এম এ কবীর

দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হই। চলার পথে আমাদের কখনও সুখ কখনও দুঃখ নিয়েই চলতে হয়। তবে সুখ বা দুঃখ কোনটিই স্থায়ী নয়। যাপিত জীবনের এ সকল সমস্যার সমাধান পেতে আমরা বিভিন্ন উপায়ও খুঁজি। এ আলোচনায় আজ আমরা একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর আলোকপাত করবো।

মানুষের নিজের শরীর, সম্পত্তি, সুনাম, দখল ইত্যাদির উপর যেমন আইনগত অধিকার আছে তেমনি জমির ভোগ-দখল ও স্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারও স্বীকৃত। এ স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগের দখলে কেউ অহেতুক হস্তক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে নুইস্যান্স বা উৎপাতের মামলা করা যায়। উৎপাত হচ্ছে এমন কোন আচরণ বা আস্থার বর্ণনা যা বিরক্তি সৃষ্টি করে যেমন, বাড়ির পাশে ইটভাটা করা। আবার এমন আচরণ যা ক্ষতির কারণ ঘটায় যেমন প্রতিবেশির বাড়ির পাশে উচ্চ শব্দে গান বাজনা করা।

উৎপাতের আইনগত দায়দায়িত্ব : কোন বিষাক্ত ধোয়ার ফলে গাছপালা বিনষ্ট হলে আদালত উৎপাতের জন্য দায়ী করে থাকে। পানি, বিদ্যুৎ, ধোঁয়া, দুর্গন্ধ, আগুন, গ্যাস, হট্টগোল, তাপ, সংক্রামক ব্যাধি দ্বারাও উৎপাত সৃষ্টি করা যায়। উৎপাত দু’ধরনের হতে পারে : সাধারণ উৎপাত ও ব্যক্তিগত উৎপাত। সাধারণ উৎপাত হচ্ছে কিছু বেআইনি কাজ বা নিবৃত্তি, যার ফলে জনগণের জীবন, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, সম্পত্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিপন্ন হয়। অথবা জনগণ সমষ্টিগতভাবে যে সকল অধিকার ভোগ করে থাকে যেমন, রাস্তায় চলাচল করা, তাতে অহেতুক হস্তক্ষেপ করা। ব্যক্তিগত উৎপাত হচ্ছে এমন এক কাজ যা ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতির কারণ ঘটায়।

গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর, পথ-ঘাট-হাট-মাঠ অফিস আদালত সবখানেই আছে উৎপাত আর উৎপাত। আভিধানিক অর্থে, উৎপাত শব্দের অর্থ হচ্ছে অত্যাচার, উপদ্রব, দৌরাত্ম্য, আঘাত করা, বিরক্ত করা। সাধারণ অর্থে অন্যের ভোগে বা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত ঘটানোর নামই উৎপাত। এটি এক ধরনের অপরাধমূলক কাজ, যা জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। ব্যক্তি আইন মেনে আরেকজনকে বিরক্ত না করে যদি তার ন্যায়সংগত অধিকার ভোগ করে তাতেও কারও ব্যাঘাত ঘটানোর অধিকার নেই। এই ব্যাঘাত ঘটানোই হলো উৎপাত। উৎপাতের দায়-দায়িত্ব সৃষ্টি হয় এমন কোনো অবস্থা সৃষ্টি করলে যাতে অন্যের ভোগে বা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।

পৃথিবীর অনেক দেশে উৎপাত করা একটি শাস্তিযোগ্য দেওয়ানি অপরাধ। আমাদের দেশে গণ-উৎপাত সম্পর্কে দণ্ডবিধির (১৮৬০) ২৬৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি কর্তৃক জনসম্মুখে এমন কোনো কাজ করা যার দ্বারা জনগণের বিরক্তি সৃষ্টি হয় এমন কার্য করাকে গণ-উৎপাত বলে।’ আর দণ্ডবিধির ২৯০ ধারায় এর শাস্তি সম্পর্কে ২ শত টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান রয়েছে। আবার ধোঁয়াজনিত উৎপাত আইন ১৯০৫ এর ৩নং আইন দ্বারা (ইটভাটাসহ অন্য যে কোন কারণে) অগ্নিচুল্লী, কয়লা পোড়ানো দ্বারা উৎপাত নিরোধের জন্য কমিশন গঠনের কথা বলা আছে।

