমান সংবিধানের এমন অনেক ধারা পরিবর্তন করে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে সেগুলি এখনই আইনে সিদ্ধান্ত না হলে এ সরকার পরিচালনা করা তাদের কার্যক্রম এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের কোন আইনি ভিত্তি পাওয়া যাবে না।
তাই সবাইকে এ কথা বুঝতে হবে বর্তমানে যে সরকার গঠন হয়েছে তা নিয়মিত সরকার নয়, সরকার পরিচালনার বিভিন্ন কাজকর্ম, বিবিধ সংস্কার ও সংশোধন কোন নিয়মিত সরকারের দ্বারা নয়, এটি গণঅভ্যুত্থানের সরকার, সবকিছু ব্যতিক্রম ধরে বিপ্লবী সরকারের বৈশিষ্ট্য হাতে নিয়ে এগুতে হবে। শেখ হাসিনা যেমন জনগণের তাড়া খেয়ে পদত্যাগ করে চলে যাওয়ায় বিশেষ সরকার গঠন হয়েছে, তদ্রুপ এ সরকার ও জনগণ জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে সব কিছুই এখন তৈরি করবে, এটিই অধিকার, এটিই আইন ও এটিই সার্বভৌম ক্ষমতা। আর আদালত অনুসরণ করবে জনগণের তৈরি আইনি বিধান। ঐকমত্যে গৃহীত এমনও অনেক সংস্কার আছে যা এখনি আইনিভিত্তি লাভ না করলে জাতি যে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে তার খেসারত দেয়ার পথ থাকবে না।
লেখক : রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক।