হামদুল্লাহ আল মেহেদী
একুশে মে ২০১৭ সকালে আমার ঘুম ভেঙেছিল বাংলাদেশ লেবার পার্টির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব (বর্তমান মহাসচিব) সাবেক ছাত্রনেতা আবদুল্লাহ আল মামুনের ফোনে। জানতে পারি চিরবিদায় নিয়েছেন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান। তাঁর আকস্মিক মৃত্যু সংবাদে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম; ভেসে উঠলো হাজারো স্মৃতি।
জাতীয় রাজনীতিতে আপসহীন চরিত্রের সমার্থক হয়ে গিয়েছিলেন শফিউল আলম প্রধান। আপসহীন চরিত্রের জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে জীবনভর। মার্টিন লুথার কিং তার A Testament of Hope The Essential Writings and Speeches ‘গ্রন্থে লিখেছেন : There comes a time when one must take a position that is neither safe, nor politice, nor popular, but he must take it because conscience tells him it is right........ বিবেকের তাড়নায় সে অনিরাপদ, অরাজনৈতিক এবং অজনপ্রিয় পথই বেছে নিয়েছিলেন মরহুম শফিউল আলম প্রধান।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েও তৎকালীন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের তালিকা প্রকাশ করে ব্রাত্য হয়েছিলেন নিজ দলের কাছে। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলায় কারাবরণ করতে হয়েছিল তাঁকে। প্রখ্যাত রাজনীতিক মিজানুর রহমান চৌধুরী তাঁর রচিত ‘রাজনীতির তিনকাল’ বইয়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী একদলীয় বাকশাল গঠনের বিরোধিতা করতে না পারার তীরটিও ছুঁড়ে মারেন শফিউল আলম প্রধানের গায়ে। অনন্যা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের ১৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-“নদীভাঙন দেখাতে একবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চাঁদপুর যাই। তার সঙ্গে অন্য মন্ত্রীরাও ছিলেন। সরকারি জাহাজ চাঁদপুরে ভিড়ার সময় ছাত্রলীগের এক বিরাট গ্রুপ সে দিন স্লোগান দিয়েছিলো। প্রধান ভাইয়ের মুক্তি চাই, নইলে এবার রক্ষা নাই।’ তৎকালীন সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান সেভেন মার্ডার কেসের একজন অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে সে সময় কারাগারে আটক ছিলেন। যদিও এ ঘটনা বাকশাল গঠিত হওয়ার আগে। কিন্তু আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, রাজনৈতিক হত্যার সমর্থনে স্লোগান শুনে সেদিন বাকশাল বিরোধী সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে ভীত হয়ে পড়েছিলাম।”
আদর্শ বিসর্জন না দিতে শফিউল আলম প্রধান ১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল গঠন করেন একটি রাজনৈতিক দল। সে দল জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি তথা জাগপার সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে নানা পালাবদলের সাক্ষী ছিলেন।
শফিউল আলম প্রধানের বড় গুণ ছিল তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা। তিনি যখনই কোন মঞ্চে উঠতেন, মাইকের সামনে এসে দাঁড়াতেন, সবাই একটু নড়েচড়ে বসতেন। ভরাট কন্ঠের অধিকারী ছিলেন। বক্তব্যের একটা নিজস্ব স্টাইল ছিল, যা তাঁকে আরো দশজনের থেকে আলাদা করে নজর কাড়ত। ইসলামী চেতনা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন পুরোধা হিসেবে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। মাঝে মধ্যে অবমূল্যায়নও হয়েছে তাঁর। স্বাভাবিকভাবে এ নিয়ে তাঁর কিছুটা নীরব অভিমান ছিল। কিন্তু দায়িত্ব পালন থেকে একচুল পিছপা হননি কোনো দিন। জাতির দুঃসময়ে রাজপথে নেমে এসেছেন বারবার। তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান ও ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধানের সাথে যতটুকু দেখা-সাক্ষাৎ ও কথা-বার্তা হয়েছে তাতে পিতার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলোর দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালনের যোগ্যতা আছে বলে মনে হয়েছে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ লেবার পার্টি।