ডা. মো. জাহাঙ্গীর হুসাইন

আমাদের সমাজে দীর্ঘকাল ধরে একটি ধারণা প্রবল, যা অধিকাংশ মানুষ বলে বা করে, সেটাই সঠিক। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কিংবা সামাজিক অভ্যাসে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকেই চূড়ান্ত বলে ধরা হয়। কিন্তু ইসলাম এ ধারণাকে পুরোপুরি সমর্থন করে না। কুরআনুল কারিমে বহুবার বলা হয়েছে, অধিকাংশ মানুষ সত্য বোঝে না, কৃতজ্ঞ হয় না, কিংবা ইমান আনে না। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো বিষয়ের সত্যতার নিশ্চয়তা নয়। বরং সত্য নির্ভর করে আল্লাহর বাণী ও নববী নির্দেশের ওপর।

আল-কুরআনের ভাষায়Ñ ‘যতই তুমি আগ্রহ দেখাও না কেন, অধিকাংশ মানুষ ইমান আনবে না।’ (সূরা ইউসুফ ১২ : ১০৩) তাফসীরে ইবনু কাসীরের ভাষায়, এটি নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে সান্ত্বনা দিতে বলা হয়েছে। তিনি যত চে’া করেছেন, অধিকাংশ মানুষ তবুও সত্য গ্রহণ করেনি। কারণ তাদের হৃদয় পংকিলতায় আচ্ছন্ন। এ থেকে স্প’ হয়, সত্য সবসময় সংখ্যায় অল্প কিছু মানুষের মধ্যেই টিকে থাকে।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মানো, তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করবে।’ (সূরা আল-আন’আম ৬:১১৬) তাফসীর আল-কুরতুবির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, অধিকাংশ মানুষ তাদের প্রবৃত্তি, সামাজিক রীতি বা অন্ধ অনুকরণে চলে। আল্লাহ এখানে সতর্ক করেছেন—জনমতের অনুসরণ মানেই সঠিক পথ নয়। সত্যের মানদণ্ড হলো আল্লাহর হেদায়াত ও ন্যায়ের পথ। কুরআনের আরও অনেক আয়াতে সংখ্যাগরিষ্ঠের অন্ধতা তুলে ধরা হয়েছে।

সূরা আল-আরাফে বলা হয়েছে-‘তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা বোঝে না... তারা পশুর মতো, বরং তাদের চেয়েও বেশি পথভ্র’।’ (সূরা আল-আরাফ ৭:১৭৯) ইবনু কাসীর বলেন, জ্ঞান ও বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও যারা সত্যের পথে আসে না, তারা পশুর মতো। কারণ তারা চিন্তা ও বিবেক ব্যবহার করে না। আরেক আয়াতে বলা হয়েছে-‘কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞ নয়।’ (সূরা আল-বাকারা ২:২৪৩) এখানে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দেন, নেয়ামত ভোগ করেও যারা কৃতজ্ঞ হয় না, তারা প্রকৃত অর্থে বিভ্রান্ত। একইভাবে সূরা আল-আনকাবুত (২৯:৬৩)-এ বলা হয়েছে, ‘তবে তাদের অধিকাংশই বুঝে না।’ অর্থাৎ তারা প্রকৃতির নিদর্শন দেখে চিন্তা করতে পারত, কিন্তু তা করে না।

ইতিহাসও এই বাস্তবতার সাক্ষ্য দেয়। নূহ (আ.)-এর সময়ে শত শত বছর দাওয়াত দেওয়ার পরও কেবল অল্প কয়েকজন মানুষ ইমান এনেছিল। মূসা (আ.)-এর সময় বনি ইসরাঈল নবীর আদেশ অমান্য করেছিল বারবার।

নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ও মক্কার অধিকাংশ মানুষ প্রথমদিকে ইসলামকে অস্বীকার করেছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, সত্য কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ছিল না, বরং অল্পসংখ্যক সচেতন, সাহসী ও ইমানদার মানুষই সত্যের বাহক।

বর্তমান সমাজেও ‘যা সবাই করে, তাই ঠিক’-এই মানসিকতা ব্যাপক। কিন্তু কুরআন আমাদের সতর্ক করেছে। ইসলাম মানুষকে স্বাধীন চিন্তা, যুক্তি ও বোধশক্তির ব্যবহার শেখায়। সত্যকে যাচাই করতে হবে-কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশে, বিবেক ও প্রমাণের আলোকে এবং নৈতিক সাহসের সঙ্গে।

সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে চলা নয়, বরং সত্যে অটল থাকা একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য। কুরআন বারবার বলেছে- ‘যতই তুমি আগ্রহ দেখাও না কেন, অধিকাংশ মানুষ ইমান আনবে না।’ (সূরা ইউসুফ ১২:১০৩)

‘যদি তুমি অধিকাংশ লোকের কথা মানো, তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করবে।’ (সূরা আন’আম ৬:১১৬) ইসলামের দৃষ্টিতে তাই সত্যের মানদণ্ড সংখ্যায় নয়, ন্যায়ে। অল্পসংখ্যক হলেও যারা আল্লাহভীরু, কৃতজ্ঞ ও জ্ঞাননিষ্ঠ-তারাই প্রকৃত সফল। সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, বরং সচেতন সংখ্যালঘুর হাতেই টিকে থাকে সত্য, ন্যায় ও ঈমানের আলো।

লেখক : প্রাবন্ধিক।