তাওহিদা সুলতানা তিশা

প্রতিটি যুগেই নিজস্ব একটি প্রজন্ম থাকে; যাদের ওপর পরবর্তী নেতৃত্বের দায়িত্ব আসে। বর্তমান বিশ্বে সে দায়িত্ব যাদের ওপর, তাদের বলা হচ্ছে ‘জেন-জি’। জেনারেশন জি বা জেন-জি প্রযুক্তি, তথ্য ও বৈশ্বিক সংযোগের বিস্ময়কর সুবিধা নিয়ে জন্ম নিয়েছে বিধায় এ প্রজন্মকে সম্ভাবনা, উদ্যম ও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে দুঃখজনকভাবে এটি সত্যি যে, এ প্রজন্মের একটি অংশ এমন এক পথে পা বাড়াচ্ছে যা নেতৃত্বের ভাবমূর্তিকে কুলষিত করছে এবং সমাজে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করছে। নেতৃত্বে আসনে বসে দায়িত্ব পালনের ছদ্মবেশে তারা শুধু নিজেদের ভবিষ্যতকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন করছে না বরং গোটা সমাজব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তিও দুর্বল করে দিচ্ছে।

নেতৃত্ব মূলত এক প্রকার দায়িত্ব ও কর্তব্য, যেখানে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে জনগণের স্বার্থ, ক্ষমতা প্রদর্শনের চেয়ে দায়িত্ব পালন এবং ব্যক্তিগত লাভের চেয়ে সমাজের উন্নয়নের দিকটিকে প্রাধান্য দিতে হয়। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের একাংশ দেখা যাচ্ছে নেতৃত্বকে ক্ষমতার অহংকার হিসেবে তুলে ধরছে। অনেকে নেতৃত্বকে ব্যবহার করছে পরিচিতি পাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে, প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার এবং অসামাজিক কর্মকাণ্ডের ওপর পর্দা দেওয়ার একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে। এতে নেতৃত্বের প্রকৃত অর্থ হারিয়ে যাচ্ছে এবং জনগণ নেতৃত্বের সম্পর্কে এক নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছে।

সামাজিক বাস্তবতা বলছে, বহু তরুণ আজ নেতৃত্বের নামে এমন কাজে জড়িয়ে পড়ছে যা সমাজবিরোধী ও নৈতিকতার পরিপন্থি। মাদক সেবন ও বিভিন্ন নেশায় আসক্ত, পাচার, চাঁদাবাজি, দখলদারি, ছিনতাই, প্রতারণা এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতার ঘটনাও এর অন্তর্ভুক্ত। নেতৃত্বের আসনে থাকার কারণে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা প্রশাসন এবং আইনি ব্যবস্থার চোখ এড়িয়ে যায়। যার ফলে তাদের এ শাস্তিমূলক কর্মকাণ্ডের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায় এবং তারা আরও উগ্র হয়ে উঠে। আর ‘নেতৃত্ব’ নামটি তাদের কাছে হয়ে উঠে একটি ‘অভেদ্য ঢাল’।

তরুণদের এ বিপথগামী হওয়ার পিছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, নেতৃত্বের আসনে বসানোর আগে স্বচ্ছতার যাচাইয়ের অভাব। প্রায়ই দেখা যায়, নেতৃত্বে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মেধা, সততা, নৈতিকতা ও সমাজসেবার ভিত্তিতে নয়, বরং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে। এতে করে যারা প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বের আসনে বসার যোগ্যতা রাখে, তারা সে সুযোগ হারাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার ঘাটতি। ক্ষমতায় থাকা কারোর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুললে অনেক সময় এর জবাব পাওয়া যায় না, বরং প্রশ্ন তুলতেই ভীতি প্রদর্শন করা হয়। তৃতীয়ত, প্রবীণ নেতৃত্বের প্রশ্রয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতারাই তরুণদের ভুল পথে পা বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করে এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের ব্যবহার করেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারা? প্রথমত, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নেতৃত্বের ভাবমূর্তি। সাধারণ মানুষের দৃ’িকোণ থেকে নেতৃত্ব আর অনুকরণীয় কিছু নয়, বরং ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। যেখানে তরুণদের আদর্শ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনুসরণ ও অনুকরণ করবে, তারা হবে প্রেরণার উৎস, সেখানে তাদেরই কেউ কেউ হয়ে উঠছে ভয় ও অস্থিরতার কারণ। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা, নিয়মকানুন ও নৈতিকতার কাঠামো ভেঙে পড়ছে, কারণ একবার নেতৃত্বের ছদ্মবেশে অপরাধ ও অনৈতিক কাজ প্রশ্রয় পেলে তা বন্ধ করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে যায়।