দণ্ডবিধির সংজ্ঞা অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তি তার অবৈধ কাজ যা জনসাধারণের উপদ্রব সৃষ্টির জন্য দায়ী, যা জনসাধারণের শারীরিক বা মানসিক আঘাত, বিপদ বা বিরক্তি সৃষ্টি করে তা-ই উৎপাত। অতএব, কোনো ব্যক্তির উচ্চ শব্দের সংগীতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বৈধ অধিকার, যা শব্দের তীব্রতার কারণে একটি অপরাধকে সংগঠন করে।

অনেকে উৎপাত আর দায়িত্বে অবহেলাকে এক বিষয় হিসেবে মনে করেন। কিন্তু উৎপাত আর দায়িত্বে অবহেলা এক বিষয় নয়। অবহেলার ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হচ্ছে বিবাদীর সাবধানতা অবলম্বন করা দায়িত্ব ছিল কি না এবং বিবাদী সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে কি না। আর উৎপাতের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের প্রশ্ন ওঠে না। বিবাদীর আচরণই মুখ্য বিষয়। যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করার পরও যদি উৎপাতের সৃষ্টি হয় তার পরও বিবাদী দায়ী। কিন্তু কারও জমিতে কোনো আগন্তুক যদি উৎপাতের কারণ সৃষ্টি করে তবে জমির মালিক অসতর্কতার জন্য অবহেলার দায়ে দায়ী হবেন। কারণ, তার জমিতে এসে কেউ উৎপাত সৃষ্টি করলে তার দায়-দায়িত্ব মালিককেও নিতে হয়। অবহেলার ক্ষেত্রে বাদীর অবদান বিবাদীর দায়-দায়িত্ব আনুপাতিক হারে হ্রাস করে। উৎপাতের স্থলে বাদী নিজেই এসেছিল- এরকম আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। পরিস্থিতি স্থান, পদ্ধতি, ফলাফল, সংবেদনশীলতা ইত্যাদির আলোকে বিচার করতে হয়, সেখানে উৎপাতের প্রতিকার পাওয়া যাবে কি না।

আইনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে উৎপাত বৈধ হয়ে যায়, কিন্তু অবহেলার জন্য আইন ক্ষমতা দেয় না। উৎপাতের প্রতিকারের জন্য বাদীকে দখল বা মালিকানা প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু অবহেলার ক্ষেত্রে কোনো স্বত্ব প্রমাণের প্রয়োজন নেই, বাদীর প্রতি ক্ষতি অনুমেয় কি না, তা-ই এখানে বিবেচ্য বিষয়। এ ক্ষেত্রে Gormnan v. Gorman (১৯০৩)’ মামলাটি প্রাসঙ্গিক। এ মামলার ঘটনাটি এমন- অনেক মৌমাছি বিবাদীর অঙ্গনে রাখা হয়েছিল, কিন্তু স্থানটি মৌমাছি রাখার জন্য উপযুক্ত ছিল না। ফলে মৌমাছি সে স্থান থেকে বের হয়ে এসে বাদীকে আক্রমণ করে। বিবাদীকে উৎপাতের দায়ে একজন বিচারক দায়ী করেন কিন্তু অপর একজন বিচারক তাকে অবহেলার জন্য দায়ী করেন। কারণ, সেখানে সতর্কতা অবলম্বন করা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করার পরও যদি উৎপাতের সৃষ্টি হয় তার পরও বিবাদী দায়ী। কিন্তু কারও জমিতে কোনো আগন্তুক যদি উৎপাতের কারণ সৃষ্টি করে তবে জমির মালিক অসতর্কতার জন্য দায়ী। ঠিক তেমনিভাবে অসতর্কভাবে অস্ত্রোপচার অবহেলার সমান, এটি উৎপাত নয়। তবে অবহেলার পরিধি উৎপাতের পরিধির চেয়েও ব্যাপক। কেউ ক্রমাগত উৎপাত করলেও বিষয়টিকে অবহেলা বা অজ্ঞতা বলে ক্ষমার চোখে দেখা হয়। ফলে উৎপাতের পরিমাণ বাড়ে। সম্ভাব্য ও অনুমেয় ক্ষতির জন্য সাবধানতা অবলম্বনে কেউ ব্যর্থ হলে বিষয়টিকে আমরা অবহেলা বলে গণ্য করতে পারি। কিন্তু উৎপাত নয়। কেউ তার এ কাজের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে আমরা অবহেলার দায়ে দায়ী করতে পারি। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই কাজের জন্য অবহেলা অথবা উৎপাতের প্রতিকার পাওয়া যায়, কিন্তু এ দুটি বিষয় এক নয়। যদিও আইনের ভাষায় দুটি বিষয়ই টর্ট আইনের অন্তর্গত।

