ইকবাল হোসেন

মানুষ কি সত্যিই মৃত্যুকে ভয় পায়? নাকি সে ভয়টি অন্য কোথাও, আরও গভীরে প্রোথিত? মৃত্যুর ভয় হয়তো শারীরিক, কিন্তু বদনামের ভয়-তা আত্মার গভীরে গিয়ে হানা দেয়। আমরা সবাই জানি, একদিন আমাদের চলে যেতে হবে। মৃত্যু নিশ্চিত, অনিবার্য। অথচ মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকে না, যেমন প্রস্তুত থাকে না বদনামের অপ্রত্যাশিত আঘাতের জন্যও। মৃত্যুর পর শরীর মাটিতে মিশে যায়, কিন্তু বদনামের দাগ থেকে যায় সমাজের মুখে, ইতিহাসের পাতায়, গল্পের ফিসফিসে।

বদনামের ভয় এতটাই প্রকট যে, মানুষ অনেক সময় সত্য বলার সাহস পায় না। মুখ বুজে অন্যায় সয়ে যায়, শুধু এ ভয়ে- “কি বলবে লোকজন?” এ ‘লোকজন’ যেন এক অদৃশ্য শাসক, যার আদালতে আমরা প্রতিনিয়ত বিচারাধীন। অথচ এ শাসকের বিচার অনেক সময় হয় তথ্যহীন, পক্ষপাতদুষ্ট এবং নির্মম।

একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাকে তার দু’চোয়ালের মাঝের (জিহ্বা) এবং দু’পায়ের মাঝের (লজ্জাস্থান) জিনিসের জামিন দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জামিন দেব।” - (সহীহ বুখারী: ৬৪৭৪)

এ হাদিস আমাদের শেখায়-কথার মাধ্যমে মানুষ যেমন সম্মান পেতে পারে, তেমনি অপবাদ দিয়ে অন্যের জীবন দুর্বিষহ করতেও পারে। বদনাম শুধু একজন মানুষের মনকে নয়, তার চারপাশের সম্পর্ক, তার পরিবার, এমনকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও আঘাত করে। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরও বলেন,”তুমি যদি এমন কিছু বলো যা তোমার ভাইয়ের অপছন্দনীয়, তবে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তার সে গুণ না থাকে, তবে তুমি তার প্রতি অপবাদ আরোপ করলে।” - (সহীহ মুসলিম: ২৫৮৯)

তাহলে প্রশ্ন জাগে, এ সমাজে আমরা কতটা সচেতন? কত সহজেই না আমরা গুজব বিশ্বাস করি, চরিত্রে কলঙ্ক এঁকে দিই, মানুষের আত্মাকে নষ্ট করে ফেলি কেবল একজনের কথায়, একটি ভিডিওতে, কিংবা একটি ফেসবুক পোস্টে!

একটি সময় ছিল, বীরেরা সম্মানের জন্য জীবন দিতেন। আত্মসমর্পণ করতেন না, কারণ তারা জানতেন, পরাজয় মানে কেবল হারা নয়-অসম্মানিত হওয়া। আজও অনেক মানুষ তাদের আত্মসম্মান রক্ষার্থে সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আত্মঘাতী হয়, অথবা একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে হারিয়ে যায়।

একজন মানুষ দিনের শেষে হয়তো ভুল করেছে। কিন্তু সে ভুল তাকে খলনায়কে পরিণত করার আগেই আমরা কি একবার ভাবি না-”তার দিকটাও শোনা উচিত?” বদনামের আগুনে পুড়িয়ে ফেলার আগে আমরা কি বুঝি, সে মানুষটিও আমাদের মতো রক্ত-মাংসের মানুষ, যার পরিবার আছে, অনুভূতি আছে?

রাসূল (সা.) এর জীবনে অপবাদ এসেছে বহুবার। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা.)-কে নিয়েও রটানো হয়েছিল চরম অপবাদ। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং কুরআনের আয়াত নাজিল করে তাঁর পবিত্রতা প্রমাণ করেছেন (সূরা নূর, আয়াত ১১-২০)। এ ঘটনা আমাদের শিখায়-মানুষের চরিত্র নিয়ে রটনা করা কত ভয়াবহ, আর কতটা সহনশীলতা ও ন্যায়বিচার থাকা উচিত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে।

বদনাম কখনো কখনো সত্যের ছায়া হয় না-বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল ব্যাখ্যার ফল। এ সমাজে সত্যকে ঢেকে ফেলা হয় গুজবের চাদরে। যে সমাজে ‘কি বলবে লোকজন’ নামক ভয়ের কারণে একজন মানুষ নিজের স্বপ্ন, কেরিয়ার এমনকি জীবনের সিদ্ধান্তগুলো পর্যন্ত অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির কাছে সঁপে দেয়-সেই সমাজ সত্যিকারের মানুষ গড়তে পারে না।

এ লেখা কোনো আবেগের নিছক প্রকাশ নয় বরং খুবই বাস্তবসম্মত। আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ বদনামের বলি হচ্ছে। আমরা যদি পরিবর্তন না আনি দৃষ্টিভঙ্গিতে, তাহলে একদিন আমরাও হবো সে একই ভয়ের শিকার।

সম্মান কামনা করা অস্বাভাবিক নয়। তবে কারও অপমান করে নিজের সম্মান প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা-তা চূড়ান্ত অমানবিক। আমরা যদি সত্যিকারের মানবিক হতে চাই, তাহলে আমাদের প্রয়োজন দয়া, সহানুভূতি ও বিবেচনার চোখ।

বদনাম নয়-সত্য, ন্যায় এবং সহানুভূতিই হোক আমাদের সমাজের চালিকা শক্তি। তাহলে একদিন মানুষ শুধু মৃত্যুকেই নয়, বদনামের ভয়কেও জয় করতে শিখবে।

লেখক : সংবাদকর্মী।