তবে সমস্যার সমাধান অসম্ভব নয়। প্রথমত, নেতৃত্বে প্রবেশের ক্ষেত্রে কঠোর যোগ্যতার যাচাই থাকা প্রয়োজন-শিক্ষাগত যোগ্যতা, নৈতিক আচরণ, মূল্যবোধ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা স্প’ভাবে যাচাই করা উচিত। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতৃত্বের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতার শিক্ষা চালু করা যেতে পারে, যাতে তরুণরা বুঝতে পারে নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব পালন, ক্ষমতার অপব্যবহার নয়। তৃতীয়ত, অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত কোনো নেতা বা নেতৃত্ব প্রত্যাশীর ক্ষেত্রে পক্ষপাতহীনতা গ্রহণ করতে হবে, তা সে যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন। চতুর্থত, পরিবার ও সমাজকে তরুণদের ওপর নজরদারি ও দিকনির্দেশনার ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে।

একই সঙ্গে তরুণদের নিজেদেরও ভাবতে হবে—তারা ভবিষ্যতে নিজেদের কোন জায়গায় দেখতে চায়, ইতিহাসে কীভাবে নিজেদের নাম লিখাতে চায়। নেতৃত্বের নামে যদি তারা অপরাধ, সহিংসতা বা অসামাজিকতার পথে হাঁটে, তবে হয়তো সাময়িক কিছু সুযোগ-সুবিধা পাবে; কিন্তু পরবর্তীতে তা তাদের পরিচিতিকে কলঙ্কিত করবে। অপরদিকে, যদি তারা প্রকৃতপক্ষে সমাজের উন্নয়নে কাজ করে, মানুষের আস্থা অর্জন করে, সমাজে পরিবর্তন আনে, তবে তারা কেবল নিজেদেরই নয়, গোটা প্রজন্মকেই গর্বিত করবে।

জেন জি প্রজন্মের হাতে প্রযুক্তির শক্তি, নতুন কিছু চিন্তা করার উদ্দীপনা এবং সমাজ পরিবর্তনের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এই শক্তি যদি নৈতিকতার ভিত্তি ছাড়া ব্যবহৃত হয়, তবে তা অরাজকতা সৃষ্টি এবং ধ্বংসের ঘৃণ্য হাতিয়ার হয়ে উঠবে। আজকের তরুণদের বুঝতে হবেÑ নেতৃত্ব মানে কেবল ক্ষমতার চূড়ায় থাকা নয়, বরং সবার জন্য দায়িত্ব নেওয়া, সবার মঙ্গলের জন্য কাজ করা।

আমাদের সমাজের এ সংকটময় মুহূর্তে প্রয়োজন সৎ, নৈতিক এবং জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব। নেতৃত্বের আসনে থাকা তরুণদের উচিত নিজেদের প্রতিটি পদক্ষেপের প্রভাব উপলব্ধি করা, কারণ তারা শুধু নিজেদের নয়, একটি প্রজন্মের মুখপাত্র। যদি তারা ভুল পথে যায়, তবে সে ভুলের দায়ভার বহন করতে হবে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রকে। আর যদি তারা সঠিক পথে থাকে, তবে সেই পথ আলোকিত করবে ভবিষ্যতের পথযাত্রা।

আজ তাই সময় এসেছে নেতৃত্বের মুখোশধারী অসামাজিকতা বিস্তারের প্রবণতা বন্ধ করার এবং তরুণ নেতৃত্বকে সঠিক পথে ফেরানোর। এই দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং প্রত্যেক নাগরিকের। কারণ আগামী দিনের নেতৃত্ব গড়ে উঠছে আজকের কর্ম ও সিদ্ধান্তের ওপর। যদি আজ আমরা সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারি, তবে ভবিষ্যৎ হবে উদ্ভাসিত; আর যদি ব্যর্থ হই, তবে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার বলে তরুণ সমাজ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়