॥ অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন ॥
মানুষের চেহারা দেখে যেমন তার রাগ বা অভিমান বোঝা যায়, তেমনি একটি দেশের রাজধানী শহরের যান চলাচলের চিত্র দেখেও গণপরিবহনের দুরবস্থা ও শৃঙ্খলার অবস্থা অনুধাবন করা যায়। এমনকি শহরটি উন্নত না অনুন্নত তাও বোঝা যায়- যেন নগরজীবনের আয়না হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সড়ক ব্যবস্থা।
রাজধানী শহরে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা ও যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও রাস্তার দৈর্ঘ্য ও মানোন্নয়ন হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যেখানে শহরের ২৫ ভাগ জায়গা যান চলাচলের রাস্তা হওয়া প্রয়োজন, সেখানে আছে মাত্র ৮৮ কিলোমিটার। যেখানে সর্বোচ্চ ২ লাখ ১৬ হাজার যান চলাচলের উপযোগী, সেখানে বর্তমানে চলছে প্রায় ৫ লাখ যানবাহন। প্রতিদিন রাস্তায় যুক্ত হচ্ছে ২৩০টি নতুন গাড়ি। যেন পাত্র ভরে গিয়েছে, তারপরও তাতে পানি ঢালা হচ্ছে অবিরত। বিচিত্র যানবাহনের মিছিলে ২৮% প্রাইভেট কার, ৪১% মোটরসাইকেল, ১১% জীপ ও মাইক্রোবাস, ৬% ট্রাক, ৩% অটো রিক্সা, ২% বাস ট্যাক্সি, ১% মিনি বাস এবং ৭% অন্যান্য ধরনের যানবাহন চলাচল করে। গাড়ির চাপ বাড়লেও মানুষের দুর্ভোগ কিংবা ভোগান্তি কমছে না; বরং নিত্যদিনের যন্ত্রণার যাত্রী হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ।
ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা নতুন কিছু নয়! সিটিং সার্ভিস’ এর নামে যাত্রীদেরকে জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে। রাস্তায় বেরুলে গন্তব্যে পৌঁছানোর নেই কোন নিশ্চয়তা-যেন এক লটারি খেলা। যানজটে পড়ে যাত্রীরা কখনো কখনো বাস ছেড়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হন। ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে কখনো কখনো ১ ঘণ্টা লাগে। সবেচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন হাসপাতালগামী রোগী ও তাদের স্বজনরা। অ্যাম্বুলেন্স যতই জোরে সাইরেন বাজাক, যেন চারপাশে একটুকরো সহানুভূতির জায়গা নেই। যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে পুরো শহর। একটি দেশের রাজধানী কর্মচঞ্চল না হলে দেশের অর্থনীতি যেমন মুখ থুবড়ে পড়ে তেমনি কর্মঘণ্টা, রোগব্যাধি, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে চালকদের অদক্ষতা ও লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভিংয়ের কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। কারণ কিছু চালক নিজে গাড়ি না চালিয়ে অনভিজ্ঞ সহকারীকে গাড়ি চালাতে দেয়। ফলে সড়ক পরিণত হয় মৃত্যুফাঁদে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর হিসেবে সারাদেশে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, সিএনজি, অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ মোট গাড়ি প্রায় ৪৪ লাখ। এর বিপরীতে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছেন ২২ লাখ চালক। অর্থাৎ সাড়ে ২১ লাখ চালকের নেই কোনো বৈধ লাইসেন্স। তারা অবৈধভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন। এর ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। ৯০ দশকে চালকদের ওপর করা এক জরিপে দেখা যায় ২৭% চালক ট্রাফিক সিগন্যালের রঙ বুঝতেই পারেন না! ‘‘চোখে যদি দৃষ্টি না থাকে, তাহলে লাল-সবুজ সিগন্যালও তাদের কাছে সমান।’’ সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে পড়ছে কিছু তাজা প্রাণ। এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়। শুধুমাত্র জেল-জরিমানা কিংবা শাস্তি দিলেই স্বজনহারা পরিবারের দুঃখ বিতাড়িত হবে না? প্রয়োজন পুনর্বাসন।
