মো: রুহুল আমিন
উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণে একটি বড় সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ইপিজেড (রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) স্থাপনের উদ্যোগ। বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)-এর অধীনে এ ইপিজেড বাস্তবায়িত হলে গোটা রংপুর বিভাগে শিল্পায়নের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হবে। শুধু কর্মসংস্থান নয়, এর মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক কাঠামোতেও আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মাঙ্গাপীড়িত উত্তর অঞ্চল সব সরকারে কাছে সব সময় অবহেলার স্বীকার। দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় উত্তর অঞ্চলে উন্নয়নের ছোঁয়া কম লেগেছে। সমগ্র গাইবান্ধা জেলায় বৃহৎ শিল্প কারখানা বলতে রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড ছিলো কিন্তু বছরের পর বছরের লোকসানের কারণে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ সুগার মিলের জমিতে এ ইপিজেড বাস্তবায়িত হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
একটি শিল্পাঞ্চল শুধু পণ্য উৎপাদন করে না, গড়ে তোলে দক্ষ জনশক্তিও। ইপিজেড কেন্দ্রিক কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ট্রেনিং ওয়ার্কশপের মাধ্যমে স্থানীয় যুবসমাজ বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠতে পারবে। এতে তারা শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে। ইপিজেড মানেই বৃহৎ শিল্পজোন। প্রাথমিক পর্যায়েই প্রায় দু লক্ষাধিক লোকের সরাসরি ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পোশাক, ইলেকট্রনিক্স, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বহু খাতে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা তৈরি হবে। এতে যেমন বেকারত্ব কমবে, তেমনি এলাকার তরুণরা কর্মমুখী হয়ে উঠবে। কর্মসংস্থানের অভাবে এ এলাকার মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। ইপিজেডের সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এখানে অসংখ্য শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে, যা গাইবান্ধা, বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, এবং রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের লাখ লাখ বেকার যুবক-যুবতীর জন্য নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করবে। বিশেষ করে, এ এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা, যারা প্রায়শই কাজের অভাবে ভোগেন, তাদের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ হবে। স্থানীয়ভাবে কাজের সুযোগ সৃষ্টির ফলে বেকারত্বের হার কমবে এবং মানুষকে কাজের সন্ধানে শহরমুখী হতে হবে না।
ইপিজেড বাস্তবায়িত হলে এলাকাশ শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে ফলে তারা নিজ বাড়িতে থেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। শুধু শিল্পে কর্মসংস্থানই নয়, ইপিজেড কেন্দ্রিক হোটেল-রেস্টুরেন্ট, যাতায়াত, আবাসন, পরিবহন, খুচরা ব্যবসা- সবখাতেই ছড়িয়ে পড়বে অর্থনৈতিক সঞ্চালন। বাড়বে জনসাধারণের আয়, উন্নত হবে জীবনমান। ফলে গাইবান্ধার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে এর প্রভাব পড়বে।
একটি ইপিজেড গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন হয় আধুনিক অবকাঠামো- পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, নিরাপদ পানি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, শিল্পাঞ্চল সংলগ্ন আবাসিক এলাকা ইত্যাদি। ফলে গোবিন্দগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে নাগরিক সুবিধা বাড়বে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ট্রেনিং সেন্টার ইত্যাদিও গড়ে উঠবে, যা পুরো এলাকাকে করবে পরিকল্পিত ও কর্মক্ষম। উন্নত হবে এলাকার মানুষের জীবন যাত্রার মান।
ইপিজেডে কাজ করার মধ্য দিয়ে স্থানীয় শ্রমিকরা বিভিন্ন আধুনিক শিল্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে উঠবে। এ দক্ষতা তাদের শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও কাজের সুযোগ করে দেবে, যা দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হবে। একই সাথে, ইপিজেডকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সহযোগী শিল্পের বিকাশ ঘটবে। যেমন: শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ, পরিবহন, প্যাকিং, এবং রক্ষণাবেক্ষণের মতো অনেক নতুন ছোট ও মাঝারি ব্যবসা গড়ে উঠবে, যা আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবে।
প্রস্তাবিত ইপিজেড ভৌগোলিক ভাবেও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এটি থেকে মাত্র ৩২ কি.মি. দূরে হিলি স্থলবন্দর, ৩৪ কি.মি. দূরে সম্প্রসারিত বগুড়া বিমানবন্দর, ৭০ কি.মি দূরে সৈয়দপুর বিমান বন্দর, মহিমাগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে মাত্র ১৭ কি.মি. দূরে অবস্থিত। এছাড়াও এটি গোবিন্দগঞ্জ থেকে দিনাজপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে এবং ঢাকা রংপুর মহাসড়ক থেকে মাত্র ৬ কি.মি. দূরে অবস্থিত হওয়ার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। এর পাশে দিয়ে বয়ে গিয়েছে করতোয়া নদী। ফলে সকল ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে।
ইপিজেডে উৎপাদিত পণ্যের একটি বড় অংশ বিদেশে রপ্তানি হয়। এর ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ে। স্থানীয় কৃষি ও কুটির শিল্পের পণ্যসমূহ রপ্তানিযোগ্য হয়ে উঠলে কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতেও গতি আসবে। ইতিমধ্যে এপেক্স, কাজী ফার্ম, হেকেম সহ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ওই অঞ্চলে শিল্প কারখানা গড়ার লক্ষ্যে জমি ক্রয় করেছে। ইপিজেড বাস্তবায়িত হলে শিল্প কারখানা গুলো চালু করতে পারলে গোবিন্দগঞ্জ পরিনত হবে শিল্প নগরীতে এবং জাতীয় অর্থনৈতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। ইপিজেড এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করবে। বিনিয়োগে আকৃষ্ট হওয়া দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসবে।
গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেড বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে জমি অধিগ্রহণের ঝামেলায় যেতে হবে না। কারণ এখানে রংপুর সুগার মিলস লিমিটেডের ১৮৩২ একর জায়গা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সুগার মিল বন্ধ থাকায় সাঁওতাল ও স্থানীয় কিছু সুবিধাবাদী মানুষ এটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের রাজনীতি করতেছে। এ জমি থেকে সরকার কোন ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে পারছে না। ইপিজেড বাস্তবায়নের জন্য ৪৫০ একর জমির প্রয়োজন, ফলে ভবিষ্যতে সুগার মিল চালু হলেও জমিতে অনায়াসে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারব।
গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেড বাস্তবায়ন শুধু একটি প্রকল্প নয়, এটি হবে উত্তরাঞ্চলের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত। এর মাধ্যমে শিল্প, কৃষি, মানবসম্পদ, অবকাঠামোসহ সামগ্রিক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হবে। তাই এই উদ্যোগকে সবাইকে মিলে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। সম্প্রতি ইপিজেড বাস্তবায়নের পক্ষ ও বিপক্ষে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। একটি গোষ্ঠী সাঁওতালদের ব্যবহার করে তাদের সরকারি জমি ভোগ করছে। গোবিন্দগঞ্জ সচেতন মানুষদের এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে যেন কোন গোষ্ঠী এটি বাস্তবায়নে বাঁধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে। এটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া।