মমতাজ উদ্দিন আহমদ
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল এক অভিন্ন জাতিসত্তার ভিত্তিতে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতি বা ভিন্ন ভাষাভাষী হয়েও আমরা সবাই বাংলাদেশী। এ জাতীয় চেতনার সূত্র ধরে সংবিধানের ৬(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।” অতএব, বাংলাদেশে বসবাসরত প্রত্যেক নাগরিক-চাকমা, মারমা, ম্রো, ত্রিপুরা, সাঁওতাল বা গারো-সকলেই মূলত বাঙালি জাতির অংশ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু গোষ্ঠী নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার দাবি করছে। এ দাবি কেবল ইতিহাসবিরোধী নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও প্রতীয়মান হয়।
আদিবাসী বলতে বোঝায়-যারা কোনো ভূখণ্ডের আদি বা প্রাচীনতম বাসিন্দা। কিন্তু ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ নৃগোষ্ঠী শত শত বছর আগে ভারতের আসাম ও মিয়ানমার (তৎকালীন আরাকান) অঞ্চল থেকে এ ভূখণ্ডে এসে বসতি স্থাপন করে। ইতিহাসবিদ ড. সুবীর ভৌমিক তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ Troubled Peripherz (২০১০)-এ উল্লেখ করেছেন যে, চাকমা, মারমা, ম্রো, লুসাই প্রভৃতি জনগোষ্ঠী মূলত অভিবাসী, যারা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জীবনযাত্রার সুবিধার জন্য ধাপে ধাপে এ অঞ্চলে চলে আসে। এমনকি ব্রিটিশ প্রশাসনের ১৯০১ সালের জনগণনা রিপোর্টেও পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে-এ জনগোষ্ঠীগুলোর পূর্বপুরুষ আরাকান ও আসাম থেকে স্থানান্তরিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস শুরু করে। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে তাদেরকে ‘আদিবাসী’ বলা যায় না।
চাকমা, মারমা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর ভাষার সাথে বাংলার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের একটি গবেষণা প্রবন্ধে দেখা যায়, চাকমা ভাষার প্রায় ৮০ শতাংশ শব্দ বাংলা ও সংস্কৃত উৎস থেকে এসেছে।
চাকমা রাজারা দীর্ঘ সময় ধরে মুঘল ও ব্রিটিশ প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এমনকি তাদের নামের মধ্যেও মুসলিম প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ফলে, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের আলোচনায় পরিষ্কার বোঝা যায়—এ জনগোষ্ঠী বহু শতক ধরে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে নতুন পরিচয় তৈরি করেছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ILO Convention 169 অনুযায়ী, আদিবাসীরা রাষ্ট্রীয় ভূমি, প্রাকৃতিক সম্পদ ও আঞ্চলিক স্বশাসনের দাবি করতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার সচেতনভাবেই এ কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। ২০১১ সালে জাতিসংঘে প্রদত্ত এক বক্তব্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট ভাষায় বলেন:
“বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। এখানে আছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।” অতএব, ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মূলত এক রাজনৈতিক কৌশল কাজ করছে, যা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।
১৯৭০-এর দশক থেকেই কিছু পাহাড়ি গোষ্ঠী ‘জুম্মল্যান্ড’ নামে একটি পৃথক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক মহলের কিছু পক্ষও এ দাবিকে সমর্থন জানায়। এরই ধারাবাহিকতায় ‘আদিবাসী’ ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিদেশি সহায়তা ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলে আসছে। যদিও ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তি পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতিশীল করেছে, তবুও আজও ‘আদিবাসী’ প্রশ্নে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
২০১১ সালের জাতীয় জনগণনা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৯% মানুষ বাঙালি, আর বাকিদের মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামেও বাঙালির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অতএব, বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়কে ‘আদিবাসী’ ইস্যুর ভিত্তিতে বিভক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
আমাদের সংবিধানে কোথাও ‘আদিবাসী’ শব্দ নেই। সেখানে উল্লেখ আছে— “উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী” (অনুচ্ছেদ ১৫(গ), ২৩(ক), ২৮(৪), ২৯(৩))। কোনো আদালতের রায়েও এখনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সুতরাং ‘আদিবাসী’ দাবি সংবিধানবিরোধী এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর। এখানে স্পষ্ট করা প্রয়োজন-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ভাষা, পোশাক, উৎসব, সঙ্গীত আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের অংশ।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এগুলোকে সংরক্ষণ ও বিকাশে সহায়তা করা। কিন্তু ‘আদিবাসী’ পরিচয় দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিভাজন সৃষ্টি করা যাবে না। ইতিহাস, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের শেখায়Ñআমরা সবাই একটি জাতি, সেই জাতির নাম বাঙালি।
আজকের বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। কাজেই ‘আদিবাসী’ নামের ভ্রান্ত ও বিভাজনমূলক ধারণা ছড়িয়ে দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার সুযোগ দেওয়া যাবে না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি রক্ষা হোক, বৈচিত্র্য লালিত হোক কিন্তু জাতীয় পরিচয় হবে অভিন্ন।
লেখক : সাংবাদিক।