অধিকাংশ বাস রুট পারমিট ছাড়াই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কিছু বাসের রুট পারমিট থাকলেও নির্ধারিত রুটে চলাচল করছে না। উল্টো বেশি অর্থ পাওয়ার লোভে একাধিক রুটে চলাচল করছে। ফলে দুর্ঘটনায় কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। রাজধানী সড়কে প্রায় ১২ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে, যা যানজটের অন্যতম কারণ। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ৪ লাখ ৪৫ হাজার যানবাহনের কোনো ফিটনেস সনদ নেই। এর মধ্যে রয়েছে- ২৪০২৬টি বাস, ১১,৭৮৮টি মিনিবাস, ৮২৮০৫টি পিকআপ, ৭৬০৫৮টি প্রাইভেটকার। এককথায় হাজার হাজার ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করছে। এসব যানবাহনের কারণে একদিকে সড়ক দখল হচ্ছে। অপরদিকে দুর্ঘটনা ও যানজট বাড়ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকার অনুমোদিত রুট ৩৩৮টি। এর মধ্যে ২৯৩টি রুট বাসের অভাবে বন্ধ, ১২টি রুটে নেই কোনো অনুমোদন, ৩৪টি রুটে অনুমোদনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বাস, ১৬৪৬টি বাস চলছে রুট পারমিট ছাড়া, অবৈধভাবে চলছে ২৭,০০০ লেগুনা। ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ির কোনোটির লাইট নেই, কাচ ভাঙা, সিট নোংরা, সিটে ছারপোকা, দরজা নেই, বডি খসে পড়ছে- তবুও সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও যানজট নিরসনে ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর গঠন করা হয় বাস রুট রেশনালাইজেশন (পুনর্বিন্যাস) কমিটি। এ কমিটির সাত বছরের মেয়াদ শেষ হলেও দৃশ্যমান পরিবর্তন নেই। তবে সম্প্রতি বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন যে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুরোনো ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন সরাতে শিগগির অভিযান শুরু হবে। গত বুধবার জুলাই শহীদ দিবস উপলক্ষে ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনালে চালক ও যাত্রীদের মধ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সড়কে প্রাণ ঝরছে। এ কারণে ২০ বছরের পুরোনো বাস এবং ট্রাক উঠিয়ে দেয়ার বিকল্প নেই।
১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিআরটিসির দেশের সব রুটে চলাচলের অধিকার থাকলেও, এটি এখন একটি লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সরকার আসে- যায়- নতুন বাস নামে, আবার অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু সচল করার উদ্যোগ চোখে পড়ে না। কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে, যাত্রীদের ভোগান্তি কমানোর স্বার্থে বিআরটিসি বাসকে সচল করা প্রয়োজন। প্রয়োজন রাজধানী ভেতর বেসরকারি বাস চলাচল বন্ধ করে সকল রুটে বিআরটিসি বাস চালু করা। যেন গণপরিবহনের ভোগান্তি কিছুটা হলেও লাগব হয়। যাত্রীদের ভোগান্তি কমানোর স্বার্থে সিডিউল অনুযায়ী বাসা ছাড়ার ব্যবস্থা করা, অতিরিক্ত যাত্রী বহন বন্ধ করা, মোবাইল অথবা ইয়ারফোন ব্যবহার বন্ধ করা, উল্টো পথে গাড়ি চলাচল বন্ধ করা, নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে যাত্রী ওঠানো এবং নামানো, যততত্র জায়গায় যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করা, ঘুমঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করা, একটানা ৫ থেকে ৮ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে বাধ্য না করা, যাত্রীদের ফুট ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস ও জেব্রাক্রসিং ব্যবহারে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি বিআরটিসিকে আধুনিক ও দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলা দরকার। যদি গণপরিবহনকে শৃঙ্খলায় না আনা যায় তাহলে কর্মঘণ্টা, জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি-সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উন্নত রাজধানী গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই সুশাসনের ছোঁয়া রাস্তাঘাট, পরিবহন এবং প্রশাসনে লাগাতে হবে।
যদি রাজপথে শৃঙ্খলা না ফেরানো যায় তাহলে গণপরিবহন হবে নির্যাতনের প্রতীক, উন্নয়ন হবে মুখোশ। সময় এখন সিদ্ধান্তের- শুধু পরিকল্পনার নয়, বাস্তবায়নের। নইলে প্রতিদিনই হারাবো আরও কিছু প্রাণ, আরও কিছু ভবিষ্যৎ। গাড়ির চাকা যত না ঘোরে, তারচেয়ে বেশি ঘোরে দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা ও নৈরাজ্যের চাকা। পরিবহন খাতকে শৃঙ্খলায় আনতে না পারলে উন্নত বাংলাদেশ হবে কেবল কাগুজে স্বপ্ন।
লেখক : প্রাবন্ধিক।