বর্তমানে অবহেলা স্বতন্ত্র টর্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে অনেক ক্ষেত্রে উৎপাতের সঙ্গে জড়িত ছিল। আমাদের দেশে টর্টের যে দু-চারটি মামলা হয়ে থাকে তা মূলত মানহানিকেন্দ্রিক। টর্টের অন্যান্য বিষয় যেমন- উৎপাত, গণ-উৎপাত, দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অনধিকার প্রবেশ ইত্যাদি বিষয়ক মামলা আদালতে অজ্ঞাত কারণে দায়ের হতে দেখা যায় না। ফলে আইনের এ গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি দেশের আইন অঙ্গনে উপেক্ষিত থাকায় এর প্রয়োগ ও প্রতিকার সম্পর্কে অনেকেরই অজানা। অথচ টর্ট আইনে মামলা করে সহজেই উৎপাত বা গণ-উৎপাতের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।

এ দেশে উপদ্রব বা উৎপাত এখন একটি সাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেশের লোকজন প্রতিনিয়ত বড় বড় অন্যায়-অপরাধ, দুর্নীতি দেখতে দেখতে উৎপাতের মতো বিষয়টি যেন তাদের মাথায়-ই আসে না। এর অন্যতম কারণ, এ-সংক্রান্ত কোনো কার্যকর আইন নেই। যেহেতু উৎপাত হত্যা, ধর্ষণ এবং অন্যান্য বড় অপরাধের মতো গুরুতর নয়, তাই জনগণ এ অপরাধ সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন নন। কিন্তু সকলের মনে রাখা দরকার, উৎপাত বা উপদ্রবের মতো ছোট অপরাধ হত্যাকান্ডে পর্যন্ত রূপান্তরিত হতে পারে। এ ধরনের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের আইনি শিক্ষার অভাব, সচেতনতার অভাব এবং আইনের বাস্তব প্রয়োগের অভাব। আমরা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছি বটে, কিন্তু সভ্য আচরণ শেখার ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। আর এ কারণেই চারদিকে এতসব উৎপাত, উপদ্রব। উৎপাত যেন জীবনেরই অনুষঙ্গ; তাই উৎপাতে এখন আমরা আর বিরক্ত হই না। যেকোনো জাতি-গোষ্ঠীর জন্য শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা অনেক বড় নিয়ামত। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার ঐকান্তিক চেষ্টা থাকে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাতে মানুষ সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে। ইসলাম মানবজাতির যে নিরাপত্তা দিয়েছে তা অন্য কোনো ধর্ম দেয়নি। মানুষকে আল্লাহ তাআলা বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। এ বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সে ভালো-মন্দ পথ নির্বাচন করবে। বিবেক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার প্রতিও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেসব কারণে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে যায় কিংবা লোপ পায়, সেগুলো হারাম করা হয়েছে। অন্যকে অসম্মান করা পাপ। কারো দোষচর্চা করা পাপ। কারো পেছনে গোয়েন্দাগিরি করাও পাপ। কোনো নিষ্পাপ ব্যক্তির ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়া জঘন্য অপরাধ। পরনিন্দা, গিবত ইত্যাদিকে হারাম করা হয়েছে। কারণ এসব হচ্ছে সামাজিক ব্যাধি।

আমরা প্রায়ই এমন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হই যার সাথে আমাদের মানিয়ে নিতে হয় কিংবা খাপ খাইয়ে নিতে হয়। তবে সময় যত খারাপই হোক, ইতিবাচক চিন্তাভাবনা ও মানসিকতা আমাদেরকে খারাপ সময়েও ভালো থাকতে অনেকাংশে সাহায্য করে।

লেখক : সাংবাদিক।